বাংলার রন্ধনশিল্পের ইতিহাসে বিস্মৃত যে ‘গণহত্যার ইতিহাস’

বণিক বার্তা ডেস্ক

১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরের এক উষ্ণ সকালে ছোট একটি থলেতে অল্প কিছু চাল নিয়ে চাঁদ আলী খামারু আট মাইল পথ পায়ে হেঁটে পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুরে তার বাবার কাছে পৌঁছান। এরপর জঙ্গল থেকে তুলে আনা কচু শাক, আর ছোট ছোট শামুক সিদ্ধ করে পাতলা ঝোলের মতো তৈরি করে তা দিয়ে পরিবারের সবার উদরপূর্তির ব্যবস্থা করেন। 

বাংলার মানুষের কাছে পরিচিত সেই সময়টা ‘পঞ্চাশের আকাল’ নামে! ভারতবর্ষে অনাহারে মরেছে লাখ লাখ মানুষ, বিশেষ করে দুই বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই মহামারীর নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের। ভারতীয় লেখিকা মধুশ্রী মুখার্জি  তার ‘চার্চিল’স সিক্রেট ওয়ার’ গ্রন্থে এমনটিই বলেছেন।

তত্কালীন বার্মা (মিয়ানমান) তখন ভারতে চাল আমদানির বড় উৎস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা দখল করে নিলে চাল আমদানি ব্যাহত হয়। তখন সেনাবাহিনী ও রণক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য বিপুল খাদ্য মজুদ করতে শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। ফলে চাল তখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের নথিতে দুর্ভিক্ষে এক লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা উল্লেখ থাকলেও ইতিহাসবিদদের মতে, ওই আকালে ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

একদিকে বার্মা থেকে চাল আমদানি বন্ধ, এর মধ্যে ১৯৪২ সালে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে শীতকালীন শস্যের বড় ক্ষতি বাংলা দুর্ভিক্ষকে আরো ভয়াবহ করে তোলে। এই দুর্ভিক্ষ স্থায়ী হয় ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত। 

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট, ব্রিটিশ উপনিবেশের লুটপাট আর চার্চিলের বর্ণবাদী নীতি বিশেষ করে বাংলাকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। জনম মুখার্জি তার গ্রন্থ ‘হাংরি বেঙ্গল’ এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, জাপানি সেনাদের হাতে যাতে কোনোভাবে খাদ্য না পৌঁছায় সে জন্য ব্রিটিশ সরকার প্রায় ৪০ হাজার টন চাল বাংলা থেকে সরিয়ে নেয়। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা চার্চিলকে জানালে তিনি বলেছিলেন, গান্ধী কেন এখনো মরেনি! তিনি বাংলার মানুষকে ইঁদুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বলেও জানা যায়। 

চাল যাতে কোনোভাবেই পাচার নয় হয় সে জন্য ব্রিটিশরা ধ্বংস করে ফেলে নৌকা আর গরুর গাড়ি। মিয়ানমার সীমান্তের নৌকা, নৌযানগুলো বায়েজাপ্ত করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এভাবে সরবরাহ শৃঙ্খল সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়। বাংলাদেশী ইতিহাসবিদ ইফতেখার ইকবালের তথ্য মতে, ওই সময় ব্রিটিশরা প্রায় ৬৫ হাজার নৌকা ধ্বংস করে দেয়। যেখানে নদীমাতৃক বাংলার প্রধান বাহন ছিল নৌকা। এই জলযানই ছিল তাদের জীবিকার একমাত্র সহায় বা লাইফলাইন। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা।

বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলগুলো বন্যাকবলিত হলে স্থানীয়রা নৌকার উপরই বসবাস করতেন। এই মানুষগুলো অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে। পূর্ববাংলার মূল ভূখণ্ড থেকে নৌকা ছিনিয়ে নিয়ে ব্রিটিশরা রীতিমতো গ্রামীণ অঞ্চলকে ধ্বংস করে দেয়। গ্রামের জেলেরা সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েন। ফলে বাজারেও মাছের ঘাটতি দেখা দিল। এভাবেই ব্রিটিশ নীতি গ্রামীণ অবকাঠামো ভেঙে দিয়েছিল।  মাছে-ভাতে বাঙালির পাত শূন্য হয়ে পড়ল।

চালের সঙ্কট বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্র লোকেরা ঘর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ভারতের মেদিনীপুরে খাদ্যদাঙ্গা শুরু হলে সেখানকার অনেক অধিবাসী তখন সুন্দরবনের দিকে চলে যায়। হাজার হাজার মানুষ খাবারের আশায় গ্রামাঞ্চল থেকে কলকাতায় পাড়ি জমায়। গৃহস্থ বাড়ির দ্বারে দ্বারে ‘মা, ফ্যান দাও না গো’ বলে থালা হতে ঘুরে ফিরতো দরিদ্র অনাহারী মানুষ। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে মন্বন্তরের চিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

দুর্ভিক্ষে চালের সঙ্কটে বিকল্প খাবারের উদ্ভাবন ঘটতে থাকে। ঢাকার পিএইচডি গবেষক মাহরুবা মৌটুসীর গবেষণা মতে, পূর্ববাংলার লোকেরা তখন আটার রুটি খেতে শুরু করে। পূর্ববঙ্গে সবসময়ই আলু উত্পাদিত হতো। ভাতের অভাবে তখন আলু সেদ্ধ করে সামান্য লবণ দিয়ে খাওয়া হতো। দুর্ভিক্ষের ওই দিনগুলোতে বাংলার এ মানুষদের পেট ভরতে হতো বন-জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা শাক-পাতা সিদ্ধ কিংবা শামুক সিদ্ধ করে পাতলা ঝোলের তরকারী দিয়ে। 

চাঁদ আলী খামারুর সেই শামুক সিদ্ধ খাবারটি নাম ছিল গুগলি। এ সময়ের প্রচলিত খাবার পানি খিচুড়ি (পাতলা খিচুড়ি), আলু ভর্তা আর আলুর তরকারী পরবর্তীতে সাধারণ খাবার হিসেবে বাঙালির ঘরে স্থান করে নেয়। কচি ঘাস সেদ্ধ, বিভিন্ন গাছের পাতা, যেমন পাট পাতা সিদ্ধ খেয়েও ক্ষুদা নিবারণ করেছে মানুষ। খাদ্য তালিকায় ছিল বুনো আলুও, অনেকে বলেন মেটে আলু। 

কচুশাক এখনো বাংলার মানুষের পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস

চালের সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে মাছ, তেল, কাপড়ের দামও প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়। চাঁদ আলী খামারুর দুর্ভিক্ষের দিনলিপি মুদ্রিত রয়েছে বাঙালি লেখক শৈলেন সরকারের ‘মন্বন্তরের সাক্ষী’ বইটিতে। আগেও কাচু শাক কিংবা গুগলি খাওয়ার প্রচলন ছিল কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময় দরিদ্রের অন্যতম উপায় হয়ে ওঠে এ খাবারগুলো। এ দুটি খাবার ছাড়াও চাঁদ আলী খামারু আকালের ওই দিনগুলোকে খিচুড়ি খাওয়ার কথা বলেছেন। সামান্য ডাল ও চালের মিশ্রণে তৈরি এ খাবারটি তার গ্রামের কাছে ত্রাণশিবিরে পরিবেশন করা হতো। জমিদার বা অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোর কাছে ভাতের ফেন (মাড়) চাইতে যেতেন খামারু। দিনের পর দিন অনাহারে থেকে তার বাবার এমন অবস্থা হয়ে পড়ল যে, পেটে এক মুঠো ভাত পড়াতে তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। রাস্তার পাশে বসেই মারা গেলেন!

দুর্ভিক্ষের প্রায় ৭৭ বছর পার হলেও বাঙালি পরিবারগুলোর হেঁসেল থেকে কিন্তু হারিয়ে যায়নি কচুশাক আর পাতলা খিচুড়ি। আজও বেশ প্রচলিত এ খাবারগুলো। যদিও বেশ কিছু বৈচিত্র্য যোগ হয়েছে এসব খাবারের রেসিপিতে।

দুর্ভিক্ষ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসে পরবর্তীতে বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছে। আকাল বা দুর্ভিক্ষকালীন উদ্ভাবিত খাবারগুলোই  প্রচলিত কিংবা জনপ্রিয় খাবার হিসেবে তাদের রন্ধনশিল্পে জায়গা করে নিয়েছে। যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্ভিক্ষের সময় নেটল লিফ (অনেকটা বিছুটি পাতার মতো) রুটি ও স্যুপ তৈরিতে ব্যবহার শুরু হয়। আজও এর প্রচলন রয়েছে। কম্বোডিয়ায় খেমার রুজ শাসনামলে দুর্ভিক্ষের সময় একধরনের মাকড়সা ভেজে খেতে শুরু করে ক্ষুধার্ত মানুষ। খাবারটি নাকি আজও বেশ উত্সাহ নিয়ে তারা খায়। গ্রেট ডিপ্রেশনের (মহামন্দা) সময় আমেরিকাতে মাংসের চাহিদা পুরণে যে খাবারটি পরিচিতি পায় সেটি হলো স্লাগবার্গার। সামান্য মাংসের সঙ্গে সয়াবিন যুক্ত করে বানানো হতো বার্গার। কিংবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানুষকে পরিচিত করেছে টমেটো-স্যুপ কেকের সঙ্গে। খাবারগুলো বেশ জনপ্রিয়ও আজকাল। 

অথচ বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়ের খাবারগুলোর কথা কিন্তু ভারত কিংবা বাংলার কোনো রান্নার বই বা রেসিপি ব্লগে তেমন উল্লেখ নেই। মোটামুটি অনুপস্থিতই বলা চলে। মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক আজ জনপ্রিয় এক খাবারের নাম অথচ দুর্ভিক্ষের সময় ভাতের বদলে এ খাবারটিই খাওয়া হতো, এ কথা আজ কোথাও লেখা নেই। দুর্ভিক্ষের ওই সময়ের সঙ্গে খাবারগুলোর সংযোগের কথা আজও অনুল্লেখই রয়ে গেল! 

অ্যাটলাস অ্যাবস্কিউরা ডটকমে প্রকাশিত শরণ্য দীপকের লেখা থেকে ভাষান্তর করেছেন রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন