ভোজ্যতেলের বাজারে হঠাৎ অস্থিরতা

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশে ভোজ্যতেলের বাজারে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল ২০০৮ সালে। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে ওই বছরের মার্চে মালয়েশিয়ার ফিউচার মাকের্টে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম প্রায় হাজার রিঙ্গিতে পৌঁছার ঘটনা। এবার সে রকম কোনো কারণ না থাকলেও দেশে হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে পাম অয়েলের বাজার।

ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত রোববার প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম হাজার ১২০ টাকায় দাঁড়ায়, এটি ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর সোমবার থেকে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভোজ্যতেলের বাজার। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে গতকাল অপরিশোধিত পাম অয়েলের লেনদেন হয়েছে প্রতি টন হাজার ৭৮৬ রিঙ্গিতে (৫৬ হাজার ৫৫৫ টাকা)

ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি টন পাম অয়েলের মূল্য ছিল হাজার রিঙ্গিতের ওপরে। আর মার্চে হাজার ৭৩৩, এপ্রিলে হাজার ৬৫১, মে মাসে হাজার ৪৯৩, জুনে হাজার ৭৮৫, জুলাইয়ে হাজার ৯৫৯ রিঙ্গিতে লেনদেন হয়েছে প্রতি টন পাম অয়েল।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিলগুলো থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপণ্যের মূল্য। এক দশকের মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে এখন। আমদানি সরবরাহ নিশ্চিত না হলে দাম আরো বাড়তে পারে।

করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম যেখানে হাজার ৯০০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে ছিল, সেখানে গত রোববার ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম হাজার ১২০ টাকায় দাঁড়ায়। এরপর সোমবার দাম কমে হাজার ২০ টাকায়, মঙ্গলবার হাজার ৫০ টাকায় এবং বুধবার হাজার ৯০০ টাকায় নেমে আসে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পাম অয়েলের পাইকারি দাম আরো কমে হাজার ৮০০ টাকায় লেনদেন হয়। গতকাল শুক্রবার বাজার বন্ধ ছিল। টানা দুই মাসের ঊর্ধ্বগতির পর এক সপ্তাহের মধ্যেই দামের এমন উত্থান-পতনে পাইকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের ব্যবসায় ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশে ভোজ্যতেলের বাজার হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে আমদানি হ্রাস পাওয়াকেও দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশে পাম অয়েল আমদানিতে প্রধান দুটি উত্স দেশ মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে উত্তোলন মৌসুম শুরু হলেও কভিড-১৯-এর কারণে শ্রমিক সংকট থাকায় মজুদ সরবরাহ সংকটে রয়েছে দেশ দুটির উৎপাদকরা। করেনাভাইরাসের সংক্রমণকালে দেশ দুটি থেকে আমদানি অনেক কমে যায়।

পাম অয়েলের আমদানি চিত্র জানতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গত জুলাই-আগস্টে দেশে পাম অয়েল আমদানিও কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে দেশে লাখ ৭৯ হাজার ৭২৪ টন পাম অয়েল আমদানি হয়েছিল। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানি হয়েছে লাখ ২৮ হাজার ৭৭৫ টন। মূলত সর্বশেষ দুই মাসের আমদানিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঘাটতি থাকায় দেশের বিভিন্ন মিল থেকে পাম অয়েলের সরবরাহ তুলনামূলক কম। কারণে দেশের অনেক পরিশোধন মিল পাম অয়েলের সরবরাহ দিতে না পারায় বাজার চাঙ্গা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এক মাস ধরে দেশের অধিকাংশ পরিশোধন মিল থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ জট তৈরি হয়। চট্টগ্রামের এস আলম রিফাইনারি ছাড়া সারা দেশের অন্যান্য মিল থেকে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে কয়েক দিন পর্যন্ত সময় লাগত পাইকারি ব্যবসায়ীদের। মূলত চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় মিলগেটে ভোজ্যতেল সংগ্রহে আসা যানবাহনগুলোকে সময়ক্ষেপণ করতে হচ্ছে। মিলগেট থেকে সরবরাহ সংকট পাইকারি বাজারকে আরো বেশি উসকে দিয়েছে। হঠাৎ উত্থান-পতনের ধারা অব্যাহত থাকলে খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী বড় ধরনের লোকসানের কবলে পড়ে মূলধন হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ভোজ্যতেলের বাজারে এমন উত্থান-পতন নিয়ে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, বৈশ্বিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অনেক বেড়েছে। কারণে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন চাহিদা সরবরাহে জটিলতা থাকলেও বর্তমানে দুটোই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কারণে বাজারে হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় বাজারেও এর প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আমদানি স্বাভাবিক রাখার মাধ্যমে আমদানিকারকরা সংকট এড়ানোর চেষ্টা করছে।

২০০৮ সালে ভোজ্যতেলের বাজারে দামের উত্থান-পতনে বড় লোকসানে পড়ে নুরজাহান, মোস্তফা রুবাইয়াত গ্রুপসহ খাতুনগঞ্জভিত্তিক ভোগ্যপণ্যের কয়েকটি শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপ। বাজারে এক যুগ আগের সে প্রবণতা ফিরে এসেছে করোনাকালে।

পাইকারি বাজার সূত্রে জানা গেছে, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে দেশে পাম অয়েলের বাজারদর ছিল মণপ্রতি হাজার ২০০ থেকে হাজার ৩০০ টাকা। দীর্ঘ ছুটিতে পাইকারি বাজারে ডিও ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন পাম অয়েলের দাম স্থিতিশীল ছিল। তবে জুনের পর থেকে বাজারে ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি বৃদ্ধির পর ডিও লেনদেনও বেড়ে যায়। পাশাপাশি মিলগেট থেকে পাম অয়েল উত্তোলনে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় ভোজ্যতেলের বাজার চাঙ্গা হতে শুরু করে। কয়েক মাস ধরে দাম বাড়তে থাকায় ডিও ব্যবসায়ীরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভোজ্যতেলের ডিও স্লিপ ক্রয়ের জন্য। এভাবে গত কয়েক মাসে ডিও স্লিপ ক্রয়ের পেছনে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী সুমন দে বণিক বার্তাকে বলেন, টানা বৃদ্ধির কারণে ভোজ্যতেলের বিনিয়োগ বেড়ে গেছে। কিন্তু এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় সাধারণ ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকিতে আছেন। দাম আরো কমলে লোকসানের কারণে মূলধন হারানোর আশঙ্কাও রয়েছে তাদের।

খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ডিও পর্যায়ে পাম অয়েলে লেনদেন হয়েছে হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া সুপার পাম অয়েল হাজার ১০০ টাকা এবং সয়াবিন বিক্রি হয়েছে হাজার ৪০০ টাকায়। যদিও এক সপ্তাহ আগেও সয়াবিন লেনদেন হয়েছিল হাজার ৫০০ টাকায় এবং সুপার পাম অয়েল লেনদেন হয়েছিল হাজার ২৮০ টাকায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন