জনপ্রত্যাশাগুলো প্রত্যাশা দমিত হওয়ার অভিশাপ

ন্যান্সি বার্ডসল

কভিড-১৯ মহামারীর আগে পর্যন্ত উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভালো অনুভব করেছিল। সার্বিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০০৯-১০ সালের আর্থিক মন্দা থেকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষত আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ চীনের বেড়ে চলা তেল, খনিজ সম্পদ এবং কৃষি পণ্যের চাহিদা থেকে সুফল উপভোগ করেছিল। ফলে উল্লিখিত দেশগুলোয়  জনপ্রত্যাশাগুলো ক্রমেই বাড়ছিল। 

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অবস্থা তেমনটি নয় -যেখানে ১৯৮০ এর দশক থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল নতুন ধনী ও মধ্যবিত্তের কাছে প্রবাহিত হয়ে এসেছে এবং দরিদ্র ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এসব প্রবণতার জন্য অনেক বিশ্লেষকই দেশটিতে জনতুষ্টবাদী ডানপন্থীদের উত্থান এবং ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনকে দায়ী করেন। সেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণী একদিকে কিছুটা সংকুচিত হয়েছে, অন্যদিকে শ্রমজীবী শ্রেণীর একদল শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী হতাশায় নিপতিত হয়েছে। বিশ্বায়ন-সৃষ্ট কর্মচ্যুতিতে অনেকেই হতাশ হলেও আফিম সেবনের মহামারী (ওপিওয়েড প্যানডেমিক), অপ্রতুল-অর্থায়িত সামাজিক কর্মসূচি, এমনকি খোদ মুনাফা-চালিত পুঁজিবাদের মুখে সরকার বিষয়টি অবহেলা করেছে। (কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে শ্রমজীবী শ্রেণীর বিপর্যয় অদ্ভূতভাবে ব্যতিক্রম, যারা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অধিক আশাবাদী হয়েছে, যেহেতু তারা শ্রমজীবী শ্রেণীভুক্ত শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে ব্যবধান অনেক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে)।

যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে থাকা জনপ্রত্যাশার ধীরে ধীরে অবসান ঘটেছে মূলত দুই বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অনেক দশকের পরিক্রমায়; যখন দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতিগুলো মার্কিন উদার-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তুলনামূলকভাবে স্থায়িত্বশীল করে তুলেছে। কিন্তু সরকারি করপোরেশন বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনতুষ্টবাদের আবেদনের কাছে অব্যাহতভাবে নাজুক রেখে বর্তমান শতকে সামাজিক সংহতি (অন্তত শ্বেতাঙ্গদের জন্য) এবং নৈতিক অগ্রগতির সামষ্টিক বোধ ক্ষয় হতে শুরু করেছে।

এই অভিজ্ঞতা থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষা নেয়ার আছে। দমিত প্রত্যাশা কেবল ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নয়, উপরন্তু একটি সমাজের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ-রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং সেগুলো বজায় রাখার সক্ষমতার জন্যও খারাপ।

এক দশকের বেশি সময় ধরে উন্নয়নশীল বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক শক্তিশালী এবং স্থায়িত্বশীল হয়েছে। এর মধ্যে চীন ও ভারতের উত্থান ঘটেছে ১৯৯০ এর দশকে। আর অন্য বেশিভাগ উন্নয়নশীল অঞ্চলের অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে চলতি শতকের শূন্য দশকে।  সবচেয়ে নাটকীয় নৈপুণ্য দেখানো সাব-সাহারান আফ্রিকার উত্থানও ঘটেছে একই সময়পর্বে। এই প্রবৃদ্ধি ৮ থেকে ৯ কোটি লোককে অতি দারিদ্র্য (দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের মজুরি) থেকে উত্তরণে যথেষ্ট অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে; যদিও তারা আবশ্যিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিতে সমর্থ হয়নি। বরং তার পরিবর্তে, সেখানে একটি বড় সংখ্যায় নতুন ‘স্ট্রাগলারদের’ উত্থান দৃশ্যমান, যাদের পরিবারগুলো জনপ্রতি দৈনিক ৪-১০ ডলার মজুরি পায়। 

যদিও স্ট্রাগলাররা দরিদ্রদের চেয়ে সচ্ছল, তবে তাদের নিয়মিত বেতন প্রাপ্তি ও সামাজিক বীমার ঘাটতি রয়েছে। ফলে স্বাস্থ্য সংকট বা হঠাৎ কাজ হারানোর মতো পারিবারিক অভিঘাতের কাছে তারা প্রায় সময়ই নাজুক থাকে। স্ট্রাগলারদের বেশিরভাগই খাদ্য, পরিবহন (রাইড চালনাকারী ড্রাইভার) এবং সম্প্রসারণ হওয়া নগর কেন্দ্রগুলোর রিটেইল সেক্টরের স্ব-নিয়োজিত কিংবা অনানুষ্ঠানিক কর্মী। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ৩ বিলিয়নের এই বেশি মানুষেরা একদিকে নিজেদের ভালো ভবিষ্যৎ অন্বেষণে উচ্চাকাক্সক্ষী, অন্যদিকে দারিদ্র্যে পড়া যাওয়ার অব্যাহত ঝুঁকি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন।  

সময়ের আবর্তে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছু কিছু স্ট্রাগলারদের (খুব সম্ভবত যাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা রয়েছে) একটি বড় ও দ্রুত বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উত্তরণ ঘটিয়েছে, জনপ্রতি যাদের দৈনিক আয় ১০-৫০ ডলার। উন্নয়নশীল বিশ্বে এখনো শ্রমজীবী শ্রেণীভুক্ত স্ট্রাগলারদের পরিবারগুলোর আধিপত্যই বেশি। তারা মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত পরিবার ২০ শতাংশ, অতি দরিদ্র ১২ শতাংশ এবং ধনী ৮ শতাংশ। এদের মধ্যে স্ট্রাগলার ও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুখোমুখি হওয়া মহামারী-সৃষ্ট সামষ্টিক অর্থনৈতিক অভিঘাত থেকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। 

লন্ডন কিংস কলেজের অ্যান্ডি সামনার এবং তার সহ-লেখক অনুমান করেন যে কভিড ১৯ মহামারীর কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় চলতি বছরের জিডিপির ১০ শতাংশ সংকোচন প্রায় ১৮০ মিলিয়ন মানুষকে দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের অতি দারিদ্র্যের প্রান্তসীমার নিচে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক দেশভিত্তিক জিডিপি সংকোচন অনুমান করে গড়ে ৫ শতাংশ। তবে সংস্থাটি এখনো সতর্ক করে যে ৭০-১০০ মিলিয়ন লোক অতি দারিদ্র্যে নেমে যেতে পারে। 

এরই মধ্যে প্রাক-মহামারী স্ট্রাগলারদের দরিদ্ররা হঠাৎ করে নিজেদের ‘অতি দরিদ্রদের’ মধ্যে খোঁজে পেতে পারে এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাকি স্ট্রাগলারদের একটি বৃহত্তর সংখ্যাই বর্তমান আর্থিক মন্দায় উল্লেখযোগ্য আয় পতনে অরক্ষণীয় হতে পারে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আরো ৫০ মিলিয়ন লোক যোগ করা যাক, যারা স্ট্রাগলারে পরিণত হতে পারে। সর্বোপরি ৪৫০ মিলিয়ন লোক- যুক্তরাষ্ট্রের পুরো জনসংখ্যার বেশি- আর্থিক ঝুঁকিতে রয়েছে। 

কয়েক শ মিলিয়ন লোক যদি হঠাৎ করে প্রত্যাশার চেয়ে নিজেদের খারাপ অবস্থায় দেখতে পায়- যে অবস্থার জন্য তাদের কোনো দোষ নেই- তাহলে এর মানেটা কি দাঁড়ায়? লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা দেখা যায় যে, যখন প্রতিবাদী ও আকাক্সক্ষী নাগরিকরা প্রত্যাশার একটি লক্ষণীয় বৈপরীত্যে ভোগে তাহলে এর ফল দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র-ধরনের সামাজিক উত্তেজনা এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ। ২০১৪-১৫ সালে বার্ষিক গড়ে ১ শতাংশের নিচে নেমে এসে পুরো অঞ্চলজুড়ে প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে দমিত হওয়া শুরু করে, যেটি পরোক্ষভাবে ঋণাত্মক মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।  ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার সময় অবস্থাগুলো সহনীয় থাকলেও এখন তা ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে।  

এদিকে অসন্তোষ ঘিরে তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়া ব্রাজিল, বলিভিয়া, চিলি, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডর পাঁচ বছর পর বেশিরভাগই অফিসিয়াল দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এবং অভ্যন্তরীণ বিশেষ সুবিধাগুলো রাজনৈতিক ও করপোরেট অভিজাতদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে তুলনামূলক সচ্ছল চিলিতেই কেবল প্রতিবাদকারীরা প্রগতিশীল পরিবর্তন অর্জনে সফল হয়েছে।  

কভিড-১৯ এর ছায়ায় উন্নয়নশীল বিশ্ব ভয়াবহ রাজনৈতিক ও আর্থিক চাপের মুখোমুখি হচ্ছে। নিজেদের বাণিজ্যযোগ্য-বিনিময়যোগ্য মুদ্রা ছাড়া এসব দেশ তাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে ধার করতে পারবে না, যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন পারে।

সামাজিক সংহতি ব্যাহত হওয়া, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পুনরাবৃত্ত স্বৈারাচার ও জনতুষ্টবাদের ভয়ের ঝুঁকির বাস্তবতায় মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বহুপক্ষীয় ব্যাংকগুলোর আরো বড় ঋণদান কর্মসূচি চালু করা দরকার। এসব কর্মসূচি সহজ  ও সরাসরি হতে হবে, যাতে দরিদ্র ও আর্থিকভাবে নাজুক পরিবারগুলোর শিশুরা ক্ষুধার সম্মুখীন না হয় এবং স্থায়ীভাবে স্কুল ত্যাগ না করে। এসব বিনিয়োগ ভবিষ্যৎ মানব পুঁজির সুফল কাজে লাগানোর জন্য জরুরি, যার ওপর আসলে চূড়ান্তভাবে উন্নয়ন নির্ভর করে।

কভিড সংকট এমন এক মুহূর্তে চলছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের উদারবাদী ডেমোক্রেটদের অবশ্যই  নিজ দেশের ভেতরে কর্তৃত্ববাদ প্রতিহত করলে হবে না, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাড়তি পৃষ্ঠপোষকতার তদবির করতে হবে। নিজেদের সম্ভাবনা আর উন্নয়ন হবে না এমন বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা যখন বাড়বে, তখন রাজনীতি বিশৃঙ্খল হতে পারে এবং এতে খুব দ্রুততার সঙ্গে ভূখা-িক স্বাধীনতা ও নাগরিক স্বাধীনতার সার্বিক ক্ষতি হতে পারে বৈকি।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট 
ন্যান্সি বার্ডস্টল: প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস এবং সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন