কালজয়ী প্রতিষ্ঠান ব্রির সুবর্ণজয়ন্তী আজ

সাইদ শাহীন

একসময় অভাব আর দুর্ভিক্ষের জনপদ হিসেবেই পরিচিত ছিল অঞ্চল। সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে যখন সবকিছুই ভঙ্গুর, ঠিক এমনই এক প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালের অক্টোবর যাত্রা করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) প্রতিষ্ঠার পর থেমে থাকেনি প্রতিষ্ঠানটি। গত কয়েক দশকে কৃষি খাতে যে রূপান্তর ঘটেছে তার নেতৃত্বে ছিল ব্রি। পাঁচ দশকে শতাধিক ধানের জাত উদ্ভাবন করে অবদান রেখে চলেছে খাদ্যনিরাপত্তায়। কালজয়ী প্রতিষ্ঠানের ৫০ বছর পূর্তি আজ।

বাংলাদেশের ধানকেন্দ্রিক অর্থনীতি, খাদ্যনিরাপত্তা আর্থসামাজিক উন্নয়নের পরিবর্তনের মূল দাবিদার ব্রি। গত পাঁচ দশকে প্রতিষ্ঠানটি ১০৫টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে সাতটি জাত হাইব্রিড ৯৮টি ইনব্রিড জাত। জাতগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ঘাতসহিষ্ণু বা লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্নতাসহিষ্ণু জাত রয়েছে। এছাড়া উচ্চ প্রোটিন জিঙ্কসমৃদ্ধ এবং চাল রফতানি উপযোগী জাতও রয়েছে। পরিবর্তনশীল জলবায়ুর জন্য ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো মাঠ পর্যায়ে আবাদ করা হচ্ছে। দেশের মোট ধানি জমির প্রায় ৮০ ভাগেই ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধানের চাষাবাদ করা হয়। এছাড়া দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯১ ভাগই ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাত। এর পাশাপাশি স্থানীয় বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ধানের জাত রয়েছে।

কৃষিমন্ত্রী . মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত এবং খাদ্যশস্য বিশেষ করে দানাদার খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে ব্রি। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা টেকসই করতে হলে চাল উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। সেখানে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। এজন্য আমরা সব ধরনের গবেষণা সহায়তা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। দেশের মানুষের চালের চাহিদা দেশীয় জাতগুলোর প্রতি আরো সংরক্ষণশীল ভূমিকার মাধ্যমে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

ধানের জাত উদ্ভাবনের ইতিহাসটা অবশ্য আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ইরি) ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর সারা বিশ্বে নজর কেড়েছিল ইরি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধানের জাত আইআর৮। কৃষিতত্ত্ববিদ সুরজিৎ কুমার দে দত্ত (ভারতীয় বাঙালি, প্রকৃতপক্ষে নোয়াখালীর চৌমুহনী থেকে আসা) জাতের বিভিন্ন কৃষিতাত্ত্বিক পরীক্ষা কার্যক্রমে ধানের গড় ফলন পান হেক্টরে দশমিক টন। তখন ফিলিপিনো ধানের ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি মাত্র এক টন। ফলে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস সেই সময়ে নতুন উদ্ভাবিত জাতটির ব্যাপক প্রসারে উদ্যোগ নেন। উচ্চফলন দিতে সক্ষম জাতটি বাংলাদেশে আবাদের অনুমোদন মেলে ১৯৬৭ সালে। এরপর থেকেই ধানের জাত উদ্ভাবনে ইরির প্রতি নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। তবে সেই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয় ১৯৭০ সালের অক্টোবর ব্রি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। গত পাঁচ দশকে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা এনেছে ব্রি।

দেশের মোট আবাদি জমির ৭৭ দশমিক ১২ শতাংশ জমিতেই এখন ধানের আবাদ। হেক্টরপ্রতি চালের বৈশ্বিক গড় ফলন যেখানে দশমিক ৬১ টন, সেখানে বাংলাদেশের অর্জন প্রায় দশমিক ৬২ টন। তবে দেশের ফলন বৃদ্ধিতে আরো আশা জাগাচ্ছে ব্রি হাইব্রিড ধান৫। ব্রি উদ্ভাবিত জাতটি চলতি বছর মাঠ পর্যায়ে সর্বোচ্চ ফলন দিয়েছে ১২ টন। চাল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় সফলতার পেছনেও মূল দাবিদার ব্রি। নানা অর্জনের পরও প্রতিষ্ঠানটির সামনের দিনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শতাধিক জাত উদ্ভাবিত হলেও সব জাত মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না। মাত্র -১০টি জাতই আবাদ হচ্ছে মোট আবাদের ৬০ শতাংশ জমিতে। অনেক জাতের ক্ষেত্রে উচ্চফলন দিলেও সেগুলোর চালের মান ভোক্তার কাছে সন্তোষজনক হচ্ছে না। বীজ বিপণনে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়েও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। ফলে উদ্ভাবিত জাতগুলোর নানামুখী সম্প্রসারণ হচ্ছে না।

বিষয়ে ব্রির মহাপরিচালক . মো. শাহজাহান কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশে ধানের বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে চালের চাহিদা পূরণে কাজ করছে ব্রি। ভালো জাত উদ্ভাবনে ব্রি নেতৃত্ব দিলেও কৃষকের কাছে ভালো বীজ পৌঁছানোর একটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছি। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় আরো বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে ব্রি হাইব্রিড ধান৫ জাতটি কৃষকরাই যাতে উৎপাদন বিপণন করতে পারে, সেজন্য আমরা কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হচ্ছে। গত এক দশকের বেশি সময়ে চালের উৎপাদনে ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় এক ধরনের স্বস্তি এসেছে। সেটিকে আমরা সামনের দিনে আরো টেকসই করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। যেকোনো ঝুঁকি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের চালের চাহিদা উৎপাদন কী হতে পারে সে বিষয়ে ৫০ বছরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

ব্রির সংরক্ষণে রয়েছে ধানের আট হাজারের বেশি জিন। সেখান থেকে দেশের উপযোগী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব। তবে শুধু জাত উদ্ভাবনই নয়, জাতগুলো রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে পারে ব্রি। বিলুপ্তপ্রায় কাসালত বাংলাদেশী ধান হলেও ভারত এটির দাবি করে আসছিল। নেচার সাময়িকীর প্রতিবেদনে কাসালত ধানকে ভারতীয় বুনো ধান উল্লেখ করা হয়। তবে দেশের জিন বিজ্ঞানীর জোরালো ভূমিকার কারণে সেই ধানটিকে অবশেষে বাংলাদেশী ধান বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ইরি।

ব্রি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন দেয়ার রেকর্ড করেছে ব্রি হাইব্রিড ধান৫। হেক্টরে ১২ টন পর্যন্ত ফলন দিচ্ছে এটি। জাতটির মাধ্যমে বীজ উৎপাদন বিপণন করতে পারবেন কৃষক। ফলে হাইব্রিড বীজ প্যারেন্ট লাইন বীজ আমদানিতে শতাধিক কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। হাইব্রিড জাতগুলোর মধ্যে ব্রি হাইব্রিড১, , জাতগুলো বোরোতে আবাদ করা হয়। এছাড়া ব্রি হাইব্রিড৪ জাত দুটি আমনে আবাদ করা হয়। মাত্র কয়েকটি জাত সর্বোচ্চ আট-নয় টন পর্যন্ত ফলন দিলেও ব্রি হাইব্রিড ধান৫ এখন পর্যন্ত ১২ টনের বেশি ফলন দিচ্ছে। ২০১৬ সালে অবমুক্ত হওয়ার পর কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি, কৃষক, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে কৃষকের কাছে বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে।

ব্রির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাইব্রিড রাইস ডিভিশনের প্রধান . মো. জামিল হাসান বলেন, বিদেশী আমদানিনির্ভর জাতের চেয়ে বেশ ভালো ফলন দিচ্ছে হাইব্রিড ধান৫। জাতটি যেকোনো কৃষক নিবন্ধিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বীজ উৎপাদন করতে পারবে। সেক্ষেত্রে ব্রির বিজ্ঞানীরা বিনা মূল্যে বীজ কারিগরি সহায়তা দেবেন। কৃষক ভোক্তাদের কাছে জাতটি অধিক জনপ্রিয় করা সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ২০৭০ সাল নাগাদ দেশে ধানের উৎপাদনশীলতা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরা, লবণাক্ততা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন এবং কৃষকের কাছে তা পৌঁছাতে না পারলে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে বাধ্য বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক . জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা বিশেষ করে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশকে পরিবর্তন এনে দিয়েছে ব্রি। তবে গত কয়েক বছরে যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন সামনের দিনেও সেই সফলতা ধরে রাখবে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন এবং কৃষকের কাছে সেই জাত পৌঁছানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যে স্বনির্ভরতা ঠিক রাখতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনে উপযোগী জাত দ্রুত আনতে হবে। সেগুলো দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে। চালের স্বয়ম্ভরতাকে টেকসই করতে কম সময়ে ফলনযোগ্য ধানের জাত উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আবার ঘাতসহিষ্ণুতার বিষয়ে সঠিক পূর্বাভাস নিয়ে জাত উদ্ভাবনে নজর দিতে হবে।

প্রসঙ্গত, সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে ব্রিতে এসেছে একটি নতুন সুসংবাদ। সেখানে স্থাপন করা হবে বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে ট্রুডো এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি সেন্টার। গতকাল বিষয়ে বাংলাদেশ কানাডার মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন