চীনের সঙ্গে উষ্ণতা সৌদির সঙ্গে শীতলতা বাড়াচ্ছে কি

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাম্প্রতিক সময়ে নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর একের পর এক চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে সৌদি আরব। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের। সন্দেহ করা হচ্ছে, রিয়াদের আচরণে আকস্মিক পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি। যদিও বেশির ভাগ বিশ্লেষকই বলছেন, স্থানীয় শ্রমবাজারের সৌদিকরণের পরিকল্পনা থেকেই ঢাকার ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে রিয়াদ।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। দেশটিতে বর্তমানে ২২ লাখের বেশি বাংলাদেশী বসবাস করছেন। জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ার আগে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশটিতে গিয়েছেন লাখ ৮১ হাজার ২১৮ বাংলাদেশী কর্মী। একই সঙ্গে দেশটি আবার বাংলাদেশে রেমিট্যান্সেরও সবচেয়ে বড় উৎস। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) দেশটি থেকে রেকর্ড ৪০১ দশমিক ৫১ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। করোনার মধ্যেও চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই-আগস্ট) দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৮ কোটি ডলারের বেশি।

বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে দেশটির আচরণ এক প্রকার বৈরী হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবে অবস্থানরত অবৈধ অনথিভুক্ত বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনতে ঢাকার ওপর চাপ দিয়ে চলেছে দেশটি। রিয়াদে নিযুক্ত বাংলাদেশী দূতাবাসের আশঙ্কা, সৌদি আরব থেকে বিতাড়িত হতে পারে -১০ লাখ বাংলাদেশী। অন্যদিকে দেশটিতে চার দশক ধরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেয়ার জন্যও ঢাকাকে চাপ দিচ্ছে রিয়াদ।

অথচ ঢাকা রিয়াদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কিছুদিন আগেও বেশ উষ্ণ ছিল। গত বছরই দুই দেশের মধ্যে এক সামরিক সমঝোতা সই হয়। এর পর পরই সৌদি মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যসহ ৩৪ জনের এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে পাঠান দেশটির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। দুই দেশের বৈঠক শেষে প্রতিশ্রুতি আসে বড় বিনিয়োগেরও। প্রতিনিধি দলকে ২৯ প্রকল্পে হাজার ১০৪ কোটি টাকা বিনিয়োগেরও প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ।

সৌদি আরবের বর্তমান বৈরী আচরণের পেছনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চীনঘনিষ্ঠতা কাজ করছে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ তৈরি করেছে ইসলামাবাদ-রিয়াদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান গত বছর পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। ওই সময়ে পাকিস্তান সৌদি আরবের মধ্যে বেশকিছু বাণিজ্য বিনিয়োগ চুক্তি সই হয়। কিন্তু এর ১৮ মাসের মাথায় দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরে। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের পক্ষে অবস্থান নেয় সৌদি আরব। বিষয়টিতে পাকিস্তানে এক ধরনের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। অন্যদিকে ইসলামাবাদ-রিয়াদ সম্পর্কের অবনতির পেছনে চীন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিরোধজনিত মেরুকরণকে দায়ী করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।

তাদের ভাষ্যমতে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র সৌদি আরব। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক রাজনীতিতে মার্কিনদের কাছে ভারতই গুরুত্ব পায় সবচেয়ে বেশি। এছাড়া চীন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বৈরিতা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতেই কাশ্মীর ইস্যুতে চীনঘনিষ্ঠ দেশ পাকিস্তানের বদলে ভারতকে সমর্থন দিয়েছে রিয়াদ।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠার পেছনে চীনঘনিষ্ঠতা কাজ করলেও বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরিতার পেছনে রিয়াদের স্থানীয় শ্রমবাজার সৌদিকরণ পরিকল্পনাই দায়ী বলে মনে করছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশটি সৌদিকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন তার নিজস্ব মানুষগুলোকে কাজে লাগাতে গেলে প্রথমে যারা স্থানগুলো ধরে বসে রয়েছে, তাদের সেখান থেকে সরাতে হবে। আর বাংলাদেশ সৌদি সম্পর্ক মূলত শ্রমনির্ভর। কারণেই এখানে চাপ অনুভূত হচ্ছে। সৌদি আরব আগে ইসলামিক সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে যে আচরণ করত, সেখান থেকে অনেক সরে এসেছে। তারা এখন ভারত, ইসরায়েলের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক করছে। ইরানসহ কয়েকটি মুসলিম দেশের সঙ্গেও সৌদি আরবের বিরূপ সম্পর্ক বিরাজ করছে।

২০১৫ সালে সৌদি আরবের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়। বর্তমানে দেশটির নাগরিকদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে। কারণে দেশটিতে অবস্থানরত অন্য দেশের বৈধ-অবৈধ নাগরিকদের বিতাড়নের পরিকল্পনা হাতে নেয় রিয়াদ। কারণে দেশটি এখন আর সেখানে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশী দূতাবাসের আশঙ্কা, এবার সেখান থেকে -১০ লাখ বাংলাদেশীকে বিতাড়ন করা হতে পারে। রিয়াদের বাংলাদেশী দূতাবাস থেকে বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে।

বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, চলতি বছরের মার্চের শেষে রিয়াদের বাংলাদেশী দূতাবাস জানিয়েছে, সৌদি আরব বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করছে। শুরুতে অবৈধ অনথিভুক্ত বাংলাদেশীদের নিয়ে আসতে বলেছে। তারপর হয়তো বৈধভাবে যেসব বাংলাদেশী রয়েছেন, বিভিন্ন উপায়ে তাদের সৌদিতে টিকে থাকা কঠিন করে দেবে দেশটি। এর উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। সেখানে মিসরের নাগরিকদের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, তাদের অনেকেই সৌদি আরব ছেড়ে চলে গিয়েছে। দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনতে সরকার থেকে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যাদের পাসপোর্ট নেই বা কোনো ট্রাভেল ডকুমেন্ট নেই, তাদের কীভাবে নথিগুলো দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

ধারণা করা হচ্ছে, অবৈধভাবে অবস্থানরত -১০ লাখ বাংলাদেশীকে হয়তো এখনই বিতাড়ন করবে না সৌদি আরব সরকার। তবে তিন-পাঁচ বছরের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে দেশটি। সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ অনুযায়ী, দেশটির শ্রমবাজারের ৭০ শতাংশ পূরণ করা হবে স্থানীয় নাগরিকদের দিয়ে। এজন্য অন্যান্য দেশ থেকে আসা শ্রমিকদের ক্রমান্বয়ে ছাঁটাই করে নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এজন্য এরই মধ্যে বিদেশী নাগরিকদের জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূল করে তোলা শুরু করে দিয়েছে সৌদি সরকার। বিশেষ করে করের ক্ষেত্রে। সৌদি আরবে বিদেশী কর্মীদের পরিবারের অবস্থানের ওপর মাসিক চার্জ আরোপ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইকামার ফিও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে টিউশন ফি বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি করও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কারণে এরই মধ্যে ১১ মিসরীয়সহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা সৌদি আরব ছেড়ে চলে গিয়েছে। সৌদি ত্যাগের প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরো অনেক বিদেশী। তাদের বেশির ভাগই পেশাজীবী।

সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গিয়েছে, অবৈধ শ্রমিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে সৌদি পুলিশ। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের ১০ লাখের বেশি কর্মীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে হাজার ৬৩৫ জন এবং ফেব্রুয়ারিতে হাজার ৯৫৯ জন সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন। আর কভিড-১৯-এর জন্য ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার পর থেকে বিশেষ ফ্লাইটে সৌদি থেকে শ্রমিকরা ফিরতে শুরু করেন। চলতি বছর এপ্রিল থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন ৩৬ হাজার ৩৪০ জন। এর মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ শেষে আউট পাস নিয়ে ফিরেছেন হাজার ৯৯৯ জন। বাকিরা ফিরেছেন কর্মসংস্থান হারিয়ে। এর আগে ২০১৯ সালে সৌদি আরব থেকে একবারে ফিরে এসেছিলেন ২৫ হাজার ৭৮৯ জন বাংলাদেশী।

এদিকে আকস্মিকভাবেই ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশকে চাপ দেয়া শুরু করেছে সৌদি আরব। এসব রোহিঙ্গা ১৯৭৭ সালে সৌদি যাওয়া শুরু করে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে দেশটির তত্কালীন বাদশাহ তাদের সৌদি আরব নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেখানে তাদের সন্তানসন্ততিও জন্মগ্রহণ করে, যারা পুরোপুরি আরবিভাষী। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ বর্তমানে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, সেহেতু সুযোগ বুঝে আরো ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে সৌদি আরব।

বিষয়ে কূটনীতিকরা বলেন, এখন সৌদি আরবের সঙ্গে কোনো আলোচনা করতে গেলেই ৫৪ হাজার রোহিঙ্গার বিষয়টি জানতে চায় তারা। আমরা এরই মধ্যে পরিষ্কার করেছি, তাদের কাছে যদি বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকে বা কোনো সময়ে থেকে থাকে, তবে তাদের ট্রাভেল ডকুমেন্ট তৈরি করে বাংলাদেশ নিয়ে আসা হবে। কিন্তু এর বাইরে কাউকে আনবে না বাংলাদেশ। এছাড়া কাউকে বাংলাদেশী হিসেবে যদি চিহ্নিত করে, তবে যাচাই-বাছাই করে তাকে ফেরত নিয়ে আসবে বাংলাদেশ। সৌদি থেকে বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি তারাই দেখবে।

সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে গত রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, সৌদি আরবে আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আমাদের শত্রু রয়েছে। প্রবাসী সবচেয়ে বেশি হওয়ায় অন্যান্য দেশ আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করে। তবে এখন আমরা খুবই ভাগ্যবান। সৌদি আরব আগে চাইলে আমাদের সময় দিত না। এখন সহজেই সাক্ষাতের সময় দেয়। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন