সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে দেশের উন্নয়নই লক্ষ্য —প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিকে বর্তমান সরকার দৃষ্টি দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারপ্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের যে পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে গেছেন সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়, সরকার গঠনের পর থেকে সে নীতিতেই চলছি আমরা। বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ, সেখানে সবার সহযোগিতা একান্তভাবে দরকার। যা- কিছুই করতে যাই না কেন, সবকিছুতে সবার সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন।

গতকাল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত বাংলা ভাষণ স্মরণে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা ফরেন সার্ভিস একাডেমির নবনির্মিত ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে সভায় ভার্চুয়ালি যোগ দেন।

করোনার সময়েও অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত আকারে অব্যাহত রাখা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি দশমিক শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়ার যে লক্ষ্য, সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমরা এবার দশমিক ২৪ শতাংশের মতো অর্জন করতে পেরেছি। তবে আশা করি, আগামীতে আরো বেশি প্রবৃদ্ধি আমরা অর্জন করতে সক্ষম হব। আর সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

মুজিব বর্ষে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংকল্পের কথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, প্রায় ৪০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল, দারিদ্র্যের হার আমরা কমিয়ে সাড়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমরা আরো কমাতে চাই। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষকে একটা সুন্দর জীবন আমরা উপহার দিতে চাই।

বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বে কেউ একা চলতে পারে না। তাই সবার সহযোগিতা আমাদের কাম্য। পাশাপাশি কাউকে কোনো ধরনের সহযোগিতা যদি করতে হয়, আমরা সেটা করতেও প্রস্তুত। বাংলাদেশ সব সময়ই চায় সারা বিশ্বে শান্তি বজায় থাকুক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে নানা ধরনের সংঘর্ষ আছে, সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অধীনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ বাহিনী প্রত্যেকে বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। অনেক সৈনিক জীবনও দিয়ে গেছেন। শুধু একটা কথাই বলব, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ সব সময়ই প্রস্তুত।

কূটনীতিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের বিশ্বে কূটনৈতিক মিশনের দায়িত্বও পরিবর্তন হয়েছে। এখন শুধু রাজনৈতিক কূটনীতি না, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক কূটনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো, সবার সঙ্গে মিশে কীভাবে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করা যায়, উন্নয়ন করা যায়, একে অন্যকে সহযোগিতার মাধ্যমে কীভাবে বিশ্বে শান্তি আনা যায়এসব বিবেচনায় নিয়েই আমাদের কূটনীতিটা চালাতে হবে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, জাতির পিতা জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, দিনটি শুক্রবার ছিল। সেই সময় তিনি যে কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন, আমরা কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেই ইস্যুগুলো নিয়েই কাজ করছি। তিনি পরিবেশের কথা বলে গিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে মানুষের ক্ষতি সেটা কীভাবে রোধ করা যায় সেই কথা বলেছেন। তিনি দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলেছেন। মানবাধিকার ন্যায়বিচারের কথা বলেছেন। আর্থসামাজিক উন্নয়ন, রোগ-শোক, নানা ধরনের দুর্যোগে ক্ষতি কাটিয়ে মানবজাতিকে রক্ষায় বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও তিনি জানিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর তিনি (বঙ্গবন্ধু) হাতে পেয়েছিলেন সাড়ে তিন বছর। সাড়ে তিন বছরে তিনি দেশকে যেভাবে গড়ে তুলেছিলেন, আমরা যদি তার গৃহীত সব পদক্ষেপ পর্যালোচনা করি, তাহলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয় যে এত কম সময়ের মধ্যে তিনি এত কাজ কীভাবে করে গেলেন। জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রাপ্তি তার কূটনীতি, এটা তার সাফল্য বিরাট একটি অর্জন। পৃথিবীর ১২৬টি দেশের সমর্থন অর্জন করেছিলেন। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংস্থারই সদস্যপদ বাংলাদেশ পেয়েছিল তারই সময়ে।

তিনি বলেন, বিজয়ী জাতি হিসেবে বাঙালি জাতির একটা মর্যাদা ছিল। কিন্তু সেই মর্যাদাটা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। যিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেলেন, মাটিতেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। ১৫ আগস্ট শুধু যে একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছিল তা নয়, আমাদের পরিবারের সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমার ১০ বছরের ছোট ভাইটিকেও ছাড়েনি। শুধু আমরা দুটি বোন, আমি রেহানা বিদেশে ছিলাম বলেই বেঁচে গিয়েছি। রিফিউজি হিসেবে আমাদের ছয় বছর থাকতে হয়েছে বিদেশের মাটিতে।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠনের পর শুরু করি বলতে গেলে যেখানে জাতির পিতা রেখে গিয়েছিলেন সেখান থেকেই। তখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। আমি তাকে বললাম আমাদের একটা ট্রেনিং একাডেমি খুব দরকার। ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা একাডেমি ছাড়া সার্বিক প্রশিক্ষণ দেয়া যায় না। তখন আমরা দুটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করিএর একটি হলো জুডিশিয়াল সার্ভিসের জন্য, আরেকটা হলো ফরেন সার্ভিসের জন্য।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ৫৪ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশ, যেখানে ১৬ কোটির বেশি মানুষ। ছোট্ট একটা ভূখণ্ডে বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। পৃথিবীর অনেক দেশ অনেক কাজে সাফল্য দেখাতে পারে। যদিও আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই। বরং আমরা জনগণকে আমাদের মূলশক্তি হিসেবে দেখি। আবার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয়।

মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও মোকাবেলা করতে হয় জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, আমাদের সব পরিস্থিতিই মোকাবেলা করতে হয়। সেটা করতে সক্ষম হয়েছি, কারণ আমরা জনগণের আস্থা, বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। আওয়ামী লীগের ওপর দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাস আছে। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারছি বলেই আজকে উন্নয়নগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে করতে পারছি। যার সুফল দেশের জনগণ ভোগ করছে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, জাতির পিতা তার ভাষণে দেশের দুঃখী মানুষের কথা সার্বিক উন্নয়নের কথা বলেছিলেন। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বঞ্চিত মানুষের কথাও তিনি বলে গেছেন। আমরা সেটা বিশ্বাস করি। তাই আমাদের উন্নয়নের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে তৃণমূলের মানুষ। একেবারে গ্রাম পর্যায়ে যে মানুষটি সবচেয়ে অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে তার ভাগ্যটা পরিবর্তন করা।

মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি নিলেও নভেল করোনাভাইরাসের কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একটা হচ্ছে পরিবেশ রক্ষার জন্য সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ করব। এটা আমাদের দলের থেকেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি মানুষও গৃহহারা থাকবে না। যারা ভূমিহীন, গৃহহীন তাদের আমরা ঘর করে দেব। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে এল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, নদীভাঙন, এতে আরো বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কিন্তু আমরা সবগুলো করব এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। পুষ্টির নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করছি। করোনা মোকাবেলার জন্য আমরা ৩১ দফা দিকনির্দেশনা দিয়েছিলাম। পাশাপাশি আমরা বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছি যাতে আমাদের আর্থিক দিকটা সচল থাকে। এটা আমাদের জিডিপির শতাংশের কাছাকাছি। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি আমাদের খাদ্যের ওপর। কারণ আমি জানি নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনোভাবে যাতে সেই দুর্ভিক্ষের ছোঁয়া না লাগে, তাই আমরা যতটুকু পারি খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ দরিদ্র মানুষকে বিনা পয়সায় খাদ্য বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি। খাদ্য নিশ্চয়তা দেয়ার চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

অনুষ্ঠানে গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ফরেন সার্ভিস একাডেমি প্রান্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন