বিদ্যুৎ খাত বড় লোকসান থেকে বের হবে কি?

মেহেদী হাসান রাহাত

২০১০ সালের মহাপরিকল্পনায় দেশে ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা নিরূপণ করা হয় ১৭ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। সে অনুযায়ী বাড়ানো হয় সক্ষমতা। একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। ফলে সক্ষমতার ৪০ শতাংশই অলস পড়ে আছে। যদিও অলস এসব বিদুৎকেন্দ্রের পেছনে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গত এক দশকে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে সরকারকে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার কারণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় হওয়ায় লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বিদ্যুৎ উৎপাদন বিতরণে সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।

বিদ্যুতের চাহিদা উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে বিস্তর ফারাকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা কম, এটি সত্য। তবে উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদাটাও যাতে বাড়ানো যায়, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। কিন্তু করোনার কারণে  দেশের বেশির ভাগ শিল্প-কলকারখানা বন্ধ থাকায় সংগতিপূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হচ্ছে, সেসব জায়গায় আমাদের বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। ফলে এখন চাহিদা কম থাকলেও পরে এটির প্রয়োজনীয়তা বাড়বে।

বড় আকারের কয়লা এলএনজিভিত্তিক বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়েক বছরের মধ্যে উৎপাদনে চলে আসবে। এরই মধ্যে চীনের অর্থায়নে নির্মিত কয়লাভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। চাহিদা কম থাকায় পটুয়াখালীর পায়রায় অবস্থিত হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সঞ্চালন লাইন তৈরির প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। বর্তমানে কেন্দ্রটি অর্ধেক সক্ষমতায় উৎপাদন চালাচ্ছে। কেন্দ্রটির পেছনে প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৬০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে।

শুধু পায়রা নয়, বড় আকারের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বাগেরহাটের রামপালে। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কাজ চলছে। এটি ছাড়াও মহেশখালীতে মোট হাজার ১২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরো পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন। অন্যদিকে বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণ হচ্ছে হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যেটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল) বর্তমানে বিদ্যুতের যে চাহিদা তাতে বড় এসব তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পেছনে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হবে।

চাহিদা সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বর্তমান সক্ষমতার ৪০ শতাংশ অব্যবহূত থাকলেও ২০১৬ সালের সংশোধিত মহাপরিকল্পনায় বিদ্যুতের চাহিদার প্রক্ষেপণ আরো বাড়িয়ে ২০৩০ সালে ৩৯ হাজার ৬৬৩ মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালে ৭৭ হাজার ৫৪০ মেগাওয়াট নির্ধারণ করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা অনুসারেই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে সরকার।

পাওয়ার সেলের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৬ হাজার ৮৭৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার ৪৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছিল। এছাড়া ৩০ হাজার ৭৪৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার ১৪৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি স্বাক্ষরের পর্যায়ে রয়েছে। ৬৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন আছে। ১৯ হাজার ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ১৬টি নতুন সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি পরিকল্পনাধীন।

পরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলে সামনের বছরগুলোতে সরকারের আর্থিক বোঝা আরো ভারী হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা . শামসুল আলম বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে বিদ্যুৎ খাত লাভের মুখ দেখবে না। খাতে দুর্নীতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। খাতকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যে ধরনের কারিগরি প্রশাসনিক ব্যবস্থা দরকার তা নেয়া হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত অদক্ষতা, অযোগ্যতা বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভর্তুকির কারণে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা কমাতে এবং গ্রাহকের ওপর মূল্যবৃদ্ধির চাপ কমাতে বিদ্যুৎ খাতের বিদ্যমান নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আগামীতে কয়লা এলএনজিভিত্তিক যেসব কেন্দ্র আসছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে নীতি প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি করার সময় ক্যাপাসিটি চার্জ বাদ দেয়ার পাশাপাশি পুরনো, অদক্ষ ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করে দিতে হবে। ২০ বছরের কম মেয়াদ রয়েছে এমন রেন্টাল কুইক রেন্টাল কেন্দ্র অনুমোদন থেকে বিরত থাকতে হবে। যেহেতু বেসরকারি কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে উল্লেখযোগ্য রিটার্ন পাচ্ছে, তাই খাতের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এটিকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন। যদি বিদ্যুৎ খাতের স্থিতিশীলতা আনতে সরকার ব্যর্থ হয় তাহলে খুচরা গ্রাহক, শিল্প গৃহস্থালি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়ে যাবে এবং এতে শিল্প খাতে ধীরগতি তৈরি হবে, যা সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিকেও ধীর করবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন