বিশ্ব প্রবীণ দিবস

সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে হবে

ড. মো. জসীম উদ্দিন

আজ অক্টোবর, ২০২০। বৈশ্বিক মহামারীর বার্তা প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা’— প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে বিশ্ব প্রবীণ দিবস-২০২০ উদযাপিত হচ্ছে। প্রবীণদের অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক বৈশ্বিক মহামারী থেকে তাদের সুরক্ষার লক্ষ্যে অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও দিবসটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে।

ইদানীং বিশ্বব্যাপী প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা বর্তমানে সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির একটি মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ক্রমান্বয়ে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৫ সালে বিশ্বে ৬০ বছরের বেশি মানুষের সংখ্যা ছিল মোট ৯০১ মিলিয়ন, যা ২০৩০ সালে বেড়ে হবে দশমিক বিলিয়ন (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৬. ভাগ) এই বর্ধিত প্রবীণ জনসংখ্যার প্রায় ৬৭ শতাংশ হবেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিবাসী। আগামী ২০৫০ সালে প্রবীণ জনসংখ্যা বেড়ে দুই বিলিয়নে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ২১ দশমিক ভাগ। বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড উপভোগ করছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬২ ভাগ কর্মক্ষম যুবক, যা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই সুবিধা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ভোগ করতে পারবে এবং এর পর থেকে কর্মক্ষম যুবকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। ফলে আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩-এর তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, ২০১১ সালে আমাদের দেশে প্রবীণের সংখ্যা ছিল মাত্র ১১ দশমিক মিলিয়ন, যা বর্তমানে প্রতি বছর শতকরা দশমিক ৪১ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার - শতাংশ প্রবীণ হিসেবে গণনা করা হচ্ছে। কারণে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে সুস্থ কর্মক্ষম রাখাসহ সামাজিক অধিকার নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য নেদারল্যান্ডসের মতো উন্নত দেশে প্রবীণদের জন্য বিশেষায়িত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে ভৌগোলিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সেসব দেশের গৃহীত কার্যক্রমের সঙ্গে আমাদের দেশের কার্যক্রম মানানসই হবে না। সেক্ষেত্রে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বাস্তবায়িত কিছু কর্মসূচি সংগতিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

ভিয়েতনাম সরকার উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ২০১২ থেকে ২০২০ সালের জন্য ভিয়েতনাম জাতীয় অ্যাকশন কার্যক্রম, ২০১৭-২০২৫ সময়কালীন প্রবীণ স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প-সহ প্রবীণদের জন্যস্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এছাড়া দেশটির প্রায় ১৫ লাখ প্রবীণকে বয়স, শারীরিক অবস্থা আর্থিক সংগতির ওপর ভিত্তি করে মাসিক থেকে ১৮ মার্কিন ডলার করে সামাজিক পেনশন ভাতা দিচ্ছে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের কল্যাণের স্বার্থে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ সহজলভ্য করে তোলা। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রবীণদের একীভূত পদ্ধতিতে প্রতিরোধমূলক, নিরাময়মূলক পুনর্বাসিত সেবা প্রদান করা। লক্ষ্যে প্রবীণদের জন্য ভারতে একটি জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা প্রণয়ন প্রবীণ নাগরিক আইন পাস করার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ওই নীতিমালা আইনের আওতায় প্রবীণদের সহায়তার জন্য ভারতে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতীয় পেনশন স্কিম, বয়স্কদের জন্য সমন্বিত কার্যক্রম, বয়স্কদের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় বয়স্ক পেনশন স্কিম, অন্নপূর্ণা স্কিম, পিতা-মাতার কল্যাণ আইন ইত্যাদি।

মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার শতাংশই বয়োজ্যেষ্ঠ এবং ধারণা করা হয়, ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর ১৫ শতাংশই হবেন প্রবীণ। দেশটির সরকার প্রবীণদের জন্য প্রথম নীতিমালা প্রণয়ন করে ১৯৯৫ সালে। নতুন করে প্রবীণদের জন্য আরেকটি নীতিমালা অনুমোদিত হয় ২০১১ সালে। নীতিমালাটির উদ্দেশ্য হলো, ব্যক্তি, পরিবার সম্প্রদায় পর্যায়ে প্রবীণ ব্যক্তিদের বন্ধুত্বপূর্ণ পরিষেবা প্রদান এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। এছাড়া সিঙ্গাপুর ফিলিপাইনের মতো বেশকিছু দেশ প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করে অনেক প্রবীণকেন্দ্র গড়ে তুলেছে।

বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সমস্যাবলির মধ্যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অতীতে প্রবীণরা যৌথ পরিবারে সবার আদর-যত্ন নিয়ে বসবাস করতেন। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় তারা একান্নবর্তী পরিবারে বসবাসের সুযোগ হারাচ্ছেন। পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের স্রোতে প্রবীণরা নিজ পরিবারে অভাব-অনাদরে দিনাতিপাত করে আসছেন। ফলে সক্ষমতা সম্মান হারিয়ে তারা সমাজের বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এসব কারণে প্রবীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে, যা আগামীতে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের নির্ভরশীলতার হার বর্তমানে শতকরা দশমিক ভাগ, যা ২০৫০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে শতকরা ২৩ দশমিক ভাগে। সুতরাং সমাজের এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার উপায় নেই। তাই বর্তমানে প্রবীণদের আর্থসামাজিক স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার প্রবীণদের কল্যাণে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রবীণদের নানা সমস্যার কথা বিবেচনা করে আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৫ নং অনুচ্ছেদে প্রবীণদের অধিকারের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করেন। ওই বছরে বয়স্ক ভাতা বাবদ বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক কোটি টাকা এবং মোট ৪০ হাজার ৩১১ জন প্রবীণকে ভাতা দেয়া হয়। বর্তমানে ৪৪ লাখ প্রবীণকে বয়স্ক ভাতার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে এবং গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুধু বয়স্ক ভাতা বাবদ সরকারের বরাদ্দ ছিল হাজার ৬২০ কোটি টাকা। করোনাকালীন প্রবীণদের দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান সরকার আরো ১১২টি উপজেলায় লাখ প্রবীণের জন্য ৩০০ কোটি টাকা বয়স্ক-ভাতা প্রদানের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। ভাতার উদ্দেশ্য হলো, প্রবীণদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং পরিবার সমাজে প্রবীণদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি সরকার বয়স্কদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করেছে। এছাড়া জারীকৃত পিতা-মাতার সেবা আইন ২০১৩ অনুযায়ী সন্তানকে অবশ্যই অন্তত তিন বছরের জন্য মা-বাবার সেবা করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ওই আইনের আওতায় মা-বাবাকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু আইন এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরে প্রবীণদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রবীণদের জন্য সরকারের উদ্যোগগুলো যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। সরকারের উদ্যোগের বাইরেও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রবীণদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে।

২০১৬ সালে পিকেএসএফ রাঙিয়ে দিয়ে যাও’—স্লোগান সামনে রেখে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। বর্তমানে কর্মসূচিটি সারা দেশে ২১৮টি ইউনিয়নে দশমিক শূন্য লাখ প্রবীণকে সংগঠিত করে তাদের বিভিন্ন সুবিধা সেবা প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। প্রবীণদের বিনোদনের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে সামাজিক কেন্দ্র স্থাপন, স্বাস্থ্যসেবা, পরিপোষক ভাতা (বয়স্ক ভাতা) প্রদান, বিভিন্ন জীবন-সহায়ক সামগ্রী প্রদান, বয়োজ্যেষ্ঠ প্রবীণ শ্রেষ্ঠ সন্তান সম্মাননা প্রদান এবং নিঃস্ব প্রবীণকে নিজ ভূমে নিবাসনের ব্যবস্থাকরণসহ সক্ষম প্রবীণদের আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। প্রবীণদের অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির জন্য মাঠ পর্যায়ে প্রবীণ দিবস উদযাপনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে। পিকেএসএফের উদ্যোগে প্রবীণদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রবীণ অধিকার মঞ্চ, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ডিমেনশিয়া ফ্রেন্ডস কমিটি শীর্ষক জাতীয় পর্যায়ে দুটি প্লাটফর্ম গঠিত হয়েছে।

কভিড-১৯ মহামারীর সময় বিভিন্ন স্ট্যাটিক ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসকদের দ্বারা প্রবীণদের বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিদর্শক চিকিৎসকরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা/পরিষেবা প্রদান করে আসছে। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল সুর হচ্ছে কাউকে বাদ দিয়ে নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া, পিছিয়ে থাকা এবং পিছিয়ে রাখা প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জন সম্ভব নয়। এজন্য আমরা যে যেখানে রয়েছি, যে অবস্থানে রয়েছি, সেখান থেকে সবাইকেই অসচ্ছল প্রবীণদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা এমন একটি সমাজ প্রত্যাশা করছি, যেখানে প্রবীণ জনগোষ্ঠী সব ধরনের অনাচার, অত্যাচার হিংস তা থেকে মুক্তি পাবে। তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকবে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। নিশ্চিত হবে তাদের মানবমর্যাদা।

বিশ্ব প্রবীণ দিবস-২০২০ উপলক্ষে সব প্রবীণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হোক তারা সবাই ভালো থাকুন এবং তাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের সমাজ আরো আলোকিত হোক প্রত্যাশা আমাদের সবার।

 

. মো. জসীম উদ্দিন: উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, পিকেএসএফ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন