বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

বৈশ্বিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা

মো. শামীম আলম খান

২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস। আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বেই দিবসটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। শুরুতেই একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, ফার্মাসিস্ট আসলে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কাদের বলা হচ্ছে, যারা কোনো সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ থেকে বি ফার্ম (ব্যাচেলর অব ফার্মেসি) পাস করেন, তাদের বলা হয় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বা -গ্রেড ফার্মাসিস্ট। এসব -গ্রেড ফার্মাসিস্টকে ফার্মেসি কাউন্সিল অব বাংলাদেশ থেকে -গ্রেড ফার্মাসিস্ট রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেয়া হয়, যা পরবর্তী কর্মজীবনে অনেক ক্ষেত্রে অবশ্যই দরকার এবং অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

এবার আসি বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস সম্পর্কে। সারা বিশ্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ/ফ্যাকাল্টি, ফার্মাসিস্টদের অঙ্গসংগঠন, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিসহ ওষুধ সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন করে। করোনা মহামারীর কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দিবসটি ভিন্নভাবে পালিত হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব মাথায় রেখে দিবসসংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ড ভার্চুয়ালি সম্পন্ন করা হচ্ছে। এটি ১০ম বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস। ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশনের (এফআইপি) উদ্যোগে ২০০৯ সালে ইস্তাম্বুল, তুরস্কের একটি মিটিংয়ের মাধ্যমে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, ২৫ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশনের (এফআইপি) জন্মদিন, যে সংগঠনটি ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেজন্য ২৫ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আজ ১০ম বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস।

এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় Transforming Global Healthবৈশ্বিক স্বাস্থ্য সর্বব্যাপী ছড়িয়ে দাও। লক্ষ্যে সারা বিশ্বে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা কাজ করে যাচ্ছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশনের (এফআইপি) প্রেসিডেন্ট ডোমিনিক জর্ডান বলেন, আমাদের লক্ষ্য নিরাপদকার্যকরী, মানসম্পন্ন সহজলভ্য ওষুধ সারা বিশ্বের প্রতেকের কাছে পৌঁছাতে ফার্মাসিস্টদের অবদান সঠিকভাবে উপস্থাপন করা। আমার সুযোগ হয়েছিল এফআইপির একজন সদস্য হিসেবে ২০১১ সালে হায়দরাবাদ, ভারতে এফআইপির ৭১তম আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার। সারা বিশ্বের সহস াধিক গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট, যারা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বিভিন্ন শাখা যেমন প্রডাকশন, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স, প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, রেগুলেটরি অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি), ওষুধ বিক্রয় বিপণনে কর্মরত, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওষুধ বিজ্ঞানী, ওষুধ প্রশাসনে কর্মরত, রিটেল গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট, হসপিটাল ফার্মাসিস্টসহ আরো অনেকের মিলনমেলা। প্রত্যেকে তাদের গবেষণালব্ধ বিষয়গুলো বৈজ্ঞানিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। এদের ভেতর নতুন ড্রাগ ডেভেলপমেন্টের উপস্থাপনগুলো বৈশ্বিক স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রতি বছর এফআইপি ধরনের বৈজ্ঞানিক সম্মেলন একাধিক করে থাকে। এসব বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে জানা যাবে সারা বিশ্বে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা কীভাবে Comprehensive Health Service অর্থাৎ একটি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা বলতে যা বোঝায়, সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। উন্নত বিশ্বে এসব গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট এমবিবিএস ডাক্তারের পাশাপাশি রোগীর স্বাস্থ্যসেবা রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে ওষুধ সম্পর্কিত উপদেশ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা থেকে মুক্তিলাভের পর করোনাকালীন তিনি যাদের সেবা, উপদেশ সহযোগিতায় আরোগ্য লাভ করেছেন, তাদের কথা বলতে দিয়ে ফার্মাসিস্টদের কথাও উল্লেখ করেছেন।

এবার আসা যাক এই করোনাকালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় কীভাবে ভূমিকা রাখছেন সে বিষয়ে। আপনারা জানেন, আমাদের দেশে মার্চের দিকে যখন করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায় এবং মার্চ-এপ্রিলের দিকে লকডাউন দেয়া হলো, তখন বেশির ভাগ অফিস কারখানা বন্ধ থাকলেও ওষুধ উৎপাদন এবং বিক্রয় বিতরণ চালু ছিল। সত্যিকার অর্থে এটা বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, এটা ছিল মানুষের প্রতি, করোনাসহ অন্যান্য রোগীর প্রতি সামাজিক মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে। আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা মুখে মাস্ক বেঁধে নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করে শুধু রোগীরা যাতে তাদের কাঙ্ক্ষিত ওষুধ প্রয়োজনমতো বাসার সামনের ওষুধের দোকান থেকে পায়, তার উৎপাদন সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে চলে গেছেন নিজ নিজ ওষুধ কারখানায়; ঢাকা থেকে টঙ্গী, গাজীপুর, কালিয়াকৈর এমনকি নারায়ণগঞ্জ, যেখানে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি ছিল সবচেয়ে বেশি।

যখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অথবা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক রোগ নির্ণয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে করোনা রোগীর চিকিৎসায় নতুন ওষুধের কথা বলা হচ্ছে, তখনই আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা যত দ্রুত সম্ভব প্রস্তুত করে সরবরাহ নিশ্চিত করছেন। আপনারা সবাই আইভারম্যাকটিন, হাইড্রোক্সিলক্লোরোকুইন বা ডক্সিসাইক্লিনের কথা জানেন। ওষুধগুলো খুবই পুরনো। কিন্তু নির্দেশনা আসায় করোনা চিকিৎসায় নতুন করে ব্যবহার হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু একটি কথা না বললেই নয়, অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ যেমন রেমডিসিভির, ফেভিপিরাভিরের মতো ওষুধ অল্প সময়ে উৎপাদন বিতরণ নিশ্চিত করেছে যে বেক্সিমকো ফার্মা, এসকেঅ্যান্ডএফ, স্কয়ার ফার্মা, ইনসেপ্টা ফার্মা, হেলথ কেয়ার, পপুলার ফার্মা, বিকন ফার্মা, এসিআই, একমি, রেডিয়েন্ড ফার্মা ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন কোম্পানি, তাদের গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখেন। শুনেছি, রেমডিসিভির আমাদের দেশে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও করোনা রোগীর চিকিৎসায় রফতানি হচ্ছে। রফতানি কথাটি আসায় একটি কথা শেয়ার করতে চাইছি। করোনার কারণে সারা বিশ্বে লকডাউন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রফতানি আয় কমে গেছে। ওষুধ শিল্পও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০১৯-২০ সালে বাংলাদেশের ওষুধের ডমেস্টিক মার্কেট ২৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে এবং ২০১৮-১৯-এর রফতানির পরিমাণ ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের দেশে উৎপাদিত ওষুধ এখন ১৪৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। আর এই ওষুধের গুণগত মান এবং উৎপাদন নিশ্চিত করতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। গত সপ্তাহে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চুয়াল মিটিংয়ে আমন্ত্রিত প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করে জানতে পারি, করোনাকালীন রফতানির জন্য যেসব পণ্য আছে, তাতে ওষুধ শিল্পই সর্বাপেক্ষা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এবং ওই মিটিংয়ে ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের মেধা, শ্রম দক্ষতাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট হিসেবে বিষয়টি আমার জন্য সত্যিই আনন্দের। এখানে উল্লেখ্য, একটি শিল্প খাত, যা গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টনির্ভর এবং দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে ওষুধ রফতানিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

শেষ করার আগে হসপিটাল গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনারা লক্ষ করেছেন যে আমাদের দেশে বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল যেমন এভারকেয়ার, ইউনাইটেড, স্কয়ারসহ অন্যান্য স্বনামধন্য হাসপাতালে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট বা ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট কর্মরত আছেন। আসলে উন্নত দেশগুলোয় এটা নতুন নয়, যা আমি যুক্তরাজ্যের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এসব গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট তাদের ফার্মাকোলোজিক্যাল, টক্সিকোলোজিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি, বায়োফার্মাসিটিকস সমৃদ্ধ জ্ঞান, যা তারা তাদের বি ফার্ম/এম ফার্ম ক্লাসে শিখে আসেন, পরবর্তী সময়ে ইন্টার্নি/ইনপ্যাল্ট ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে রোগীর স্বাস্থ্যসেবায় নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। রোগীর ওষুধবিষয়ক জিজ্ঞাসা যেমন ডোজ বা মাত্রা, মাত্রার সমন্বয়, ওষুধ সেবনের নিয়মাবলি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ যাবতীয় নির্দেশাবলি রোগীকে দিয়ে থাকেন। সরকারি হাসপাতালগুলোয়ও যদি গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে সঠিক নিয়োগ দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের সব স্তরের রোগীদের জন্য পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার এক বিশেষ দিক উন্মোচন হবে। আশা করি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতিনির্ধারকরা গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের ভূমিকাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেবেন।

তাই এই বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবসে একটি কথাই বলতে চাই, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ছড়িয়ে দিতে এবং একটি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের মুল্যায়ন করতে হবে এবং এদের জ্ঞান, শিক্ষা দক্ষতায় দেশের ওষুধ শিল্প খাত যেমন উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাবে, ঠিক তেমনি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সর্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে। আর এটাই হচ্ছে বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবসের লক্ষ্য উদ্দেশ্য।

 

মো. শামীম আলম খান: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক কনসালট্যান্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন