ভ্যাকসিনের ফল নিয়ে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ

বণিক বার্তা ডেস্ক

চলমান করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের বেশ কয়েকটি ট্রায়াল আগামী মাসে বৈপ্লবিক ফল নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু প্রত্যাশা বাড়ার সঙ্গে দুশ্চিন্তাও বাড়তে শুরু করেছে। ভ্যাকসিনগুলো সুরক্ষা ট্রায়াল সফলতার সঙ্গে পার করতে পারবে কিনা। যদি তারা তা পারে তবে তারা কী অর্জন করবে এবং কী হবে যদি অনুমোদনের প্রক্রিয়া রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়?

কয়েক সপ্তাহ আগে যুক্তরাজ্যের শীর্ষ সারির ভ্যাকসিন, যা বিকশিত হচ্ছে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তার ট্রায়াল স্থগিত করা হয়। যদিও সুরক্ষা তদন্তে ছয়দিন বন্ধ থাকার পর ফের ট্রায়াল শুরু করেছে তারা। দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রাজিলেও স্থগিত হওয়া ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু হয়েছে। কিন্তু ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) যুক্তরাষ্ট্রে ট্রায়াল শুরু করার জন্য এখন পর্যন্ত অনুমতি প্রদান করেনি। কেন ট্রায়াল বন্ধ করা হয়েছে এবং কেনই বা ফের চালু করা হলো, সে সম্পর্কে ভ্যাকসিন নির্মাতারা খুব সামান্য তথ্যই প্রদান করেছে। কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, স্বচ্ছতার অভাব ভ্যাকসিনের বিষয়ে মানুষের আস্থাকে নষ্ট করতে পারে।

এদিকে ভয়ও বেশ জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে যে রাজনৈতিক চাপের কারণে যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়াই জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেতে পারে ভ্যাকসিন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নভেম্বরের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের আগেই ভ্যাকসিন দেখতে চান।

উদ্বেগের সমাধান করতে, যে তিনটি ওষুধ কোম্পানি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে আছেঅ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার মডার্না গত সপ্তাহে নথিপত্র প্রকাশ করেছেযেখানে বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে তাদের টেস্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে।

ট্রায়াল প্রটোকলগুলোতে সুরক্ষা সফলতার মানদণ্ড এবং আগে জনসাধারণকে অবহিত করা হয়নি এমন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা আছে। নথিতে এটাও বলা আছে যে ফাস্টট্র্যাকড অনুমোদন পেতে কোম্পানিগুলো কীভাবে কাজ করবে।

এখানে যে তিনটি বিষয়ে বিজ্ঞানীরা গভীরভাবে নজর রাখছেন তা নিচে তুলে ধরা হলো। 

সুরক্ষা স্বচ্ছতা

প্রাথমিকভাবে গবেষকরা খুব বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন না যখন মিডিয়ার তরফ থেকে জানানো হয় যে অংশগ্রহণকারীর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত করা হয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বেশ সাধারণ একটা ব্যাপার এবং তা প্রায়ই চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় না। কিছু গবেষক বলেছেন, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের সঙ্গেও সম্ভবত তেমনটা ঘটেছে। এর মাঝে কিছু মিডিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয় অংশগ্রহণকারীর শরীরে ট্রান্সভার্স মাইলিটিস এবং মেরুদণ্ডে প্রদাহজনিত সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড অসুস্থ ব্যক্তিটি সম্পর্কে কিছুই জানায়নি।

কোনো কোনো বিজ্ঞানী প্রকাশিত তথ্যের স্বল্পতার ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে যখন এটি সামনে আসে যে অংশগ্রহণকারীর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে এটি দ্বিতীয়বারের মতো বন্ধ হয়েছে। তবে সেবার তদন্ত শেষে স্বাধীন প্যানেলটি জানিয়েছিল, বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভ্যাকসিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। যদিও কোম্পানিটি এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কেউই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে জানায়নি দুই অংশগ্রহণকারী ভ্যাকসিন নিয়েছেন নাকি প্ল্যাসেবো। 

এদিকে ট্রান্সভার্স মায়েলিটিসের উপসর্গ নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে এপিডেমিওলজিস্ট রায়না ম্যাকইনটায়রে বলেন, যদি এখনো আরো একটি কেস থাকে, তবে ট্রায়ালের জন্য এর থেকে উদ্ধার পাওয়া বেশ কঠিন হবে।

ম্যাকইনটায়রে বলেছেন, ভাইরাল সংক্রমণের সঙ্গে ট্রান্সভার্স মায়েলিটিস এবং মাল্টিপল স্কেলেরোসিসের সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি  ট্রান্সভার্স মায়েলিটিস কভিড-১৯ আক্রান্ত লোকদের মাঝেও দেখা গেছে। এখন ভ্যাকসিন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে খারিজ করতে গবেষকদের অবশ্যই একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ চালাতে হবে। তাদের মাঝে যারা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন এবং যারা প্ল্যাসেবো গ্রহণ করেছেন।

ম্যাকইনটায়রের মতে, কারণেই হয়তো এফডিএ যুক্তরাষ্ট্রে ট্রায়াল শুরুর অনুমোদন দেয়ার আগে এখনো তদন্ত করছে। বিশেষজ্ঞ হিলদা বাস্টিয়ান বলেন, ট্রায়াল কেন বন্ধ হলো বা কেনইবা শুরু করা হলো তা জনসম্মুখে আনতে হবে। তবে ট্রায়াল স্পন্সরগুলো যদি স্বচ্ছতা বজায় রাখতে না পারে, তবে কিছু কিছু অংশগ্রহণকারী নিজেদের সরিয়ে নিতে পারে কিংবা ভ্যাকসিন অনুমোদিত হওয়ার পরও গ্রহণ না করার দিকে সাধারণ মানুষকে চালিত করতে পারে।

রাজনীতির ভূমিকা

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে জনসাধারণের আস্থা এখন দোদুল্যমান, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। যেখানে ট্রাম্প প্রায়ই ভ্যাকসিন আবিষ্কারে গতি বাড়ানোর তাগাদা দেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ভ্যাকসিন উপলব্ধ হলে সেটি গ্রহণ করতে রাজি এমন মানুষের সংখ্যা এখন নেমে এসেছে ৫১ শতাংশে। যা কিনা মে মাসে ছিল ৭২ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে জরিপকৃতদের তিন-চতুর্থাংশই মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র সুরক্ষা কার্যকারিতা নিশ্চিত হওয়ার আগেই একটি ভ্যাকসিন অনুমোদন দিয়ে দেবে।

এমন নয় যে এরা কেবলই ভ্যাকসিন নিয়ে সন্দেহ পোষণকারী লোকজন। এমনকি অনেক গবেষক যারা ভ্যাকসিনের ডিজাইন টেস্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তারাও ভ্যাকসিনের অনুমোদন প্রক্রিয়া বিজ্ঞানের পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে চালিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বেরি কনসালট্যান্টের বিশেষজ্ঞ কুর্ট ভিয়েলে বলেন, আমি আমার সন্তানদের ভ্যাকসিনের টিকা দেয়ার আগে এর সুরক্ষা ডাটা খতিয়ে দেখব।

এমন নয় যে অনাস্থা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই আবদ্ধ। ইউরোপেও ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া ভ্যাকসিন নিয়ে দ্বিধার জন্ম দিয়েছে। অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ইউরোপিয়ান পাবলিক হেলথ অ্যালায়েন্সের পলিসি ম্যানেজার ইয়ানিস নাটসিস বলেন, আমরা ভ্যাকসিনকে একটি বাজে খেলায় পরিণত হতে দিতে চাই না। আমরা ভ্যাকসিনের ওপর আস্থা সুরক্ষিত রাখতে চাই। কিন্তু এখানে স্বচ্ছতার ব্যাপক অভাব রয়েছে।

ভ্যাকসিনের লক্ষ্য কার্যকারিতা

এমনকি রেগুলেটররা তিনটি সামনের সারির ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয়ার পরও গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে এগুলো তেমন হবে না যেমনটা মানুষ আশা করে।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার মডার্নার ট্রায়ালগুলো ডিজাইন করা হয়েছে ভ্যাকসিন কভিড-১৯-এর উপসর্গ হ্রাস করাকে কেন্দ্র করে, মারাত্মক উপসর্গের জন্য নয়। বিশেষ করে তাদের জন্য যাদের হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন রয়েছে এবং যারা মৃত্যুর সন্নিকটে অবস্থান করছে।

ম্যাকইনটায়রে এবং অন্য গবেষকরা বলেছেন, এটা টেস্ট করা ভালো যে ভ্যাকসিন মারাত্মক রোগের উপশম এবং মৃত্যু হ্রাস করতে পারবে কিনা তা দেখা। যদি এটি সফলতার সঙ্গে মারাত্মক  ঝুঁকি হ্রাস করতে সক্ষম হয়, তবে এর থেকে সাধারণ সর্দিজ্বরের ভ্যাকসিনের সমপরিমাণ উপকারিতা পাওয়া যাবে।

নেচার থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন