সেচ ব্যবস্থায় অবহেলিত হলেও শস্য নিবিড়তায় সবার ওপরে রংপুর

সাইদ শাহীন

দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চল রংপুর। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পিছিয়ে আছে অঞ্চলের মানুষ, যার ছাপ রয়েছে কৃষিতেও। এমনকি সেচ ব্যবস্থায়ও অবহেলিত উত্তরের বিভাগ। তবে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শস্যের নিবিড়তায় সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখিয়েছে রংপুর।

রাজশাহীর পরই সবচেয়ে বেশি আবাদি জমি রয়েছে রংপুর বিভাগে। যদিও মোট ফসলি জমির মাত্র ১৫ শতাংশ সেচের আওতায় এসেছে সেখানে। সেচ সুবিধার অপর্যাপ্ততার মধ্যেও রংপুরে শস্যের নিবিড়তা ২২০ শতাংশ। বিভাগের কৃষকরা তাদের জমিতে বছরে গড়ে দুটি শস্য উৎপাদন করছেন।

রংপুর বিভাগের বেশ কয়েকটি জেলায় বিপুল পরিমাণ চরের জমি আছে, যা আবাদযোগ্য। সিরাজগঞ্জের আগ পর্যন্ত যমুনা নদীর দুই পাড় এবং তিস্তা ধরলা নদীর চরে রয়েছে বিস্তীর্ণ আবাদি জমি, যার পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ হেক্টর। এসব জমিতে এখনো পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সেচ সুবিধার বাইরে থাকা এসব চরে খরাসহিষ্ণু বিভিন্ন সবজি অন্যান্য ফসল আবাদ হচ্ছে। সেচ সুবিধা বাড়ানো গেলে সেখানে শস্যের নিবিড়তা আরো বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ। জমির উচ্চউর্বরতা জলবায়ুগত কারণে শস্যের বহুমুখীকরণের সুযোগ রয়েছে এখানে। কৃষির বহুমুখীকরণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা কৃষি থেকে আয় আরো কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন বিশ্বব্যাংকের গবেষক কে মেসিকানোভা। সম্প্রতি ওই গবেষণার ফল প্রকাশ হয়েছে। ইমপ্রুভিং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড কোয়ালিটি অব অন-ফার্ম ইনকামস অ্যান্ড প্রডাক্টিভিটি থ্রু এগ্রিকালচার ডাইভারসিফিকেশনশীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি দেখিয়েছেন, দেশে এখন মোট ফসলি জমির পরিমাণ কোটি ৫৪ লাখ ৮৮ হাজার ২৫৯ হেক্টর, যার মধ্যে ২৫ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টরেরও বেশি রংপুর বিভাগে। যদিও জমির মাত্র ১৫ শতাংশ সেচ সুবিধার আওতায় রয়েছে। সেচ সুবিধার অপর্যাপ্ততার মধ্যেও শস্যের নিবিড়তার হার সবচেয়ে বেশি সেখানে, ২২০ শতাংশ।

কৃষিমন্ত্রী . মো. আব্দুর রাজ্জাক বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, আমার জানামতে সার্বিকভাবে রংপুর অঞ্চলে সেচের পরিস্থিতির আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। রবি মৌসুমে পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে বিধায় অঞ্চল শস্যের নিবিড়তায় বেশ অগ্রগামী। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ বিভাগে আছে, সেগুলো উত্তরণের চেষ্টা আমরা করছি। অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধির পেছনে সরকারের নীতি উদ্যোগ কৃষকের আগ্রহ দুটির সমন্বয় রয়েছে। কৃষকরা অর্থকরী বিভিন্ন ফসল ভালো দাম পাওয়া যাবে এমন সবজি আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন। শস্যের নিবিড়তা আরো বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের সেচ সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি সব ধরনের উপকরণ, বিশেষ করে বিদ্যুৎ, বীজ, অর্থায়ন যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া অঞ্চলের নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সেচ সুবিধা আরো বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চর এলাকায় সেচের জন্য নতুন নতুন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেচ সুবিধা সবচেয়ে বেশি রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে। অঞ্চলে মোট ফসলি জমির ৯৫ শতাংশই সেচের আওতায় আছে। যদিও সেখানে শস্যের নিবিড়তা ১৯৮ শতাংশ, যা সেচে পিছিয়ে থাকা রংপুরের চেয়ে অনেক কম। একইভাবে ৭৪ শতাংশ জমিতে সেচ সুবিধা নিয়েও শস্যের নিবিড়তায় পিছিয়ে রয়েছে সিলেট। বিভাগে শস্যের নিবিড়তা মাত্র ১৫২ শতাংশ। অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে সেচের আওতায় এসেছে ১০ শতাংশ জমি। সেখানে শস্যের নিবিড়তা প্রায় ১৮৭ শতাংশ। ৫০ শতাংশ জমিতে সেচ সুবিধা নিয়ে ঢাকা বিভাগে শস্যের নিবিড়তা ১৮৪ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে ৫৮ শতাংশ জমিতে সেচ সুবিধা থাকলেও সেখানে নিবিড়তা ১৬৫ শতাংশ। খুলনা বিভাগে সেচ সুবিধা ৭৯ শতাংশ জমিতে পৌঁছেছে, তবে নিবিড়তা ২০৫ শতাংশ। অন্যদিকে রাজশাহী বিভাগে প্রায় ৪৯ শতাংশ জমিতে সেচ সুবিধা রয়েছে। সেখানে শস্যের নিবিড়তা ২১৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, দেশে আবাদি জমি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেচযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬১-৬২ অর্থবছরে। ওই বছর হাজার ৫৫৫টি শক্তিচালিত পাম্প দিয়ে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৭-৬৮ সালে বিএডিসি গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করে এবং ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে অগভীর নলকূপ স্থাপন শুরু করে। বর্তমানে সারা দেশে ১৫ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি সেচযন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। যদিও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় সরকারিভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন এক প্রকার বন্ধ আছে। এসব জেলায় পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে বিকল্প পদ্ধতিতে সেচ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রবি মৌসুমে সারা দেশে প্রায় ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পৌঁছানো হয়েছে। তবে রংপুর অঞ্চলে সেচ সুবিধা আরো বৃদ্ধির জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বিএডিসি।

বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. জিয়াউল হক প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, চরাঞ্চলের ভাসমান সেচযন্ত্র দিয়ে নতুন নতুন জমিকে সেচের আওতায় আনা হচ্ছে। এছাড়া ভূ-উপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নে ভূ-উপরিভাগের পানিনির্ভর সেচ সম্প্রসারণের মডেল শিগগিরই চালু করা হবে। এর মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনা হবে। রংপুরের কাউনিয়ায় চর এলাকায় ভাসমান বা নৌকায় সেচযন্ত্র চালু হয়েছে। ডাগঅয়েল বা ফিতা পাইপের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের জমিগুলোতে পানি নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া সেচের পানির একটি বড় অংশ অপচয় হয়। সেটি কমিয়ে আনতে সাবসারফেস সেচনালা (ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন) নির্মাণ, পুরনো ডিপ টিউবওয়েলগুলোর পুনর্বাসন, মেরামত রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ নিষ্কাশনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণে খাল-নালা খনন পুনঃখনন করা হচ্ছে। রংপুর বিভাগকে একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে সেচের সব প্রযুক্তি পৌঁছানোর মাধ্যমে সেচের এলাকা বৃদ্ধি করা হবে।

কৃষির উন্নয়নে শস্যের বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই। যদিও দেশের কিছু বিভাগে এককেন্দ্রিক শস্য আবাদ, বিশেষ করে ধাননির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেট ময়মনসিংহ জেলায় ধান ছাড়া অন্য শস্যের আবাদ খুব কম হচ্ছে। ধাননির্ভরতা সবচয়ে কম ঢাকা, রাজশাহী রংপুর বিভাগে।

মনোক্রপ বা এক ফসলনির্ভরতা পরিমাপের জন্য সিম্পসন মডেল ব্যবহার করা হয়। এর প্রবক্তা ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ অ্যাডওয়ার্ড এইচ সিম্পসন। ইনডেক্সটিতে সর্বনিম্ন ভ্যালু শূন্য এবং সর্বোচ্চ ১। ভ্যালু যত বেশি হবে শস্যের বহুমুখিতাও হবে তত বেশি। সিম্পসন ইনডেক্সে বাংলাদেশে শস্যের বহুমুখিতার পরিমাণ দশমিক ৪৬। শস্যের বহুমুখিতার হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে। সিম্পসন ইনডেক্সে ঢাকা বিভাগের মান শূন্য দশমিক ৬২। বিভাগের প্রধান প্রধান শস্যের মধ্যে রয়েছে ধান, গম, আলু সরিষা। মুন্সীগঞ্জ যেমন আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের একটি প্রসিদ্ধ জেলা, তেমনি শাকসবজি উৎপাদনে ঢাকা নরসিংদী জেলা, মসলার জন্য মানিকগঞ্জ জেলা, আখ কাঁঠাল উৎপাদনে গাজীপুর জেলা এবং আনারস উৎপাদনে টাঙ্গাইল জেলার বিশেষত্ব রয়েছে।

অন্যদিকে সিম্পসন ইনডেক্সে রাজশাহী বিভাগের মান ছিল দশমিক ৫৮। আলু, গাজর, পটল, পেঁয়াজ, আখ, কলা, ধান, গম, মরিচসহ বিভিন্ন ফল বিশেষ করে আমের উৎপাদন বেশি হয়। শস্যের বহুমুখিতায় সিম্পসন ইনডেক্সে রংপুরের অবস্থান দশমিক ৪৮। রংপুরে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, তামাক, আলু, আখ শাকসবজি আবাদ বেশি হয়ে থাকে।

সিম্পসন ইনডেক্সে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে সিলেট বিভাগ, মান মাত্র শূন্য দশমিক ১৮। এর পরই অবস্থান ময়মনসিংহ বিভাগের শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ। বরিশাল অঞ্চলে শস্যের বহুমুখিতার হার দশমিক ৩৪। চট্টগ্রাম বিভাগে শস্যের বহুমুখিতার হার ৩৭ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগেরও প্রধান শস্য ধান। অর্থকরী ফসল চা- উৎপাদন হয়। জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি নিয়ে তালিকায় খুলনা বিভাগের মান শূন্য দশমিক ৫৩। ধানের পাশাপাশি শাকসবজি উৎপাদনে বেশ ভালো করছে বিভাগটি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন