বিপর্যস্ত এসএমই খাত

পুনরুজ্জীবনে সর্বত পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি

গত প্রায় দেড় দশকে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগ তথা এসএমই খাত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাতে অর্থনীতির অন্য খাতগুলোর মতো এরও আকস্মিক ছন্দপতন ঘটে। বিশেষত করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধে মার্চের শেষ থেকে গৃহীত প্রায় দুই মাসের লকডাউনে ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতিতে পড়েন খাতের উদ্যোক্তারা। লকডাউনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চলতি বছরে বড় দুই মৌসুম ঈদুল ফিতরে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারেনি তারা। ফলে লগ্নীকৃত বিনিয়োগ উঠে না আসায় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন খাতের অনেক উদ্যোক্তা, বিশেষ করে গ্রামীণ উদ্যোক্তারা। কাজ হারিয়েছেন বিপুলসংখ্যক কর্মী। কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে গেছে, আবার কিছু প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে লড়াই করছে। আর্থিকভাবে তুলনামূলক নাজুক ভিত্তির হওয়ায় খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। সংগত কারণে সরকার খাতের দ্রুত পুনরুদ্ধারে গত এপ্রিলেই ২০ হাজার কোটি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। তবে সংজ্ঞায়নগত অস্পষ্টতা, ক্রেডিট গ্যারান্টির অনিশ্চয়তা, কঠিন শর্ত ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর উচ্চ পরিচালন ব্যয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক লেনদেনে সংযোগহীনতাসহ কিছু কারণে খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকেরই প্রণোদনা সুবিধার অর্থ পেতে ভোগান্তি হচ্ছে। বলা চলে, খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অর্থায়ন প্রাপ্তিই হলো বর্তমানে বড় সমস্যা। সমস্যা নিরসনে ঋণের শর্ত শিথিল ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বেগবান করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ বিতরণে যুক্ত করতে হবে। কিন্তু ঋণ শর্ত কিছুটা নমনীয় করার উদ্যোগ নেয়া হলেও যথাযথ তত্ত্বাবধানের ঘাটতিতে খাতে এখনো ঋণ বিতরণ কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না। অবস্থায় ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তিতে আর কী কী প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান, সেগুলো চিহ্নিতপূর্বক বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

চলমান মহামারীতে আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো ফুটে উঠেছে। নতুন স্বাভাবিকতায় এগিয়ে যেতে হলে প্রয়োজনীয় সংস্কারপূর্বক এসব দুর্বলতা অবশ্যই দূর করতে হবে। নইলে ঘুরে দাঁড়ানো খুব একটা সহজ হবে না। এক্ষেত্রে বড় সহায় হতে পারে এসএমই খাত। আমাদের অর্থনীতিতে এখনো খাতের অবদান সম্ভাবনার তুলনায় কম। বর্তমানে মোট জিডিপিতে খাতের অবদান মাত্র ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ ভারতে তা ৮০ শতাংশ এবং চীনে ৬০ শতাংশ। সেদিক থেকে দেশে অর্থনীতিতে অবদান আরো বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। ভারত, চীন কিংবা আমাদের সমপর্যায়ের দেশ, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এসএমই খাতের উন্নয়নে কী ধরনের সহায়ক নীতি নিয়েছে, সামগ্রিক নীতি বিন্যাসে কী ধরনের রূপান্তর ঘটিয়েছে, তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, মোট জিডিপিতে খাতের অবদান এখনো কম হলেও মোট কর্মসংস্থানে এর অংশ বেশ উল্লেখযোগ্য। দি ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন ফর স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস ইন এশিয়া পরিচালিত এক গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানে এসএমইর অবদান ৩৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তার মানে খাতের উদ্যোগগুলো শ্রমঘন। সেই বিবেচনায় এসএমইর আশু ঘুরে দাঁড়ানো এবং এর দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন অর্থনীতির স্থায়িত্বশীলতা নিশ্চিত অধিক মাত্রায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি উভয় দিক থেকে জরুরি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ২৬ শতাংশ এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের ৪৮ শতাংশ রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। এটিও আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি আশাপ্রদ দিক। সঠিকভাবে খাতের বিকাশ ঘটানো এবং হূত ছন্দ ফেরানো গেলে আমাদের রফতানি আয় আরো বাড়ানো সম্ভব। কাজেই করোনার প্রভাব থেকে এসএমই খাত যাতে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্য অংশীজনদের পারস্পরিক সহযোগিতা সমন্বয় বাড়িয়ে কার্যকর পদক্ষেপ কাম্য। খাতটির বিরাজমান সংকট উত্তরণে সাম্প্রতিক এক ওয়েবিনারে এসএমই নীতিমালা ২০১৯ বাস্তবায়ন, এসএমই উদ্যোক্তাদের সেবা প্রদানে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ নজর দেয়া, ডিজিটাল আর্থিক সেবা শক্তিশালী করা, ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড তৈরি করে সিএসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ বিতরণ নজরদারি করা এবং এসএমই উদ্যোক্তাদের পণ্য রফতানিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দক্ষতা বৃদ্ধি করার সুপারিশ জানানো হয়েছে। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে এসএমই ফাউন্ডেশন সরকার আরো সক্রিয় হবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন