তিউনিসিয়ায় খাবারের মেন্যুতে হাঙ্গরের মাংস, হুমকির মুখে প্রজাতি

বণিক বার্তা অনলাইন

তিউনিসিয়ার মোনাস্তির শহরের মাছের বাজারে ঢুকতে নাকে ধাক্কা দেবে বোঁটকা গন্ধ। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে দোকানিরা পসরা গুটিয়ে চলে যায়। তখন মেঝেতে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে হাঙ্গরের বিচ্ছিন্ন কাটা মাথা। চোখে পড়বে মাংস ছাড়িয়ে নেয়ার পর ফেলে দেয়া গিটারফিসের উচ্ছিষ্ট। 

তিউনিসিয়ার হাঙ্গর যেমন সুন্দর তেমন বৈচিত্র্যময়। বছর দুই আগে লিবিয়ার সীমান্তবর্তী জার্জিস থেকে ৬৮০ কেজি ওজনের যে বিশালাকৃতির সাদা হাঙ্গরটি (গ্রেট হোয়াইট শার্ক) ধরা পড়েছিল, তেমন ধরনের হাঙ্গর থেকে শুরু করে ছোট আকৃতির ডগফিশ (হাঙ্গরের একটি প্রজাতি) —এরা সমুদ্রের তলদেশে থেকে কাঁকড়া, চিংড়ি ও লবস্টার শিকার করে খায়— বিভিন্ন ধরনের হাঙ্গর রয়েছে এখানে। তিউনিসিয়ার সুষম সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র অটুট রাখার ক্ষেত্রে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে লিবিয়ার পরে তিউনিসিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি হাঙ্গর শিকার করা হয়।

তিউনিসিয়ার পরিবেশবাদীরা মনে করেন, অতিরিক্ত হাঙ্গর শিকারের ফলে অন্যান্য মাছের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দেশটির সমুদ্রসীমায় প্রায় ৬৩ ধরনের হাঙ্গর ও রে জাতীয় মাছ রয়েছে। এদের মধ্যে ২৪টি-ই বিপন্ন প্রজাতির। তাছাড়া গিটারফিসের দেখা পাওয়া যায় শুধু তিউনিসিয়ার সমুদ্রসীমাতেই।

কিন্তু কর্তৃপক্ষের অমনোযোগ, সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা, জেলেদের সচেতনতার অভাব এবং মাছের উৎস সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ার কারণে মাছধরার নৌকাগুলোর মধ্যে চলমান ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা দেশটির গুরুত্বপূর্ণ মত্স্য প্রজাতির টিকে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও গ্রেট হোয়াইট শার্কসহ তিউনিসিয়ায় হাঙ্গর শিকারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আছে ফিশিং গার্ডদের জানানোর বাধ্যবাধকতাও। কিন্তু জেলে থেকে শুরু করে গার্ডদের কেউই হাঙ্গরের  প্রজাতিগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে জানে না। কারণ এদের কাউকেই সরকার বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। 

জেলেদের জালে প্রায়ই হাঙ্গর ধরা পড়ে। নৌকার ওপরে যতক্ষণে এদেরকে তোলা হয় ততক্ষণে এরা মারা যায়। এছাড়া হাঙ্গরের অন্য প্রজাতিগুলোকে জেলেরা তাদের লক্ষ্য করেই শিকার করছে। পানি থেকে নৌকায় তোলার সঙ্গে সঙ্গেই এদের পেট কেটে নাড়িভুঁড়িগুলো সমুদ্রেই ফেলে দেয়া হয়, গোটা প্রক্রিয়া শেষে হাঙ্গরগুলোকে তাই আর আলাদা করে চিহ্নিত করার উপায় থাকে না। তাছাড়া জেলে থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা প্রচলিত যে সব হাঙ্গরই মানুষখেকো। 

এ অবস্থায় তিউনিসিয়ার উত্তরাঞ্চলে হাঙ্গরের মাংসের চাহিদা বেড়ে যাওয়াতে দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৪ দিনার করে (এক পাউন্ড সমপরিমাণ), কেজিতে বেড়েছে ১২ থেকে ১৩ দিনার। মোনাস্তিরের মতো বাজারগুলোতে হাঙ্গরের মাংস সোর্ড ফিশ (এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ) হিসাবে বিক্রি হয়। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (ডব্লিউডব্লিউএফ) মনে করে, তিউনিসিয়ার কমপক্ষে ৩৫ জন জেলে আছে যারা শুধুই হাঙ্গর শিকার করেন। 

করোনা মহামারীতে তিউনিসিয়ার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর মহামারীর কারণে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকোচানের মধ্যে পড়েছে দেশটি। এ অবস্থায় নিজস্ব সামুদ্রিক মাছের এ প্রজাতিগুলো রক্ষার বিষয়টি তিউনিসিয়ার সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে কিনা তা অস্পষ্ট। গার্ডিয়ানের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে তিউনিসিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয়ে ফোন, মেইল করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।  

তবে সত্যিটা হচ্ছে, জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনেই এসব জেলে বিপন্নপ্রায় প্রজাতির হাঙ্গরগুলোকে রক্ষা করতে তেমন একটা আগ্রহী নয়। যেমন উত্তর তাবার্কার জেলে ইমেদ ত্রিকি প্রতিদিন তার ছোট নৌকা নিয়ে সমুদ্রে যান, জালে যে মাছ-ই ওঠে তাই-ই নৌকায় তোলেন। এভাবেই জীবিকার সংস্থান হয় তার। যদিও এ দিয়ে অল্প পরিমান অর্থের সংস্থান হয়। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে হাঙ্গরের মাংস বিক্রি করে তা দিয়ে তার নৌকা ও জাল রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কোনোরকমে উঠে যায়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে হাঙ্গর বা অন্য বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছ শিকার না করার গুরুত্ব নিয়ে কেউ কখনও তার সঙ্গে কথা বলতে আসেনি।  ফেসবুক ও কিছু সংস্থার মাধ্যমে এ বিষয় সম্পর্কে কিছুটা শুনেছে শুধু। 

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন