নারী টেনিস বদলে দেয়া ‘অরিজিনাল ৯’

ক্রীড়া ডেস্ক

গভীর লিঙ্গবৈষম্য আর নারী বিদ্বেষের কারণে ১৯৭০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নয় নারী সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার তারা নিজেরাই একটি টুর্নামেন্ট খেলবেন। সেই বিদ্রোহের মধ্যেই আজকের উইমেনস টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের (ডাব্লিউটিএ) বীজ বপন করা হয়ে গিয়েছিল। 

ক্রিস্টি পিজিওনের বাবা যদি নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় থাকতেন, তবে এ মেয়েটি কোনোভাবেই টেনিস খেলোয়াড় হতেন না। কিশোরী বয়সে তিনি ছিলেন একজন চিয়ারলিডার। আর কলেজে উঠে তার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে অগ্রাধিকার পায় ভবিষ্যত স্বামীর সাধনা। যেই স্বামী হবেন তার ভবিষ্যত সংসারের জীবিকার্জক।

এক টেলিফোন সাক্ষাত্কারে পিজিওন বলেন, ‘এটা আসলে ৫০ বছর আগে পুরুষরা নারীদের কেমন চোখে দেখত তার আরেকটা ইঙ্গিত মাত্র। জগিং করতে গেলে কিংবা টেনিসের জন্য অনুশীলনে গেলে আমাকে নিয়ে টিটকারি করা হতো। যখন হাইস্কুলে গেলাম...মানুষজন ভাবত, খেলাকে পেশা হিসেবে নেয়া কিংবা খেলায় ভবিষ্যত খোঁজা মেয়েদের জন্য মোটেও আকর্ষণীয় নয়।’

পিজিওন বরং ভয় না পেয়ে ‘অরিজিনাল ৯’ এর একজন হয়ে গেলেন, যে নয় নারী পুরুষদের কর্তৃত্বে গড়া আন্তর্জাতিক টেনিস কাঠামো থেকে বেরিয়ে এলেন সাহসিকতার সঙ্গে। সেদিন তার সঙ্গী ছিলেন জুডি টেগার্ট ডালটন, জুলি হেল্ডম্যান, পিচেস বার্টকোভিজ, রোজি ক্যাসালস, কেরি মেলভাইল, ন্যান্সি রিচি, ভ্যালেরি জিগেনফাস ও বিলি জিয়ান কিং। তারা চিরাচরিত বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে এসে অনন্য এক নজির স্থাপন করেন। সেই থেকে নারী টেনিস পায় নিজস্ব পরিচয়, যা এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ও বৃহৎ এক প্রতিযোগিতা। টেনিসের এই বিপ্লব ঘটেছিল ১৯৭০ সালের ঠিক এই দিনে (২৩ সেপ্টেম্বর)। ‘অরিজিনাল ৯’ এর সম্মানে আজ থেকে এক সপ্তাহ পালন করবে ডাব্লিউটিএ।

টেনিসের কাঠামোতে দীর্ঘদিন ধরে লিঙ্গবৈষম্য চলে আসছিল, কিন্তু ১৯৬৮ সালে উদার যুগের সূচনা হলো এবং তখন অ্যামেচার খেলোয়াড়দের সঙ্গে পেশাদাররাও প্রথমবারের মতো গ্র্যান্ড স্লামে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পেল। যদিও নারী ইভেন্ট দ্রুতই তাদের মূল্য হারাল। এ নিয়ে হেল্ডম্যানের স্মৃতিচারণ- ‘প্রথম আট মাসে নারীদের জন্য প্রাইজমানি ছিল মাত্র ৫ হাজার ডলার। নারীদের অংশ নেয়ার মতো যথেষ্ট টুর্নামেন্টও ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই পুরুষদের দৌরাত্ম্য (!) চলছিল: মানুষজন নারীদের খেলা দেখতে টিকিট কিনতো না।’

অসন্তোষ যখন বেড়েই চলছিল, তখন ঘটল আরেক ঘটনা। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে সাবেক এক নম্বর খেলোয়াড় ও প্যাসিফিক সাউথওয়েস্ট টুর্নামেন্টের প্রবর্তক জ্যাক ক্রেমার ঘোষণা দিলেন, পুরুষ বিভাগে জয়ী পাবেন ১২ হাজার ৫০০ ডলার, আর নারী বিভাগে প্রাইজমানি ১ হাজার ৫০০ ডলার। ক্ষুব্ধ নারী খেলোয়াড়রা ইউএস ওপেন চলাকালে সংঘবদ্ধ হলেন এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিলেন ‘টেনিস’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক গ্লাডিস হেল্ডম্যান, যিনি নারী টেনিস ইতিহাসে একজন প্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব। 

প্যাসিফিক সাউথওয়েস্ট টুর্নামেন্টের অনুরূপ আট নারীর আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট করার সিদ্ধান্ত নিলেন হেল্ডম্যান, যেখানে অন্য টুর্নামেন্ট বয়কটের শর্তে নারীদের পূর্ণ প্রাইজমানির প্রস্তাব দেয়া হলো। গ্লাডিসের কন্যা জুলি হেল্ডম্যান এ নিয়ে বলেন, ‘হিউস্টনে আমাদের প্রত্যেকেই বিদ্রোহের অঙ্গীকার করলাম। শুরু থেকেই নারীদের এই পাগলাটে দলটি, যারা প্রত্যেকেই ছিল ভালো খেলোয়াড়, তারা কিছুর দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হলো।’

তাদের এই অঙ্গীকার শিগগিরই পড়ল কঠিন পরীক্ষার মুখে। যুক্তরাষ্ট্র লন টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের (বর্তমানে যা ইউএস টেনিস অ্যাসোসিয়েশন) অনুমোদন কমিটির চেয়ারম্যান স্ট্যান ম্যালেসের ফোন পেলেন প্রত্যেকেই। তিনি জানিয়ে দিলেন, অননুমোদিত ওই টুর্নামেন্টে অংশ নিলেই যেকোনো খেলোয়াড়কে নিষিদ্ধ করা হবে। 

কিন্তু নারীরা ভয় পেলেন না। পিজিওন বলেন, ‘‘আমি ভাবলাম, যদি নিষিদ্ধ হই তবে সোজা ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেব, যতক্ষণ না পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। আমি বললাম, এটা মোটেও ঠিক নয়। আমরা এর পরিবর্তন চাই। সামনে এগিয়ে চলো।’’

দুই অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়ের জন্য ভয়াবহ পরিণতি নেমে এল দ্রুতই। টেনিস অস্ট্রেলিয়া তত্ক্ষণাৎ ডালটন ও মেলভাইলকে তাদের অস্বীকৃতি জানিয়ে দিল এবং অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার অযোগ্য ঘোষণা করল।

ডালটন বলেন, ‘আমরা কিছুই করতে পারিনি। আমাদের কোনো টুর্নামেন্টই খেলতে দেয়া হয়নি। নিউজিল্যান্ড বলল, আমরা অকল্যান্ডে খেলতে পারব, তখন আইএলটিএফ (এখন আইটিএফ) নিউজিল্যান্ডকেই নিষিদ্ধ করতে চাইল।’

যাই হোক, বিদ্রোহী খেলোয়াড়দের টুর্নামেন্ট সফলতার মুখ দেখল। ফাইনালে রোজি ক্যাসালের কাছে হেরে গেলেন ডালটন। টুর্নামেন্টের স্পন্সর ফিলিপ মরিসের মালিকানাধীন ভার্জিনিয়া স্লিমস সিগারেট এ নারীদের সঙ্গেই থাকতে চাইল। খেলোয়াড়রাও গ্লাডিস হেল্ডম্যানকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে বলল। 

জুলি হেল্ডম্যান বলেন, ‘আমি একে বলি, পবিত্র ত্রয়ী। আমার মা ছিলেন আয়োজক, যিনি খেলোয়াড়দের জড়ো করেছেন, স্পন্সর এনেছেন ও সবকিছু সম্ভব করেছেন। বিলি জিয়ান কিং ছিলেন একজন চ্যাম্পিয়ন এবং সংবাদমাধ্যমেও প্রিয় মুখ; কাজেই মানুষ তাকে দেখতে আসতো। এরপর আমার মা নিয়ে এলেন ফিলিপ মরিসের সিইও জো কালম্যানকে।’

এভাবেই ১৯৭১ সালে যাত্রা করলো ভার্জিনিয়া স্লিমস ট্যুর। প্রথমদিকে নারীদের ট্যুর টেনিসে আটটি টুর্নামেন্ট ছিল। ধীরে ধীরে টুর্নামেন্ট বাড়ল, প্রতিযোগীও বাড়তে থাকল। টেনিস বিশ্বে জায়গা করে নিলেন নারীরা। আজকের এই সফলতার ভিতটা কিন্তু গড়ে দেন ওই নয়জন। তারা জীবনের বেশিরভাগ সময়ই নারী টেনিসকে এগিয়ে নিতে নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন, করছেন এখনো। 

ডালটন বলেন, ‘আমরা টিভিতে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, সকালের প্রোগ্রামে। আমরা শপিং মল কিংবা সুপারমার্কেটে গিয়েছি ও ম্যাচের টিকিট বিক্রির চেষ্টা করেছি। এ কারণেই ৫০ বছর পর এসেও আমাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা এখনো বেশ শক্তিশালী।’

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন