কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও উপকরণ সংকট

অস্তিত্ব হারাতে বসেছে কালীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প

মো. হাজিনুর রহমান শাহীন, গাজীপুর

প্রাচীন আমলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ঘেঁষে গাজীপুরের কালীগঞ্জ নরসিংদী এলাকায় তাঁত শিল্পে বিখ্যাত মসলিন কাপড় উৎপাদিত হতো। এরই ধারাবাহিকতায় কালীগঞ্জের চৌড়া আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক শিল্পায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারছে না তাঁতবস্ত্র শ্রমিক মালিকরা। দফায় দফায় রঙ, সুতা, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক প্রয়োজনীয় উপকরণ সংকটের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে গাজীপুরের কালীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প।

কালীগঞ্জ উপজেলার চৌড়া, বাহাদুরসাদী, খঞ্জনা, বড়নগর উত্তরগাঁওসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের তাঁতিরা এখনো কোনো রকম আঁকড়ে ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার পেশাকে। নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তাঁত শিল্পটি। ক্রমেই বেকার হয়ে পড়ছে ওই পেশায় যুক্ত শ্রমিক মালিকরা। অনেকে ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছে তাঁত কারখানার মেশিনসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র।

কালীগঞ্জের তাঁত শিল্প এলাকা ঘুরে এবং তাঁত শিল্পে সম্পৃক্ত শ্রমিক মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বর্তমানে কালীগঞ্জে কিছু সংখ্যক তাঁতি পরিবার চৌড়া, বড়নগর, বাহাদুরসাদী, খঞ্জনা, উত্তরগাঁও, কুহিনূর মার্কেট, ধোলাসাধু এলাকায় এখনো শিল্প টিকিয়ে রেখেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হয়তো অচিরেই হারিয়ে যাবে শতবছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প।

তাঁত শিল্প মালিক (কালীগঞ্জ পৌর তাঁতি লীগের সভাপতি) রুহুল আমীন জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে তাঁত শিল্পে জড়িত। নব্বইয়ের দশকে কালীগঞ্জের চৌড়া আশপাশের এলাকায় প্রায় হাজার ২০০ হ্যান্ডলুমে (হস্তচালিত তাঁত) কাজ করতেন সহস্রাধিক শ্রমিক। এখানে তৈরি হতো টেরিটাওয়েল বা তোয়ালে। ওইসব হ্যান্ডলুম দিয়ে প্রতিদিন একজন শ্রমিক এক ডজন তোয়ালে তৈরি করতে পারতেন। সভ্যতার ক্রমবিকাশে পাওয়ার লুমের (যন্ত্রচালিত তাঁত) সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী হাতে চালিত তাঁতকল বা হ্যান্ডলুমগুলো।

তিনি বলেন, বাজারে টিকে থাকতে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হ্যান্ডলুমের পরিবর্তে পাওয়ার লুম স্থাপন করেন তাঁত শিল্প মালিকরা। ফলে পর্যায়ক্রমে হাজার ২০০ হ্যান্ডলুম বন্ধ করে টিকে থাকার তাগিদে ৪০০ পাওয়ার লুম চালু করা হয়। এতে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। অনেকে জীবিকার তাগিদে তাঁত শিল্প ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যান। কিন্তু দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, সুতা, রঙ, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বুনন পরিবহনসহ প্রতিটি কাজের খরচ বহুগুণ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে শ্রমিক সংকটও দেখা দিয়েছে। তাই তাঁতের উপকরণ সুতা রঙের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ ওঠাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তাঁতকল মালিক করিম ভূঁইয়া জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পেশা সম্প্রসারণ নয় বরং দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষুদ্র কুটির শিল্প হিসেবে বিদ্যুতের কোনো ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে না। তাঁত শিল্পে বিদ্যুতের রিবেট দেয়ার দাবি জানান তিনি।

ব্যাপারে গাজীপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. আনোয়ার সাদাত সরকার বলেন, আর্থিক সহযোগিতা প্রাপ্তির ব্যাপারে বণিক সমিতি তাদের পাশে থাকবে। সম্প্রতি সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেখান থেকে তারা সহযোগিতা নিতে পারেন। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আমরা ওই প্রণোদনা পাওয়ার ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করব।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম জানান, আমি কখনো ওইসব এলাকায় যাইনি। শিগগিরই এলাকাগুলো পরিদর্শন করব। কালীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া হবে। সেজন্য স্থানীয় তাঁত শিল্প সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে শিগগিরই তাঁত শিল্প এলাকা পরিদর্শন করে তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন