বৈশ্বিক লকডাউন-পরবর্তী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশে ডালজাতীয় পণ্য আমদানি হয় কানাডা অস্ট্রেলিয়া থেকে। আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন, মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া থেকে আসে পাম অয়েল। চিনি ব্রাজিল এবং গম আমদানি হয় কানাডা ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ থেকে। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে চলতি বছরের মার্চ-মের পুরো সময়টা লকডাউন ছিল এসব দেশে। সময় দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানিতে বুকিং কমিয়ে দেন ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকরা, যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে লকডাউন-পরবর্তী ভোগ্যপণ্যের বাজারে। ১৫ দিন ধরে পাইকারি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্যতেল, চিনি, গম ডালজাতীয় পণ্যের দাম।

দেশে গড়ে প্রতি বছর ১৫ থেকে ১৮ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। তবে কোরবানি রোজার ঈদের সময় মাসভিত্তিক গড় চাহিদার দ্বিগুণ ভোজ্যতেল বেচাকেনা হয়। কিন্তু বছর লকডাউনের কারণে বিশ্ববাজার থেকে পণ্যটি আমদানিতে বেগ পেতে হয় ব্যবসায়ীদের। এছাড়া লকডাউন চলাকালে শ্রমিক সংকটে পাম অয়েলের প্রধান দুটি রফতানিকারক দেশ মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়ায় ভোজ্যতেলটির উৎপাদন কমে যায়। ফলে দেশে পণ্যটির আমদানিও কম হয়েছে সময়।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে লাখ ৪৯ হাজার ২৯৩ টন পাম অয়েল আমদানি হয়েছিল। বছর একই সময়ে আমদানি হয় মাত্র লাখ ২৮ হাজার ৭৭৫ টন। ফলে দেখা দেয় বাজারে সরবরাহ সংকট, যার প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে ভোজ্যতেলের বাজার। ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশের পাইকারি বাজারে প্রতি মণ পাম অয়েল হাজার থেকে হাজার ১০০ টাকার মধ্যে লেনদেন হলেও চলতি মাসে দাম হাজার ১২০ টাকায় গিয়ে ঠেকে।

শুধু ভোজ্যতেল নয়, এলসি খোলা, জাহাজীকরণে সমস্যা দেখা দেয়ায় বৈশ্বিক লকডাউনের সময় গম, চিনি ডালজাতীয় পণ্যের বুকিং কমিয়ে দিয়েছিলেন দেশের আমদানিকারকরা। কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জুন, জুলাই আগস্টে এসব পণ্যের আমদানি ঋণাত্মক হয়েছে। ফলে মাসভিত্তিক ভোগ্যপণ্য আমদানি সরবরাহ চ্যানেলে ছেদ পড়ে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে সবচেয়ে বেশি চিনি আমদানি হয় ব্রাজিল থেকে। করোনা সংক্রমণে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল দেশটি, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের চিনি আমদানিতে। চলতি বছরের জুনে দেশে চিনি আমদানি হয় প্রায় ৬১ হাজার ২৪৬ টন। পরবর্তী সময়ে জুলাইয়ে আমদানি অস্বাভাবিক কমে হয় ১১ হাজার ১০ টন। আর আগস্টে আমদানি হয়েছে ২৮ হাজার ৩৮৫ টন।

আমদানি কমে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে বড় পরিবর্তন হয়েছে চিনির বাজারে। দুই সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতি মণ চিনি বিক্রি হয়েছে হাজার টাকার নিচে। কিন্তু মণপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এক সপ্তাহ ধরে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চিনি বিক্রি হচ্ছে হাজার ৮০ থেকে হাজার ১০০ টাকার মধ্যে।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি না হলেও যেকোনো পণ্যের কয়েক মাসের মজুদ থাকে দেশে। কিন্তু নিয়মিত সরবরাহ প্রক্রিয়া থেকে আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেলে সেটির প্রভাব বাজারে পড়বেই। বাংলাদেশে বর্তমানে চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ চেইনে কিছুটা সংকট আছে।

ভোগ্যপণ্যের বড় আমদানিকারক চট্টগ্রামের এমএইচ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, করোনাকালীন সারা বিশ্বে লকডাউন শুরু হলে প্রায় দুই-তিন মাস পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউন-পরবর্তী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের বর্তমান বাজারে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে অল্পদিনের মধ্যে পণ্যের দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী।

এপ্রিলে মসুর ডাল আমদানি হয়েছিল ৫৮ হাজার ৪৮৫ টন। কিন্তু জুলাই আগস্টে পণ্যটির আমদানি কমে হয়েছে যথাক্রমে ৪৬ হাজার ৪১০ ২৯ হাজার ৯৩৭ টন। এপ্রিলে মটর ডাল (ডাবলি) আমদানি হয়েছিল ৯৬ হাজার ৯৭ টন। জুলাই আগস্টে আমদানি কমে হয়েছে যথাক্রমে ৪৪ হাজার ৯৭১ ৪৯ হাজার ৯৯৫ টন। এপ্রিলে দেশে ৪৯ হাজার ৭৭ টন ছোলা আমদানি হলেও পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিক কমে জুনে হাজার ৮১৫ টন, জুলাইয়ে হাজার ৪৮৫ আগস্টে আমদানি হয়েছে মাত্র ৬৫৩ টন ছোলা আমদানি হয়। এদিকে এপ্রিলে দেশে হাজার ৭৯১ টন মুগডাল আমদানি হলেও জুনে আমদানি হয়েছে হাজার ৬৮০ টন, জুলাইয়ে হাজার ১০১ আগস্টে আমদানি কমে হয়েছে হাজার ৪৩৯ টন।

আমদানি কম হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে এসব নিত্যপণ্যের বাজারদরে। বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানীকৃত ছোলা বিক্রি হচ্ছে হাজার ৩৫০ টাকা দরে। দুই সপ্তাহ আগেও বাজারে একই মানের ছোলা বিক্রি হয়েছে হাজার ১৫০ থেকে হাজার ২০০ টাকায়। সেই হিসেবে গত দুই সপ্তাহে প্রতি মণ ছোলার দাম ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দুই সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতি কেজি মটর (সাদা মটর) বিক্রি হতো ২৪ টাকা দরে। কেজিতে টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে একই মটর ২৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে কেজিতে টাকা পর্যন্ত বেড়েছে অস্ট্রেলিয়া কানাডা থেকে আমদানীকৃত মসুর ডালের দাম। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মোটা মসুর বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬১ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগেও বাজারে মোটা মসুর বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৬ টাকা দরে।

গত দুই সপ্তাহে কেজিপ্রতি ১০-১২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে মুগ ডালের দামও। ১৫ দিন আগে বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি মুগডাল বিক্রি হতো ৯০-১০৫ টাকার মধ্যে। বর্তমানে বিভিন্ন মানের এসব মুগ ডাল এখন কেজিপ্রতি ৯৮-১২২ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে ভোজ্যতেলের। এক সপ্তাহ ধরে পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ পাম অয়েল হাজার ১০০ টাকার কাছাকাছি অবস্থান করছে। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও বাজারে একই মানের পাম অয়েল হাজার ৫০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে মাত্র এক সপ্তাহেই প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন