মুরলিধরের প্রত্যাশা...

এম এম খালেকুজ্জামান

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গেলে একজন বিচারপতিকে কখনো কখনো দুর্বলের পক্ষে ঝুঁকতে হয়। দিল্লি হাইকোর্ট থেকে বদলি হওয়া আলোচিত বিচারপতি এস মুরলিধর ৬ মার্চ দিল্লি হাইকোর্টের মিলনায়তনে এই মন্তব্য করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি নিজের বদলির নির্দেশ পান তার আগের দিন রাত সাড়ে ১২টায় তিনি নিজের বাড়িতে আদালত বসান। সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে দিল্লির সহিংসতার ফলে বহু মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে আইনজীবীরা তার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন রাতে। বিচারপতি মুরলিধর আদালত খোলার জন্য সকালের অপেক্ষা করেননি কারণ মারাত্মকভাবে আহত লোকগুলো পরের দিনের সকাল নাও দেখতে পারতো। বিচারপতি মুরলিধর তার নিজের বাড়িতে আদালত বসিয়ে দাঙ্গা সম্পর্কিত  অভিযোগের শুনানি করেন, আহতরা যাতে নিরাপদে হাসপাতালে যেতে পারে সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দিল্লি পুলিশকে নির্দেশ দেন। ভর্ৎসনা করেন দিল্লি পুলিশের নিষ্ক্রীয়তাকে। জুডিশিয়াল স্টেটসম্যানশিপের এক অনন্য নজির গড়েন। আর সাথে সাথেই কেন্দ্রীয় সরকার তাকে পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলির সুপারিশ করে।

দিল্লি হাইকোর্ট থেকে বিচারপতি মুরলিধরকে বদলির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বরাবর আবেদন জানিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউট। আন্তর্জাতিক সংগঠনটির সওয়াল, এই অস্বাভাবিক বদলি আদেশ সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ভারতের বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিয়েই উদ্বেগ তৈরি করে।বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আইনের শাসনের মূল বিষয়। বিচারপতি আইন অনুযায়ী স্বাধীন সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করলে তাকে কোন ভাবেই ‘শাস্তি’ দেওয়া যায় না। এসব আবেদন আর্জি যদিও বদলি ঠেকাতে পারেনি বরং মুরলিধরের মহিমাকে আরো বাড়িয়ে দেয়।প্রবল ও প্রচন্ডের বিরুদ্ধে একার লড়াই আরো পরিষ্কার হয়।

শামুকখোল পাখির বাসা না ভেঙ্গে বিলুপ্তির পথে থাকা প্রজাতিটির প্রজননে বিঘ্ন না ঘটানোর জন্য ওই পাখি যে বাগানের গাছে বাসা বেধেছে সেটি রক্ষার তাগিদ দিয়ে রুল দিয়েছিলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ। পাখির বাসা হোক আর ক্ষুদ্র নৃ জাতি গোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা হোক উচ্চ আদালতের এই সংবেদনশীলতা আমাদের প্রাণিত করে।

The administration of justice is the firmest pillar of government জর্জ ওয়াশিংটনের এই চিন্তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করার যুক্তি না আইন বিভাগের আছে না নির্বাহী বিভাগের আছে।কারণ আইন বিভাগ কতৃক প্রণীত আইনের ন্যায্যতা ও  প্রশাসনিক বা নির্বাহী আদেশ ও ক্রিয়াকলাপের সঠিকতার যাচাই বিচার বিভাগের উপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব।এখানে জাস্টিস কেবল ধারণাগত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি "এডমিনসট্রেশান অফ জাস্টিস" শব্দ বন্ধে ন্যায় বিচারের প্রায়োগিক দিক নির্দেশ করেছে। 

করোনা সৃষ্ট এই মহামারীতে দেশের জনগণের স্বাস্থ্য ও তৎসংশ্লিষ্ট অধিকারগুলো মারাত্মকভাবে লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি না করা, সাধারণ রোগের চিকিৎসায় আকাশচুম্বী বিলের রশিদ ধরিয়ে দেয়া আর পরীক্ষা না করে করোনা রিপোর্ট দেয়ার মতো আরো কত বাহারী দুর্নীতি যে এখনো প্রকাশের অপেক্ষায়? সাংবিধানিকভাবে আমাদের উচ্চ আদালত মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করে থাকে। গত বছরের ডেঙ্গু– প্রকোপের সময়ও তা দেখা গেছে।

ক্ষতিগ্রস্থ সংক্ষুব্ধের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লঙ্ঘিত মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে আদালত নির্দেশ দিতে পারেন, দুজন বিচারপতি নিয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ। কিন্তু এখন কেবল একক বেঞ্চ এর মাধ্যমে কাজ চলছে। একক বেঞ্চ রুল জারি করতে পারেন না। অপেক্ষা করতে হবে স্বাভাবিক সময়ের জন্য।রুল জারি করতে না পারার কারণে রুলের চূড়ান্ততা বিঘ্নিত হচ্ছে।এই সময়ে কার্যকর রিট বেঞ্চগুলো অন্তবর্তীকালীন আদেশ দিতে পারছেন কেবল।

সাংবিধানিকভাবে আইন সবার জন্য সমান হলেও আইনের সমান সুযোগ সবাই নিতে পারে না।সারাবাংলা নামে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম এর বরাতে জানতে পারি, ভার্চুয়াল কোর্টের সুযোগ নিয়ে থাইল্যান্ড থেকে আগাম জামিনের আবেদন করে উল্টো জরিমানা গুনতে হয়েছে আবেদনকারীকে। বেআইনিভাবে জামিন চেয়ে ‘আদালতের সময় নষ্ট’ করায় তাদের ১০ হাজার পিপিই জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের পক্ষে এমন আবেদন নিয়ে হাজির হওয়ায় আদালত আইনজীবীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। আদালত বলেন, একজন বিত্তবান ব্যক্তি কতটা শক্তিশালী হতে পারে, সেটি দেখানোর জন্য মামলাটি শুনানির জন্য রেখেছিলাম। আদালত যে বিত্তশালীদের পক্ষে বিশেষ সুবিধা দেয় না সেটি জনসাধারণকে বোঝাতেও মামলাটি শুনানির জন্য রাখা হয়েছিল। বিচার বিভাগ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে মানুষের মাঝে এ অবস্থায় বিচারক, আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষসহ সবাইকে আদালতের অংশ হিসেবে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান আদালত।মাননীয় বিচারপতির তীক্ষ প্রশ্নবান আমাদের নেতিয়ে পড়া স্নায়ুকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছে।

কদিন আগে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের ভার্চুয়াল বেঞ্চের আদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়, ১১২ পৃষ্ঠার আদেশে আদালত বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আইন, বিধি ও জারি করা ভার্চুয়াল কোর্টের  প্র্যাকটিস নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের বাইরে অবস্থান করে আদালতে কোনো আইনজীবীর শুনানি বা যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ নেই।’ যদিও আবেদনকারীর আইনজীবী আজমালুল হোসেন ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন ২০২০’র ৩ (২) ধারা উল্লেখ করে যুক্তি পেশ করেছিলেন, বিশ্বের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো আইনজীবী বা পক্ষ ভার্চুয়াল শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন। দেশের সীমানার বাইরে থেকে আগাম প্রত্যাশীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলেন, আগাম জামিন আবেদনকারীকে শারীরিকভাবে আদালতে হাজির থাকতে হবে বা আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে উপস্থিত থাকতে হবে।

আইনজীবী ও আদালত সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল এই মামলায় কী আদেশ দেয়া হয় তা নিয়ে। স্পষ্টতই অনেকে বিরক্ত ছিলেন এই মামলার মেইন্টিনিবিলিটি নিয়েই। এক্ষেত্রে জন-ধারণা প্রভাবকের ভূমিকা নিয়ে থাকে কখনো কখনো যদিও অন্য স্কুল অফ থট বলে পাবলিক পারসেপশান জনমত এস নয়, বিচার চলবে আইন অনুযায়ী। এই মামলায় বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল যথার্থ বলেছেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা যদি সবাই রক্ষা না করি, তাহলে কীভাবে হবে? এরই মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের অনেক সর্বনাশ হয়েছে। এমনি আমাদের জুডিশিয়ারির অবস্থা নাজুক। আপনারা এটাকে পারসোনালি নেবেন না।’ আদতেই সম্মিলিত নৈর্ব্যক্তিকতার কবচই এই মহান প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে পারে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন