উচ্চশিক্ষায় উপেক্ষিত মান নিয়ন্ত্রণ

সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইকিউএসি প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে ইউজিসিকে

বিশ্বের সর্বত্রই ফলপ্রসূ উচ্চশিক্ষার মানের নিশ্চয়তা গুণগত উল্লম্ফনের জন্য কার্যকর প্রক্রিয়ার উন্নয়ন এর উপযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি দেশ এবং এর বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকরা নিজস্ব স্থানীয় জাতীয় চাহিদার সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা মানদণ্ডের ভিত্তিতে আবর্তিত একটি পরিবেশে প্রতিযোগিতা করছে। বিশেষ করে পারস্পরিকভাবে আন্তঃসংযুক্ত আজকের বিশ্বায়িত দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক মান পরিপূরণের আবশ্যকতা ক্রম ঊর্ধ্বমুখী। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাস করা স্নাতকদের সাফল্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ওই সব মানদণ্ড দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। নিজস্ব উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন নিশ্চিত এবং স্বতন্ত্র ইতিহাস, চাহিদা প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযুক্ত মানদণ্ড নির্ধারণের জন্য প্রেক্ষাপটে শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক ফ্যাকাল্টি সদস্যদের বরাবরই পরামর্শ দেয়া হয়। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল (আইকিউএসি) উনিশ শতকের গোড়ায় প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে প্রবর্তিত ব্যবস্থাটি অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশ নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমের মান নিশ্চিত করছে। উন্নত দেশগুলো দূরে থাক, সময়ের ধারাবাহিকতায় প্রতিবেশী ভারতসহ দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই বর্তমানে আইকিউএসি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে চিত্রটি অনেকটাই ভিন্ন। বর্তমানে দেশে সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫৩টি হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৬৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ই আইকিউএসি প্রতিষ্ঠা করেছে। বলা চলে, বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকে ব্যাপারে বারবার তাগাদা দেয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। এটা উচ্চশিক্ষায় মান যথাযথ গুরুত্ব না পাওয়ারই প্রতিফলন। দেশের অভ্যন্তরে   বহির্বিশ্বে দক্ষ গুণগত মানের মানবসম্পদ জোগাতে হলে শিক্ষার মানে জোর দেয়ার বিকল্প নেই। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের আরো উদ্যোগী ভূমিকা কাম্য।

সত্য যে বিগত দুই দশকে দেশে উচ্চশিক্ষায় সংখ্যা অবকাঠামোগত উল্লম্ফন ঘটেছে বিস্তর। তবে মান ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। নিয়মিত বিরতিতে তারই প্রকাশ ঘটছে বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হতাশাজনক অবস্থানে। শুধু বিশ্বখ্যাত যুক্তরাজ্যভিত্তিক কিউএস জরিপ নয়; সাংহাই, স্কপাস টাইমসের মতো অন্য স্বীকৃত বৈশ্বিক র্যাংকিংয়েও বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এর পেছনে গবেষণা প্রাধিকার না পাওয়া, প্রযুক্তিগত উত্কর্ষের ঘাটতি, শিক্ষায় অপ্রতুল বিনিয়োগ, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বিস্তারের মতো কিছু অন্তর্নিহিত ফ্যাক্টর তো আছে বটে, তার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সব প্রতিষ্ঠানে আইকিউএসি না থাকাও নিশ্চয়ই একটি বড় কারণ। কেননা আইকিউএসির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু নিয়ম-নীতি অনুসরণের পাশাপাশি শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা প্রাক্তনদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে তা নিরীক্ষা করা হয় এবং চূড়ান্তভাবে মানোন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যার ভিত্তিতে মান নিয়ন্ত্রণের কাজটি করা হয়। কাজেই উচ্চশিক্ষার উত্কর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি কার্যকর আইকিউএসির গুরুত্ব কতখানি, তা সহজেই অনুমেয়। বারবার নির্দেশনা দেয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন নিজস্ব মান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখতে হবে ইউজিসিকে। প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বৈশ্বিক র্যাংকিংগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ভারতসহ আমাদের অদূরবর্তী দেশগুলোর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় উপর্যুপরিভাবে ভালো করছে। উল্লিখিত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী ধরনের পাঠক্রম অনুসরণ করছে এবং মান নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলেছে, তা বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। কিংবা সেখানকার আইকিউএসিগুলো কীভাবে কাজ করছে, তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে।

পুরো বিশ্ব এখন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে ধাবমান। নতুন রূপান্তরযাত্রায় আনীত পরিবর্তনগুলো অধিকাংশ পেশাতেই উচ্চদক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা সৃষ্টি করেছে। অভিযোজনক্ষমতা, দলভিত্তিক কাজ, যোগাযোগ দক্ষতা এবং অব্যাহত শেখার উদ্দীপনার মতো যোগ্যতাগুলো ক্রমেই পেশাগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবে নিজস্ব অর্থনীতিকে নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ায় আগ্রহী দেশগুলো শিক্ষা-আধার শিক্ষাদান পদ্ধতির মান উন্নীতকরণে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। উচ্চশিক্ষায় মানোন্নয়ন ছাড়া কোনো দেশেরই বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ পেশাজীবী জোগানো সম্ভব নয়। এখন যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে। বাজারের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগহীনতা এবং যথাযথ মানের অভাবে আমাদের শিল্প খাতে বিশেষত উচ্চ মাঝারি পর্যায়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা স্নাতকদের নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। অনেকটা বাধ্য হয়ে নিয়োগকর্তারা ভারতীয় শ্রীলংকার নাগরিকদের এক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এটি একটি  উদাহরণ মাত্র। অন্য খাতগুলোও নিশ্চয়ই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি। এর আশু সমাধান জরুরি। বাজারের জন্য দক্ষ জনশক্তির জোগান নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই পাঠক্রমে পরিবর্তনের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্রগুলোয় মান নিয়ন্ত্রণের একটি জুতসই প্রক্রিয়া-পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কর্তৃপক্ষের এদিকটায় বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।

নিছকই সাদামাটা পাঠদান সনদ প্রদানের কেন্দ্র হিসেবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিবেচনার দিন শেষ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির চালক। কাজেই একটি একীভূত বিশ্ব ব্যবস্থার বাস্তবতায় যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত এবং নিজেদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখতে উচ্চশিক্ষার মানে আপসের সুযোগ নেই। এটা বাংলাদেশের জন্যও সমানভাবে সত্য। বিগত বছরগুলোয়  শিক্ষায় অবকাঠামোগত সম্প্রসারণ অনেক হয়েছে, এখন মানে জোর দেয়ার সময়। নীতিনির্ধারক, কর্তৃপক্ষ শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের প্রয়াসে উচ্চশিক্ষার মানে লক্ষণীয় উন্নতি ঘটবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন