বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নে জট

আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় সাড়ে ৫ হাজার হাসপাতাল

তবিবুর রহমান

২৩ আগস্টের মধ্যে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নিবন্ধন লাইসেন্স নবায়নের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই সময়ের পর পেরিয়েছে এক মাসেরও বেশি সময়। যদিও নিবন্ধন লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদনকারী হাসপাতালগুলোর মধ্যে সোয়া তিন হাজারের বেশিসংখ্যক হাসপাতালের নথি যাচাইয়ের কাজই শেষ হয়নি এখনো। এছাড়া পরিদর্শনের অপেক্ষায় রয়েছে সোয়া দুই হাজারের মতো হাসপাতাল। শেষ হয়নি অনিবন্ধিত অবৈধ হাসপাতালের তালিকাও। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স নবায়ন কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতার পেছনে মূলত অধিদপ্তরের জনবল সংকটকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সেবার পরিবর্তে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থের ভিত্তিতে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের তদারকির অভাবে এসব হাসপাতালের বড় একটি অংশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হয়ে আসছিল। এসব হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে যেমন অভিযোগ রয়েছে, তেমনি অভিযোগ রয়েছে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণারও। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লাইসেন্স নবায়নের মাধ্যমে অভিযুক্ত বেসরকারি হাসপাতালের কার্যক্রমে লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এজন্য একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন গ্রহণ লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করে ১৩ হাজারেরও বেশি বেসরকারি হাসপাতাল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ১৭ হাজার ২৪৪। এর মধ্যে নিবন্ধন লাইসেন্স নবায়নের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছে প্রায় ১৩ হাজার হাসপাতাল। এর মধ্যে হাজার ৫১৯টি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। এর বাইরে মোট অপেক্ষমাণ আবেদনের সংখ্যা হাজার ৪৪১। এর মধ্যে শুধু নথি যাচাইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে হাজার ৩০০টি হাসপাতাল। পরিদর্শনের অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় দুই হাজার হাসপাতাল। যাচাই-বাছাইয়ের পর কিছু কাগজপত্রে সমস্যা চিহ্নিত হওয়ায় অপেক্ষমাণ অবস্থায় রয়েছে হাজার ১৮১টি আবেদন। এছাড়া নিবন্ধনের আবেদন করেনি এমন বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি। অবৈধ এসব হাসপাতালের তালিকায় পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি আবেদন বা নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে এখনো চার হাজারের অধিক হাসপাতাল। তবে এখনো অবৈধ হাসপাতালের তালিকা তৈরি হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন নিবন্ধন জটিলতা নিরসনসহ সেবার মান বৃদ্ধি অনিয়ম বন্ধে গত ২৬ জুলাই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) মো. মোস্তফা কামালকে আহ্বায়ক করে নয় সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে সারা দেশের হাসপাতালে সেবার মান পর্যবেক্ষণে দায়িত্ব দেয়া হয় ৪৫ কর্মকর্তাকে। গত আগস্ট টাস্কফোর্স কমিটির সভায় বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন নিবন্ধনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভা শেষে ২৩ আগস্টের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন বা নিবন্ধন নিতে সময় বেঁধে দেয়া হয়। একই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লাইসেন্স নিবন্ধন নিতে ব্যর্থ হাসপাতালগুলোকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লাইসেন্স নবায়ন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার বিষয়ে তোড়জোড় শুরু করেন বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) মো. মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, টাস্কফোর্সের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে যারা আবেদন করেছে, তাদের কাজ চলমান রয়েছে। যেহেতু কাজটি প্রক্রিয়াধীন আর একবারে অনেক আবেদন জমা পড়ার কারণে কিছুটা সময় লাগছে। তবে যারা আবেদন করেছে, তাদের কাগজপত্র ঠিক থাকলে লাইসেন্স পেতে কোনো সমস্যা হবে না। তবে যারা আবেদন করতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠান অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো যেকোনো সময়ে বন্ধ করে দেয়া হবে।

জনবল সংকট এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের মধ্যে কাজের সমন্বয়হীনতার কারণে নিবন্ধন নবায়ন জট তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের। এছাড়া অনলাইনে নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়েও অভিযোগ রয়েছে তাদের। তারা বলছেন, অনলাইনে দুই বছর আগে আবেদন করা অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেনি। একই সঙ্গে লাইসেন্স পেতে অপরিহার্য পরিবেশগত ছাড়পত্র ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রেও নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

বেসরকারি ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক মালিক সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো আবেদন করেনি বা নিবন্ধন নেই, সেগুলো বন্ধ হোক এটা আমরাও চাই। তবে যারা আবেদন করেছে, তাদের লাইসেন্স দ্রুত দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক।

মূলত জনবল সংকটের কারণে নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে দাবি করলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সারা দেশে ১৭ হাজারেরও বেশি হাসপাতাল, ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এগুলো দেখাশোনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখায় কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র ১১ জন। জনবল সংকটের কারণে অনেক কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। এমন অনেক হাসপাতাল রয়েছে, যারা নিবন্ধনের জন্য একাধিক আবেদন করেছে। এটা যাচাই-বাছাইয়েও অনেক সময় যাচ্ছে।

জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল বিভাগের পরিচালক ফরিদ হোসেন মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, টাস্কফোর্সের হুঁশিয়ারির পর বেসরকারি হাসপাতালগুলো লাইসেন্স নবায়নে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ১৭ হাজার আবেদনের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার লাইসেন্স নবায়ন নিবন্ধন করা সম্ভব হয়েছে। তবে কাজ দ্রুত করার জন্য যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন, সে পরিমাণ জনবল শাখায় নেই। গত এক মাসে অনেক কাজের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ হাসপাতালের তালিকা তৈরির কাজও চলছে। বিভাগীয় জেলা পর্যায়ের সিভিল সার্জন বিভাগীয় পরিচালকদের চিঠি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ হাসপাতাল ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন