ডোনাল্ড ট্রাম্প ও লোকরঞ্জনবাদের রাজনীতি

মাসুমা সিদ্দিকা

পৃথিবীতে বড় বড় বা মহান রাজনীতিবিদরা নিজেদের দেশকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জীবন পণ করেন। তাদের ধর্মই হচ্ছে মানুষকে নির্দেশনা দেওয়া জন কল্যাণের জন্য, দেশের উন্নতির জন্য। কখনো কখনো সাময়িকভাবে মানুষ যদি তাদের কথা গ্রহণ নাও করেন, তারা তাতে দমে না গিয়ে তাদের পন্থায় অটল থাকেন। কেননা তাদের রাজনৈতিক দর্শনের পিছনে একটা দৃঢ় বিশ্বাস ও মহান লক্ষ্য থাকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়াটা তাদের একমাত্র বা মূল লক্ষ্য হয় না। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন লোকরঞ্জন বা জনতুষ্টির এক প্রতিমূর্তি। তার বিভিন্ন কর্মকান্ড থেকেই এই অতিমাত্রার লোকরঞ্জনবাদ আমরা পাই যাকে পুঁজি করে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন এবং এই ২০২০ এর নভেম্বরের নির্বাচনে আবারও ক্ষমতায় গেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বললেই তার যে বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে আসে তা হলো তার ‘লোকরঞ্জনবিদ্যা’। এই লোকরঞ্জনবিদ্যা এমন একটি শব্দ যার মধ্যে আমরা দেখি জনগণের বা মানুষের মন জয় করার জন্য কিছু বলা সেটা হোক সঠিক বা বেঠিক। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে জনগনের সার্বিক কল্যাণের তোয়াক্কা না করে মানুষের মন জুগিয়ে চলা, মানুষের মন মত কাজ করা তো অহরহই আমরা অনেক রাজনীতিবিদদের কাজকর্মে দেখে থাকি; যা হয়তো সব সময় সার্বিক বিবেচনায় মঙ্গলময় হয় না, কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার জন্য বা ক্ষমতা ধরে রাখবার জন্যে যা খুবই দরকার হয়ে পড়ে। তবে এই লোকরঞ্জন আমরা শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রেই দেখি তা না, এটি আমরা হাঙ্গেরীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী ভিক্টর অর্বান, ফান্সের মারী লো পেন, ব্রাজিলের বলসোনারো- এ রকম অনেকের ক্ষেত্রেও পাই। 

করোনা ভাইরাসকে ট্রাম্প চীনা ভাইরাস বা উহান ভাইরাস বলে সম্বোধন করছেন। তিনি এমনকি কোন দৃঢ় তথ্য- প্রমাণ ছাড়াই চীনকে এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ী করছেন। এই কভিড- ১৯ কে চীনা ভাইরাস বলায় অনেক আমেরিকান অবশ্যই ট্রাম্পের উপর খুশি হয়েছেন। কেউ কেউ এমন সন্দেহও প্রকাশ করেছেন যে চীন ইচ্ছাকৃতভাবে করোনা ছড়িয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে আমরা কিছু আমেরিকানের চীনাদের আক্রমণ করার খবর পেয়েছি। ট্রাম্পের এই উসকানিমূলক প্রচারণাটা অবশ্যই একজন প্রেসিডেন্টের পদের দায়িত্বশীলতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার উচিত ছিল এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দেশকে করোনা মোকাবিলা করার জন্য একতাবদ্ধ করা। কিন্তু তিনি তা না করে উপরন্তু এর দায়ভার চাপাচ্ছেন চীনাদের উপর এবং জনগণকে উসকিয়ে দিচ্ছেন চীনাদের বিরুদ্ধে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ব্যর্থতাকে দায়ী করে এর পাশাপাশি আগামী বছরের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও আমেরিকার অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ ট্রাম্পের আমেরিকান কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই এই ঘোষণা দেবার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ব্যাপারে যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে, তিনি পুনঃনির্বাচিত হলেও বিষয়টির চূড়ান্ত ফয়সালা হবে মার্কিন আদালতেই। 

ইতোমধ্যে দুই লাখেরও অধিক আমেরিকান করোনাভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন, এই বছরের শেষ নাগাদ যা তিন লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন। করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে আমেরিকার সরকার। এজন্য তিনি প্রচণ্ড চাপে আছেন যার প্রতিফলন পাওয়া যায় যে সব জনমত জরিপ হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবগুলোতেই তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের চেয়ে পিছিয়ে আছেন। যখনই ট্রাম্প কোন চাপের মুখে পড়েন, তখনই তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে দোষারোপ করতে থাকেন। বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভও তাকে সেই সুযোগই করে দিয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন স্থিতিশীল অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে তিনি সহজেই ভোটে জিতে যাবেন, কিন্তু করোনাভাইরাসের ফলে দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ পড়ে। কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকায় কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। তাই নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই তিনি ডেমোক্র্যাটদের দোষ দিচ্ছেন এবং চীনাদের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। কারণ তিনি ঠিকমতই জানেন যে, যদি আমেরিকানদের ক্ষেপিয়ে তোলা যায় চীনাদের বিরুদ্ধে তবে আমেরিকানরা চীনাদের দোষ দিতে ব্যস্ত থাকবে আর নিজেদের দেশের সরকারের দোষ ঢাকা পড়ে যাবে আর এতে ট্রাম্পের ভোট বেড়ে যাবে ২০২০ সালের নির্বাচনে।  

ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্ণবাদ ও পুলিশ-বিরোধী বিক্ষোভকে নির্বাচনী হাতিয়ার করছেন। গত মে মাসে মিনিয়াপোলিসে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার হাঁটুর চাপে জর্জ ফ্রয়েড নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ আর এই বিক্ষোভের মাত্রা এত বেশি বেড়ে যায় যে ট্রাম্পের দেহরক্ষীরা শঙ্কিত হয়ে ট্রাম্পকে মাটির নিচে একটি বাঙ্কারে  নিয়ে রাখেন কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু হোয়াইট হাউজে তিনি যে ভাষণ দেন, তাতে দেখা যায় যে তিনি নভেম্বরের নির্বাচনে জেতার জন্য আইন শৃঙ্খলার জুজু দেখিয়ে এই বিক্ষোভকেই প্রধান নির্বাচনী হাতিয়ার করতে চান বলে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করছেন। হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনের লনে তিনি ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত শহর এবং গভর্নরদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, তারা যদি সাধারণ মানুষের জানমাল এবং সম্পদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি সেনা মোতায়েন করে নিজেই দেশের হয়ে ত্রাতা হিসেবে সবাইকে রক্ষা করবেন। এই বক্তব্যের দ্বারা তিনি এটাই প্রমাণ করতে চান  মিনিয়াপোলিস ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত এবং এখানেই এত বিক্ষোভ হচ্ছে যা জনগণের জানমালের ক্ষতি করতে পারে।

এর পাশাপাশি তিনি এতে তিনি আরও ইঙ্গিত দেন যে, এই বিক্ষোভের সাথে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক কম, বরঞ্চ কট্টর বামপন্থীরা প্রতিবাদের নামে বিশৃঙ্খলা এবং লুটপাট করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন সেনা মোতায়েন করতে পারেন আর নাই পারেন, ডেমোক্র্যাটরা অথর্ব এটা বোঝাতেই তিনি এই কথাগুলো বলেছেন। 

ভোটারদের মনে তিনি এই ধারণাই ঢুকিয়ে দিতে চান যে, তিনি সবাইকে রক্ষা করতে পারেন আর এর মাধ্যমে তিনি ভোটারদের ভোট নিজের দিকে টানতে চাইছেন আর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াই প্রধান লক্ষ্য এখানে। বিক্ষোভের মূল কারণ যে পুলিশের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে অসন্তোষ; তা নিয়ে তিনি মোটেও কথা না বলে নিজেকে তুলে ধরেছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কান্ডারী হিসেবে।

তাই আমেরিকার ২০২০ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে লোকরঞ্জনবাদ মডেলের আরো একটি টেস্ট কেস হিসেবে দেখলে তা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। ট্রাম্প যেমন 'আমেরিকাই প্রথম' ধোঁয়া তুলে ২০১৬ এর নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, তেমনি যদি আমেরিকার বিভক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সাধারণ মানুষের মনে ভয় এবং ঘৃণা উসকে দিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে পারেন, তা শুধু তার রাজনৈতিক বিজয়ই হবে না, তা লোকরঞ্জনবাদেরও এক বিজয় হবে; পরাজিত হবে আদর্শ এবং বিশ্বাস ভিত্তিক রাজনীতি। 

লেখক: রন্ধন শিল্পী ও ফ্রিল্যান্স লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন