কৃষিতে শস্য নিবিড়তা গুরুত্বপূর্ণ। জমিতে এক বছরে কয়টি ফসল উৎপাদন করা হয়, শস্য নিবিড়তা তা নির্দেশ করে। আমরা জানি, সেচ সুবিধাসহ আধুনিক কৃষি উপকরণের অপ্রতুলতা, ফসলের ন্যায্যমূল্য, অকৃষি খাতে উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কারণে দেশের জমিতে শস্য নিবিড়তা আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাছাড়া খরাপ্রবণ এলাকাসহ যেসব এলাকায় পানি সেচের ব্যবস্থা বৃষ্টি বা ভূ-উপরস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল, সেসব স্থানে শস্য নিবিড়তা তুলনামূলক কম। এমন বাস্তবতায় গতকাল বণিক বার্তায় ‘সেচ ব্যবস্থায় অবহেলিত হলেও শস্য নিবিড়তায় সবার ওপরে রংপুর’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি রংপুরে সেচ সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি খাতের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের তাগিদ দেয়। উল্লেখ্য, সেচ সুবিধার অপর্যাপ্ততার মধ্যেও রংপুরে শস্য নিবিড়তা ২২০ শতাংশ; কারণ সেখানকার কৃষকরা জমিতে বছরে গড়ে দুটি শস্য উৎপাদন করছেন। এ অবস্থায় সেখানে আবাদযোগ্য জমিতে পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা পৌঁছানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সেচ সুবিধা বাড়ানো গেলে রংপুর অঞ্চলে শস্য নিবিড়তা আরো বাড়ানো সম্ভব হবে।
চীন তাদের উত্তর-পশ্চিম শুষ্ক অঞ্চলগুলোয় সুপার হাই প্লান্ট ডেনসিটি টেকনিক ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়েছে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে উন্নত ও আধুনিক সেচ পদ্ধতির প্রবর্তন করে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশে জমির উর্বরা শক্তি ও জলবায়ুগত কারণে শস্যের বহুমুখীকরণের সুযোগ রয়েছে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা ও নীতি উদ্যোগের প্রয়োজন। শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের উপযোগী ও আধুনিক সেচ সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি সব ধরনের উপকরণ, বিশেষ করে বিদ্যুৎ, বীজ, অর্থায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা বাড়ানো জরুরি। যদিও মাটির নিচে পানির স্তর কমে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় সরকারিভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন প্রায় বন্ধ রয়েছে। তাই এ অঞ্চলগুলোয় বিকল্প পদ্ধতিতে সেচ সম্প্রসারণ করতে হবে। আশার কথা, সেচ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে ভূ-উপরস্থ পানির প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ ও নিষ্কাশনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণে খাল-নালা খনন ও পুনঃখনন করে দেশের খরাপ্রবণ এ অঞ্চলকে সেচ সুবিধার আওতায় আনতে হবে।
কৃষির উন্নয়নে অধুনিক সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ ও শস্যের বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই। পাশাপাশি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, চাষাবাদ পদ্ধতির আধুনিকীকরণ, বাজারজাত ব্যবস্থার উন্নয়ন, ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা জরুরি। উৎপাদিত শস্য গুদামজাত ও বাজারজাতের মাধ্যমে কৃষককে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। করোনা মহামারীকালে প্রধানমন্ত্রী এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি ফেলে না রাখা এবং ফসলের বহুমুখীকরণের প্রতি জোর দিয়েছেন। সুতরাং খাদ্য নিশ্চয়তা বৃদ্ধিতে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ও মজুদ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। সেচের পাশাপাশি যান্ত্রিকীকরণ, জমিতে কার্যকর পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ, একসঙ্গে কয়েক ধরনের শস্য রোপণের মাধ্যমে ভারত শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করেছে। একই সঙ্গে তারা জমিতে ভালো বীজ ও দ্রুত পরিপক্ব জাতগুলোর ব্যবহার করেছে। আমরাও অন্যান্য দেশের উদাহরণগুলো অনুসরণ করতে পারি।
তবে কার্যকর ও দক্ষ কৃষি বিপণন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য অর্জনে টেকসই সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি এবং কৃষিপণ্যের বাজার উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের সমন্বয় সাধন জরুরি। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনায় কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন ও ভ্যালু চেইনে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। উৎপাদিত ফসলের যথাযথ সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু বাজারজাতের পাশাপাশি উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কৃষিপণ্য পরিবহনে ভর্তুকি ও টোল ফ্রি পরিবহন ব্যবস্থা প্রচলনের বিষয়টি বিবেচ্য। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে লবণাক্ততা, খরা, ঠাণ্ডা ও রোগবালাই সহনশীল, জোয়ার-ভাটা উপযোগী ফসলের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে একাধিক ফসলের চাষ করা সম্ভব। জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও হাওড় এলাকায় পরিকল্পিত পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে কৃষিজমির আওতা সম্প্রসারণ ও খরাপ্রবণ অঞ্চলে পানির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে একাধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। আধুনিক কৃষি গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা আবশ্যক। প্রয়োজনীয় সেচ, সার ও কীটনাশক ব্যবহার, ফসল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। কৃষিপণ্যের সহজলভ্যতা, সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আধুনিক সংরক্ষণাগার, প্যাকেজিং হাউজ ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনের দিকে জোর দিতে হবে। টেকসই কৃষি ব্যবস্থা তথা খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষি উৎপাদন, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত ও নিরবচ্ছিন্ন বিপণনে বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাই রংপুরের শুষ্ক অঞ্চলগুলোয় আধুনিক সেচ ব্যবস্থায় আনা ও আধুনিক সেচ সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎসাহব্যঞ্জক কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন সময়ের দাবি।
