ছোটদের প্যাকেজ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের হাতাশাজনক অগ্রগতি

প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতপূর্বক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে

বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং আত্মকর্ম নিয়োজনের ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কুটির, ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগ তথা সিএমএসএমই খাত। আমাদের সামগ্রিক শিল্প কাঠামোয় বর্তমানে উল্লিখিত খাতের প্রাধান্য বিরাজমান। সর্বশেষ প্রকাশিত অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, আমাদের মোট অর্থনৈতিক ইউনিটে এর অংশ ৯৭ শতাংশের বেশি। আট মিলিয়নের বেশি কর্মী খাতে নিয়োজিত। কিন্তু তুলনামূলক নাজুক আর্থিক ভিত্তির হওয়ায় চলমান মহামারীতে সিএমএসই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বিশেষত করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধে মার্চের শেষ থেকে গৃহীত প্রায় দুই মাসের লকডাউনে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন খাতের অনেক উদ্যোক্তা। কাজ হারিয়েছেন কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। কিছু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধও হয়ে গেছে, আবার নতুন স্বাভাবিকতায় কিছু প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে লড়াই করছে। আর্থিক চাপ প্রশমনে সরকার গত এপ্রিলেই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটির টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করলেও ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে এখনো আশানুরূপ গতি নেই। এর কারণ প্রণোদনা প্যাকেজভুক্ত ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো বড় উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে যতটা আগ্রহী, ছোট উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ততটা নয়। এটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বড়দের জন্য ঘোষিত প্যাকেজের এরই মধ্যে ৬৭ শতাংশ অর্থ ছাড় দিলেও ছোটদের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অর্জন মাত্র শতাংশ। এটা ব্যাংকগুলোর শৈথিল্য অনীহারই বহিঃপ্রকাশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সিএমএসএই খাতে মালয়েশিয়া মোট প্রণোদনার ২৪ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩৩ শতাংশ এবং ভারত ৩৮ শতাংশ বরাদ্দ ঘোষণা করলেও বাংলাদেশে তা ২২ শতাংশ মাত্র। একে তো আমাদের দেশে ঘোষিত প্রণোদনা তুলনামূলক বিচারে অকিঞ্চিত্কর, তার ওপর সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীরা তাও যদি সঠিক সময়ে না পায়, তাহলে খাতের দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে বৈকি।

সিএসএমইর অবস্থানগত বিন্যাস লক্ষ করলে দেখা যায়, খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ছাড়ের কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাদের ওই সুবিধা পাওয়ার জন্য সেসব অঞ্চলে ব্যাংক শাখা থাকাটা জরুরি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গ্রাহক না পাওয়া এবং উচ্চ পরিচালন ব্যয়ের কারণে সব এলাকায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো শাখা বিস্তারে খুব একটা আগ্রহী নয়। সেদিক থেকে অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ব্যতিক্রম। ঐতিহ্যিকভাবেই ব্যাংকগুলোর শাখা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিরাজমান। স্বভাবত সেগুলোর মাধ্যমে গ্রামীণ ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ পৌঁছে দেয়া তুলনামূলক সহজ। অথচ কৃষকসহ সিএমএসই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের অর্থ ছাড়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে উঠে আসা নৈপুণ্য রীতিমতো হতাশাজনক। অর্থনীতির স্বার্থেই এক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি কাম্য।

ছোটদের ঋণ বিতরণে আগ্রহের কারণ হিসেবে বেসরকারি বাণিজ্যিকগুলোর পক্ষ থেকে সংজ্ঞায়নগত অস্পষ্টতা, ক্রেডিট গ্যারান্টির অনিশ্চয়তা, কঠিন শর্ত ব্যাংকগুলোর উচ্চ পরিচালন ব্যয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক লেনদেনে সংযোগহীনতাসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও এসব কারণ অনেকাংশে প্রযোজ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য আইনগত অস্পষ্টতা দূর এবং ঋণের শর্ত নমনীয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাতেও ছোটদের জন্য ঋণ বিতরণ কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না। অবস্থায় আর কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধান বাড়াতে হবে।

কভিড সংকটে ভারত, চীন কিংবা আমাদের সমপর্যায়ের দেশ, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও সিমএসএমই খাতের দ্রুত পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। উল্লিখিত দেশগুলো উদ্যোক্তাদের কাছে অর্থ পৌঁছে দেয়ার জন্য কী ধরনের উপায় কৌশল অবলম্বন করছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে। সেখান থেকে প্রাপ্ত উত্তম চর্চাগুলো অনুসরণ করা গেলে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম যেমন ত্বরান্বিত হবে, তেমনি উদ্যোক্তারা তা কাজে লাগিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে সমর্থ হবে বৈকি।

এটা সত্য যে নতুন ঋণের জন্য সিএমএসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করা এবং টার্গেটিং করা একটি জটিল ইস্যু; যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানের নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য ভিত্তি নেই। সেক্ষেত্রে বিএসসিআইসি এসএমই ফাউন্ডেশন একটি ডাটাবেজ তৈরি করতে পারে, যাতে তাদের ঋণভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজের অধীনে আনা সহজতর হয়। কাজটি জরুরি ভিত্তিতে শুরু করতে হবে। এছাড়া ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কর্মপ্রক্রিয়া বেশ জটিল। বিশেষত ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য এটি আরো সহজ হওয়া দরকার। বেশির ভাগ অনানুষ্ঠানিক হওয়ায় আলোচ্য খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকে অভিগম্যতা সম্ভব হবেও না। সেক্ষেত্রে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ বিতরণে আরো বড় মাত্রায় কীভাবে যুক্ত করা যায়, সেটি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সিএমএসএমইর ঘুরে দাঁড়ানো শ্রমবাজারের ভারসাম্যহীনতা দূর এবং সার্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধার উভয়ের জন্য দরকার। সরকারের নীতি সহায়তা, ব্যাংকগুলোর সক্রিয় ভূমিকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের জোরালো তদারকিতে খাতের ঋণ বিতরণ কাঙ্ক্ষিত গতি পাবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন