প্রাদুর্ভাব ও মহামারী নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরেই ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আন্তঃনির্ভরশীলতার মাঝে উত্তেজনা তৈরি করে আসছে। এর সঙ্গে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যা ঘটছে তার মিল রয়েছে। অ্যান্টি-ভ্যাক্সার একটি বই যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে এর বিরূপ জোটকে। উদাহরণস্বরূপ অ্যান্টি-ভ্যাকসিন, অ্যান্টি-মাস্ক, অ্যান্টি-৫জির কথা বলা যায়। এগুলো এখন জনস্বাস্থ্যের পথে এসে দাঁড়িয়েছে।
মনোবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক জোনাথান বারমেন ভ্যাকসিনেশনকে সব সময় বজ পাতের সময় লাইটনিং রড হিসেবে দেখেন। উনিশ শতকে যেসব মানুষ ইংল্যান্ডে গুটিবসন্তের বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল তা তাদের চালিত করেছিল ১৮৩৪ সালের পুয়র ল অ্যামেন্ডমেন্টের বিরোধিতার দিকে। যেখানে বলা হয়েছিল বেকারদের অবশ্যই ওয়ার্কহাউজগুলোতে খাবারের জন্য কাজ করতে হবে, যা প্রায়ই ছিল শোষণ, শিশুশ্রম ও পারিবারিক শর্তে। আন্দোলনকারীরা বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনেশনকে দেখেছিল দরিদ্র মানুষের স্বায়ত্তশাসনের ওপর আঘাত হিসেবে। ইংল্যান্ডে এ ধরনের বিরোধিতার উত্থানের অভিজ্ঞতার পর বারমেন ফিরে তাকান বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার অভিজ্ঞতার দিকে।
বিশ্বাস ও সন্দেহ
সাম্প্রতিক সময়ে ভ্যাকসিনের সুরক্ষাবিষয়ক সমান্তরাল ভীতির কারণ স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হাম, মাম্পস ও রুবেলা (এমএমআর) ভ্যাকসিনেশনের উত্থানের পর, যুক্তরাজ্যে হ্রাস পাওয়ার পরও হামের প্রাদুর্ভাব বেড়েছিল। ২০১২ সালে ২ হাজার ৩২টি কেস শনাক্ত হয়েছিল ইংল্যান্ড ও ওয়েলশে। এমনকি এখন গোটা বিশ্ব ভ্যাকসিনের জন্য হন্যে হয়ে অপেক্ষায় থাকার পরও মার্চে ফ্রান্সের ২৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বলেছিল, উপলব্ধ হওয়ার পরও তারা ভ্যাকসিন গ্রহণ করবে না। দুই মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে তেমন রায় দিতে দেখা গেছে।
বারমেনের কেস স্টাডিগুলো যারা অনলাইনে বা পারিবারিক জমায়েতে অ্যান্টি-ভ্যাকসিন দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চায়, তাদের সন্তুষ্ট করতে পারে। একটি অনুমিত কেলেঙ্কারি হচ্ছে সিডিসিকে উদ্দেশ করে সামনে আসা ২০১৬ সালের ছবি ‘ভ্যাক্সড’। ২০১৪ সালে বায়োলজিস্ট ব্রায়ান হোকার ২০০৪ সালের সিডিসির পুনঃবিশ্লেষিত ডাটা প্রকাশ করে। যেখানে অভিযোগ করে বলা হয় এজেন্সি গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনুসন্ধান সরিয়ে ফেলেছে, যাতে উল্লেখ ছিল যে আফ্রিকান আমেরিকান ৩৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের মাঝে এমএমআর ভ্যাকসিন দেয়ার ফলে অটিজমের প্রবণতা দেখা গেছে। হোকার এ সময় এ সংযোগের সপক্ষে সিডিসির বিজ্ঞানী উইলিয়াম থম্পসন এবং সহলেখকদের আলাপচারিতা ফাঁস করে। কিন্তু বারমেন দেখান এখানে বিশ্বাসযোগ্য সংযুক্তি নেই। এ দাবি হোকারের বিশ্লেষণে মারাত্মক পদ্ধতিগত ব্যর্থতার ফল—দাবিটি প্রত্যাহার করেছিল।
বিশ্বাসের বাসা
অ্যান্টি-ভ্যাক্সার হচ্ছে গত দশকে প্রকাশিত হওয়া বইগুলোর মতোই একটি, যা চেষ্টা করেছে আধুনিক অ্যান্টি-ভ্যাকসিনেশন আন্দোলনকে বুঝতে এবং একে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কনটেক্সটের সঙ্গে যুক্ত করতে, যার মাধ্যমে এটি প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের ভলিউমে আরো যুক্ত আছে সাংবাদিক সেথ মুনকিনের ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য প্যানিক ভাইরাস’,
শিশু বিশেষজ্ঞ ডেভিড ইসাকের ‘ডিফিটিং দ্য মিনিস্টারস অব ডেথ’,
পিটার হোটেজের ‘ভ্যাকসিন ডিড নট রাচেল’স অটিজম’
ও পল অফিটের ‘ডেডলি চয়েজেস’। নৃবিজ্ঞানী হেইডি লারসনের স্টাকও এ বছরের শুরুতে তালিকায় যোগ দিয়েছে। সে সঙ্গে আছে ইউলা বিসের ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘অন ইমিউনিটি’
নামের বইটিও। এ জাতীয় সামাজিক গবেষণা যা স্বীকার করে তা হলো ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যুক্তিটিকে খণ্ডনের জন্যও এগুলো যথেষ্ট ছিল না।
বারমেনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি এ সিদ্ধান্তও দেয় যে ভ্যাকসিন প্রত্যাখ্যানের কারণের যে প্রধান কারণগুলো তাকে অবশ্যই প্রশংসিত করা এবং উল্লেখ করা প্রয়োজন। যদিও ভ্যাকসিনেশনের ইতিহাস আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রসরমানতাকেই তুলে ধরে। এটি অবশ্য সেই বিস্তৃত গল্পের অংশ, যেখানে প্রযুক্তির প্রতিশ্রুতি এবং বিপদের মাঝে সমাজে একটি লড়াই বিদ্যমান ছিল। এটা হচ্ছে বাবা-মার একটি সন্তানের মৃত্যু এবং অক্ষমতার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার গল্প (যদিও বেশির ভাগ সময় তা ভ্যাকসিনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না)। পাশাপাশি এটি একটি আন্দোলনকারী গোষ্ঠীর গল্প, যা বিজ্ঞানকে খুব বেশি অস্বীকার করবে না। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের বাসা তৈরির জন্য সতর্কতার সঙ্গে তথ্য ও ভুল তথ্যগুলোকে একীভূত করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয়ভাবে বৈশ্বিক হয়ে ওঠা বিষয়ের সমাধান কী? অনেক বই আবেদন জানিয়েছে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে আরো কার্যকরভাবে যোগাযোগ করার জন্য কিংবা সরকারগুলোকে আরো সক্রিয় ও কঠোরভাবে লড়াই করতে হবে ভ্যাকসিনেশনের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে।
বারমেন এখানে ঐক্যবদ্ধভাবে পিতামাতার কাছ থেকে পাওয়া ব্যক্তিগত আখ্যানগুলোও চিত্রিত করেছেন। উদহারণস্বরূপ ইনগবার ইনগভারসন, একজন বাবা যিনি তার সন্তানদের ভ্যাকসিনেশন না করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর একজন নার্স হিসেবে তিনি বয়স্ক লোকদের যত্ন নিতে গিয়ে মুখোমুখি হন যারা কিনা হাম ও পোলিওর মতো রোগ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যা তাকে পুনরায় চিন্তা করার দিকে চালিত করে। আর শেষ পর্যন্ত গিয়ে তার সন্তানরা ভ্যাকসিন গ্রহণ করে।
সুবিধাজনক অবস্থান
অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা আরো অনেক বেশি মনোযোগ দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ সালে ২৪ মাস বয়সী শিশুদের ৭৩.২ শতাংশ এসেছিল স্বাস্থ্য বীমা না থাকা পরিবার থেকে, যারা অন্তত একটি নির্দেশিত এমএমআর ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ গ্রহণ করেছিল। এ পরিসংখ্যানটি ৯৩.৭ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায় যখন যেসব পরিবারের প্রাইভেট বীমা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে।
বারমেন সেসব অভিভাবককে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যাদের সন্তানরা পুরোপুরি ভ্যাকসিন গ্রহণ করেনি: যারা ভ্যাকসিনেশনকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং স্বাস্থ্যসেবায় যাদের প্রবেশযোগ্যতার অভাব রয়েছে। তার মতে, অর্থনৈতিকভাবে পেছনে থাকাদের ওপর আরো বেশি জোর দেয়া উচিত। প্রত্যাখ্যানকারীদের ওপর মনোযোগ দেয়ার চেয়ে তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, যারা স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশযোগ্যতা পাচ্ছে না তাদের ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা উচিত।
এখানে কিছু সাধারণ বিষয় ঠিকঠাকভাবে সামনে আনা হয় না। দারিদ্র্য, সামাজিক সংস্থানে ও প্রাথমিক সেবায় প্রবেশের অভাব এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। যেমনটা ফেলে আবাসন নিরাপত্তাহীনতা, লিঙ্গবৈষম্য ও বর্ণবাদ। ২০১৯ সালে হামের বড় প্রভাবটি পড়েছিল সেসব দেশে যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার পর্যাপ্ততা ছিল না। যেমন মাদাগাস্কার। কিংবা সেখানে যেখানে দ্বন্দ্ব মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে এবং ভ্যাকসিনগুলোতে তাদের প্রবেশগম্যতাকে ব্যাহত করে। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ ইয়েমেনের কথা বলা যায়। বর্তমান মহামারী আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে যদি ভাইরাসকে প্রতিহত ও নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তবে সরকারগুলো দারিদ্র্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ইস্যুকে এড়িয়ে যেতে পারে না।
নেচার থেকে সংক্ষেপে অনূদিত