বাড়িতেই ভালো শিখছে শিশু, স্কুল থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন অনেক অভিভাবক!

বণিক বার্তা অনলাইন

হোমস্কুলে কতটুকু শিখছে শিশুরা? আসলেই কি শিখছে? আর লকডাউনে বিদ্যালয় বন্ধের সময় শিখতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যাতে পড়ছে তারা?

চলমান করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকদের এসব প্রশ্ন তাড়িত করছে। করোনা পরিস্থিতির শুরুর দিকে স্কুলগুলো যখন বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে শিশুদের অনলাইনে পাঠদানের বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয় তখন সে নিউ-নরমালের সঙ্গে অভিভাবকদের মানিয়ে চলাটা সহজ ছিল না। কিন্তু করোনা মানুষের অতি ব্যস্ত জীবনকে যেভাবে ধীরেসুস্থে মানিয়ে নেয়ার শিক্ষা দিয়েছে সেখানে বদলে গেছে অনেক কিছু। কভিড পূর্ববর্তী দিনগুলোতে ব্যস্ততা যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের কিংবা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কে একটি স্পষ্ট রেখা টেনে যাচ্ছিল, তখন হোম অফিস, হোম স্কুল মানুষের পারস্পারিক বোঝাপড়ার মাঝখানের দূরত্বের দাগগুলোকে যেন আলতো করে তুলে দিচ্ছে।  

গত জুনে তিনজন নারী ও পাঁচজন পুরুষের মধ্য থেকে একজন করে যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরে সন্তানদের হোম স্কুল সংক্রান্ত ভোগান্তি বিষয়ে অভিযোগ করেন। তারা আরো জানান যে, হোম স্কুল ব্যবস্থায় তাদের সন্তানদের শিখতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। অর্ধেকেরও বেশি অভিভাবক জানিয়েছিলেন, তাদের সন্তানদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে হোম স্কুল নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

তবে সেপ্টেম্বর টার্ম থেকে অভিভাবকরা শিশুদের হোম স্কুলের সঙ্গে ধাতস্থ হওয়ার পাশাপাশি চমত্কারভাবে মানিয়েও নিয়েছেন। অনেক অভিভাবক তো এ কথাও অকপটে শিকার করেছেন যে, শুরুর দিকে হোম স্কুল হতাশ করলেও পরবর্তীতে এটি মূল্যবান একটি শিক্ষা দিয়েছে তাদের। হোম স্কুলের সুফল উপলব্ধি করে কিছু অভিভাবক এখন সন্তানকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনার মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। কেননা লকডাউন তাদের রোজকার একঘেঁয়ে রুটিন থেকে সরিয়ে এনে সময়কে খানিকটা স্বস্তি ও স্থীরতায় প্রবাহিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। বাইরের পরিসর থেকে ঘরে শিশুরা অনেক বেশি নিরাপদ এখন। তাছাড়া সাচ্ছন্দ্য ও ভাবনাহীন রুটিনে শিশুরা এখন অনেক বেশি সৃষ্টিশীল, যা তাদের নতুন অনেক কিছু শেখার সুযোগ করে দিয়েছে। 

একমাত্র সন্তান নিয়ে সিঙ্গেল মাদার মারি-অ্যান চিকেরেমা চিরোমোর বসবাস লন্ডনে। কাছাকাছি তার কোনো নিকটাত্নীয়ও থাকে না। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক ইওয়াইয়ে কর্মরত তিনি। নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্বব্যাপী নারীদের আরো বেশি প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা বিষয়ক এক কর্মসূচির। তিনি তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান লুকাকে এ অবস্থায় স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গার্ডিয়ান পত্রিকাকে মারি-অ্যান বলেন, লকডাউন শুরুর প্রথম দিন থেকে আমরা দুজন একসঙ্গে আছি। ওর সঙ্গে আমার দূরত্ব কমেছে, আমরা দারুণভাবে কাছাকাছি এসেছি। ও খুব কৌতূহলী। সকালে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে নতুন কিছু করার দুঃসাহসিক তাড়না নিয়ে। 

লুকার নার্সারি ক্লাস থেকে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মারি-অ্যানের। অফিস ও ঘরের কাজ সামলে মাসে বড় জোর একদিনের জন্য সন্তানকে নিয়ে সিনেমা দেখা বা ঘুরতে যেতে সময় বের করতে পারতেন তিনি। লকডাউন শুধু তাকে তার সন্তানের সঙ্গে চমত্কার সময় কাটানো নয় বরং সন্তানের বেড়ে ওঠা দেখারও সুযোগ করে দিয়েছে। স্কুল করে এসে যা মোটেও সম্ভব হতো না বলে মনে করেন তিনি। লুকাকে স্কুলে ভর্তি করার আগে অ্যাডভেঞ্চারধর্মী কিছু শিশুতোষ বই এনে দিয়েছিলেন। সময়ের অভাবে এতোদিন সে বইগুলো ছুঁয়ে দেখারও সুযোগ হয়নি তাদের। তবে এখন বেশ আনন্দ করেই বইগুলো পড়ছেন তারা। 

অ্যাজমার সমস্যা রয়েছে লুকার। তাই কভিড পরিস্থিতিতে স্কুলে পাঠানোর ঝুঁকি নিতে রাজি নন মারি-অ্যান। তাছাড়া এভাবে তার অফিসের কাজেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। দেখা যায় লুকা ঘুমিয়ে পড়লে মিটিং সেমিনারের মতো কাজগুলো তিনি সেরে ফেলেন। তাছাড়া কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ থাকাতে সহকর্মীরাও তার পরিবর্তীত সময়সূচি সানন্দেই গ্রহণ করেছেন। 

অ্যান্টোনিয়েট ফ্রেয়ারসন ও তার আট বছরের মেয়ে অ্যালেনের লকডাউন ও হোম স্কুলের অভিজ্ঞতাও দারুণ! অ্যালেনের কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে গণিত আর ইংরেজীতে। কিন্তু লকডাউনে একসঙ্গে সময় কাটিয়ে ভিন্ন এক অ্যালেনকে আবিষ্কার করেছেন ফ্রেয়ারসন। অংক কষতে কষতে অ্যালেন যখন একঘেঁয়েমিতে ভোগে ফ্রেয়ারসন তখন তাকে নিয়ে বাইরে যান। পাখি, প্রজাপতি, ফড়িংসহ আশপাশের বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ গোনেন। এই করতে করতে মেয়েকে বার চার্ট কীভাবে করতে হয়ে সেটিও শিখিয়ে ফেলেছেন।

ফ্রেয়ারসন কিছুটা অপসোস করেই বলেন, অ্যালেনের শৈশব থেকেই যদি তিনি তার সঙ্গে থাকতেন তাহলে বোধকরি ওর মানসিক বিকাশ আরো ভালো হতে পারতো। কিছুদিন আগে অ্যালেনের শিক্ষকদের সহায়তায় একটি মূল্যায়ন পত্র তৈরি করেছেন তিনি, যেখানে দেখা যাচ্ছে মূল-পত্রগুলোতে অ্যালেন তার বয়সভিত্তিক প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বিষয়টি হোম স্কুল নিয়ে পুনর্বার চিন্তা করতে শিখিয়েছে ফ্রেয়ারসনকে। অ্যালেন যাতে মাধ্যমিকে ভালো করে সে জন্য তিনি স্কুলের পাঠ্যসূচি অনুসরণ করবেন কিন্তু একইসঙ্গে তিনি অ্যালেনের জন্য হোম স্কুলের গুরুত্বও অনুভব করছেন। শুধু তাই-ই নয়, তিনি একটি হোম-এডুকেশন গ্রুপেও যোগ দিয়েছেন। 

মারি-অ্যান ও লুকা কিংবা ফ্রেয়ারসন-অ্যালেনের মতো এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। অনেক অভিভাবক নতুন করে বিষয়গুলো উপলব্ধি করছেন যে, কভিড পূর্ববর্তী রোজকার স্কুলের চেয়ে ঘরে বসে তাদের সন্তানেরা আগের চেয়ে অনেক ভালো শিখছে। বাধ্য হয়ে নয়, আনন্দ নিয়েই শিখছে। হোম স্কুল ব্যবস্থায় শিশুরা কীভাবে নিজেদের সেরাটা দিতে পারে তা আবিষ্কার করতে শিক্ষককেরাও কিন্তু বিভিন্ন পদ্ধতির অন্বেষণ শুরু করতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকে।

যুক্তরাজ্যের হরিজনস হোমস্কুলে যেমন লকডাউনে পৃথকভাবে শেখানোর চেয়ে শিক্ষার্থীদের একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে শেখানোর পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা অনেকক্ষেত্রে ফলপ্রসূও হয়েছে।

যুক্তরাজ্যে স্বল্প পরিসরে স্কুল খুলতে শুরু করলেও অনেক অভিভাবকই সন্তানদের পাঠাতে চাইছেন না। ঠিক কতজন অভিভাবক স্কুল থেকে তাদের সন্তানদের ছাড়িয়ে এনেছেন সে সম্পর্কিত মোট হিসাব জোগার করা না গেলেও দেখা যাচ্ছে অনেক অভিভাবকই হোম স্কুল বিষয়ক তথ্যের খোঁজ করছেন। 

ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্ল্যাক সাপ্লিমেন্টারি স্কুলের ব্রাদার নিয়া ইমারার ভাষ্য অনুযায়ী, আফ্রিকান অভিভাবকেরা তাদের কাছে এসে একবার নয়, কয়েকবার করে হোম স্কুলের খবর নিচ্ছেন। কেননা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, কভিড পরিস্থিতি কালো মানুষদের সঙ্কটগুলোকে বাড়িয়ে তুলেছে। তাছাড়া স্কুলগুলোও প্রায়শই বর্ণ বিদ্বেষ বা বাচ্চাদের বুলিং রুখতে অপারগ এবং অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের চাহিদাও অনেকসময় তারা পূরণ করতে পারছে না। এ অবস্থায় হোম স্কুলেই স্বস্তি খুঁজে ফিরছেন অনেক অভিভাবক। 

দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন