করোনাকালে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ভাবনা

ইমতিয়াজ আহমেদ সজল

চলমান করোনা মহামারীতে দেশের সংকটাপন্ন মানুষ যেমন কষ্টে আছে, এর চেয়েও বেশি কষ্টে আছে গৃহ, পরিবার আর স্বজন ছেড়ে যাওয়া আমাদের অভিবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র (বিএমইটি) তথ্য মতে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১,২৮,৯৯২৮৩ জন শ্রমিক কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে অভিবাসন করেছে। বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকরা মূলত বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের স্বল্প মেয়াদি চুক্তিভিত্তিক কর্মী, তাই এদের অনেকেই চুক্তি শেষে দেশে ফিরে এসেছেন। তবে, ফিরে আসা অভিবাসী শ্রমিকদের তথ্য সংরক্ষণের কোনো প্রক্রিয়া আমাদের নেই বিধায় বর্তমানে ঠিক কী সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে কর্মরত আছে তা বলা মুশকিল। ধারণা করা হয় এ সংখ্যা ৮০-৯০ লাখের মতো। এ অভিবাসী শ্রমিকদের প্রায় ৮০ শতাংশই আছে উপসাগরীয় ও অন্যান্য আরব দেশে আর বাকি ২০ শতাংশের বেশিরভাগ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও অন্যান্য দেশে আছে। এ সব ক’টি দেশই করোনায় আক্রান্ত। করোনা মোকাবেলায় এসব দেশের কঠোর লকডাউনে সকল অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন লাখ-লাখ অভিবাসী শ্রমিক। উপার্জনহীনতায় রিক্তহস্ত হয়ে দেশে থাকা স্বজনদের জন্য অর্থ সরবরাহেও তারা এখন অপারগ। সীমিত আয়ের অভিবাসী শ্রমিক পরিবারগুলো তাই পোহাচ্ছে ভোগান্তি। আপাতদৃষ্টিতে দারিদ্রসীমার উপরে বসবাস করা এই পরিবারগুলো বাদ পড়ে যাচ্ছে দুর্যোগ ও আপদকালীন সহায়তা থেকেও। 

বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে কয়েক লাখ এমন আছেন, যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। অনেকেই আছেন মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসা, অবৈধ অবস্থান পত্র কিংবা অনুমতিপত্র নিয়ে। এই দুর্যোগ ও মহামারীতে বৈধ কাগজপত্রধারী শ্রমিকদের জন্য কিছু মৌলিক চাহিদা ও সহায়তার আশ্বাস মিললেও, নানান দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর হয়রানিতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকদের জীবন। মহামারীর শুরু থেকেই তাদের অনেককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, কেউ আটক হয়ে ফেরত আসার অপেক্ষায় আর কেউ এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কাজের সন্ধান মিলবে তারপর দেশে পাঠাবেন সেই রোজগার। 

বিএমইটি’র সূত্রে জানা যায় ১৯৯১ থেকে ২০২০ এর ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ৯ লাখ ১৬ হাজার ৪৬৩ জন নারী শ্রমিক বিদেশে অভিবাসন করেছেন। সাম্প্রতিককালে নিগ্রহের শিকার হয়ে বহু নারীর দেশে ফিরে আসার ঘটনা এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসব নিগ্রহের চিত্র দেখে সম্ভাব্য অনেক নারী কর্মীই বিদেশ যেতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে নানান রকম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ৩০০০ নারীকর্মী দেশে ফিরেছে। উন্নত ভবিষ্যতের আশায়, বিদেশে পাড়ি জমিয়ে তাদের অনেকেই আবার ফিরেছেন লাশ হয়ে। শারীরিক নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে বহু নারীকর্মীকে দেশে ফিরতে দেখা গেছে। করোনা মহামারীতে নাজেহাল হয়ে আছেন আমাদের নারী অভিবাসী শ্রমিকরা, যারা প্রায় সবাই নিযুক্ত আছেন গৃহকর্মী হিসাবে। লকডাউনে যেভাবে বেড়েছে পারিবারিক নির্যাতন, সেভাবে নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে নারী গৃহকর্মীদের উপরও। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের একটা বড় অংশই বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারী, দেশে রয়েছে যাদের পরিবারের কিছু অসহায় সদস্য। তাদেরও দরকার জরুরি সহায়তা।

শ্রম অভিবাসনের একটি মর্মান্তিক অধ্যায় হলো বিদেশে শ্রমিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যু। সেফটি অ্যান্ড রাইটস এর এক রিপোর্টে দেখা যায় গত আট বছরে ক্রমবর্ধমান হারে বছরে গড়ে ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক দেশে ফিরেছেন লাশ হয়ে আর প্রতিদিন লাশ হয়ে ফিরছে ১১জন অভিবাসী শ্রমিক। এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা স্ট্রোক, হৃদরোগ, দুর্ঘটনা, হত্যা বা আত্মহত্যার শিকার। প্রবাসীদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ তদন্ত করে মৃত্যুসনদ দিয়ে থাকে। বিদেশে বাংলাদেশি কোনো শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ যাচাই করে না বাংলাদেশ সরকার। এই অস্বাভাবিক মৃত্যু তদন্তে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোরও কোনো উদ্যোগ নেই। বছরের পর বছর অস্বাভাবিক মৃত্যু বাড়তে থাকলেও তা প্রতিরোধে এবং কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণসহ অন্যান্য আইনি প্রতিকারে সক্রিয় হচ্ছে না দায়িত্বশীল কেউই। দায়সারাভাবে পরিবারকে মৃত্যুর কারণ বলে দেয়া হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই মেনে নিতে পারছে না তাদের পরিবারগুলো। 

এর বাইরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে কারাগারে থাকা অভিবাসীদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। এরকম প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক দেশে ফেরত আসে। মালয়েশিয়ায় লকডাউন চলাকালীন বৈধ শ্রমিকদের জন্যও ছিল না পর্যাপ্ত সহায়তা ও নিরাপত্তা। এই করোনাকালেও মালয়েশিয়ান পুলিশ অনিয়মিত অভিবাসী বিরোধী অভিযান চালিয়ে কারারুদ্ধ করছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রবিহীন অভিবাসী শ্রমিকদের। যা স্পষ্টতই শ্রম অভিবাসনসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।  সিঙ্গাপুরে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ৪০ ভাগই বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপের শ্রমবাজারে প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশীর মধ্যে ৪০ হাজারই আছেন অবৈধভাবে যারা মূলত পর্যটনসেবা খাতে নিযুক্ত। লকডাউনে নাকাল পর্যটননির্ভর এই দেশের অর্থনীতি। তাই সেখানেও ভালো নেই তারা। 

বিদেশে নানা প্রতিকূলতা আর বিপন্নতার মধ্যে থাকা এই অভিবাসী শ্রমিক আর দেশে থাকা তাদের পরিবারের সদ্যসদ্যের জন্য কি রয়েছে কোনো আইনি প্রতিকার? জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে কী সুরক্ষা রয়েছে তাদের জন্য? কী বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাদের প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী রাষ্ট্রের? বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম দুই চালিকাশক্তির একটি হলো বিদেশি আয় তথা রেমিট্যান্স আর অন্যটি তৈরি পোষাক শিল্প। পোষাক শিল্পের মালিকদের চাপ কিংবা প্রভাবে করোনার ধাক্কা সামলাতে সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে সেই খাতে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা ও তাদের বিপদগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের জন্য কী সহায়তা/প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার?

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট ৯টি মূল সনদের একটি হলো- ‘অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ’। শ্রম অধিকার সংক্রান্ত এ সনদটি ১৯৯০ সালে গৃহীত হয় এবং ২০০৩ সালে কার্যকর হয়। অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের নিয়োগকারী ও প্রেরণকারী দুই দেশেরই অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তাই অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের জন্য কল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ ও পরিচালনা করা তাদের নিয়োগকারী ও প্রেরণকারী দুই দেশেরই দায়িত্ব। এ সনদে নিরাপদ ও ন্যায়সঙ্গত অভিবাসনব্যবস্থা প্রবর্তন, সকল অভিবাসীকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মানবাধিকার এবং সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়ন সাধনে অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী রাষ্ট্রের ওপর একগুচ্ছ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। সনদে বর্ণিত মৌলিক মানবাধিকারগুলো অনিয়মিত এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণপত্রবিহীন শ্রমিকসহ সবধরনের শ্রমিকদের জন্যই প্রযোজ্য। এছাড়াও, জরুরি অবস্থা বা যেকোনো মানবিক বিপর্যয়ে চিকিৎসা সেবাসহ অন্যান্য জরুরি সহায়তার অধিকারের কথাও বলা হয়েছে এ সনদে। 

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এ সনদের পক্ষভুক্ত ৫৫টি রাষ্ট্রের প্রায় সবক’টিই অভিবাসীশ্রমিক প্রেরণকারী রাষ্ট্র। অর্থাৎ, অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী বা নিয়োগকারী কোনো রাষ্ট্রই এ সনদে পক্ষভুক্ত হয়নি, যে কারণে সনদে বর্ণিত কোনো দায়-দায়িত্ব পালনেও তাদের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপিত হয়নি। বাংলাদেশ মূলত অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ। সনদের পক্ষভুক্ত একটি রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ তার দায়-দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলেও, শ্রমিক গ্রহণকারী রাষ্ট্র যদি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে তবে প্রকৃত অর্থে তাদের অধিকারের বাস্তবায়ন হবে না। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক প্রেরিত হয় এমন দেশ যেমন- সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এদের কেউই এ সনদ অনুসমর্থন করেনি। যার ফলে, এসব দেশে অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় কোন শক্তিশালী আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও গড়ে উঠে নি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের করনীয় হলো জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী সেসব দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নির্যাতন, দুরাবস্থা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরে ঐসব দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করা, যেন তারা আন্তর্জাতিক শ্রম-মান রক্ষা করে অভিবাসীকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় নিজ নিজ দেশে আইন প্রণয়ন করে। তবেই আমাদের অভিবাসী শ্রমিক ভাই-বোনেরা সেসব দেশে তাদের শ্রম অধিকার লঙ্ঘন হলে আইন-আদালতের আশ্রয় নিতে পারবে এবং শ্রমের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে পারবে। 

বাংলাদেশ ২০১১ সালে এ সনদটি অনুসমর্থন করার পর, সনদে বর্ণিত রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বগুলো নিজ দেশে বাস্তবায়ন করতে- ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩’ পাশ করা হয় জাতীয় সংসদে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, নিরাপদ ও ন্যায়সঙ্গত অভিবাসনব্যবস্থা প্রবর্তন, সকল অভিবাসীকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করাকেই এ আইনের উদ্দেশ্যরূপে স্থির করা হয়। এ আইনে বলা হয়েছে বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ ও অভিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজন হলে সরকার সেই দেশে বাংলাদেশ মিশন বা দূতাবাসে শ্রমকল্যাণ উইং প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আইনে শ্রমকল্যাণ উইংয়ের অন্যতম দায়িত্ব হিসাবে বলা হয়েছে- শ্রমকল্যাণ উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট দেশে কর্মরত বাংলাদেশী অভিবাসীকর্মীদের কর্মস্থল পরিদর্শন করবেন এবং প্রয়োজনে নিয়োগকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এবং অভিবাসী শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণ ও অধিকার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি সম্পাদন এবং বাস্তবায়নসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ সরকারের নিকট বার্ষিক প্রতিবেদন দিবেন। বিএমইটি’র তথ্য মতে, শ্রমিক গ্রহণকারী ১৬৮টি দেশের মধ্যে শ্রমিকঘন ২৭টি দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের অধীন শ্রমিককল্যাণ উইং করা হয়েছে। আইনে বর্ণিত দায়-দায়িত্ব পালনে এই উইংগুলোর অবহেলা ও উদাসীনতা সহজেই অনুমেয়। এ আইনে আরো বলা হয়েছে- কোনো অভিবাসীকর্মীর, বিশেষত বিদেশে আটককৃত কিংবা আটকেপড়া বা বিপদগ্রস্তকর্মীর দেশে ফিরে আসার এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন বা দূতাবাসের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়ার অধিকার থাকবে। আইনানুযায়ী অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদ্যসদ্যের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণে দায়িত্ব রয়েছে সরকারের ওপর। অভিবাসীকর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কল্যাণ ও উন্নয়ন সাধনে তাদের জন্য সরকার ব্যাংক ঋণ, কর রেয়াত, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, ইত্যাদি প্রবর্তন এবং সহজলভ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। 

এছাড়াও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন, ২০১৮-তে বোর্ডের উল্লেখযোগ্য কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে: যুদ্ধাবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যকোনো জরুরি পরিস্থিতির কারণে অভিবাসীকর্মীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া; দেশে প্রত্যাগত অভিবাসীকর্মীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষা ও পুনর্বাসন; বিদেশে কর্মরত কোনো অভিবাসীকর্মী নির্যাতনের শিকার, দুর্ঘটনায় আহত, অসুস্থতা বা অন্যকোনো কারণে বিপদগ্রস্ত হলে তাদেরকে উদ্ধার, দেশে আনয়ন এবং, প্রয়োজনে আইনগত ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান; প্রবাসীদের মৃতদেহ দেশে আনয়ন এবং প্রয়োজনে দাফন-কাফন বা অন্তেষ্টিক্রিয়া বাবদ আর্থিক সহায়তা প্রদান; বিদেশে মৃত্যুবরণকারী অভিবাসীকর্মীর মৃত্যু ও পেশাগত কারণে অসুস্থতাজনিত ক্ষতিপূরণ, বকেয়া বেতন, ইন্সুরেন্স ও সার্ভিস বেনিফিট আদায়ে সহায়তা এবং নির্ভরশীলদের আর্থিক অনুদান প্রদান; এবং সার্বিকভাবে প্রবাসীদের কল্যাণার্থে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। নারী অভিবাসীকর্মীদের কল্যাণে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বোর্ডের রয়েছে আইনগত বাধ্যবাধকতা। দেশে ফেরত আসা নারী অভিবাসীকর্মীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বোর্ড যথাযথ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। 

প্রবাসে দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক কিংবা বিপদে পড়ে অসময়ে দেশে ফেরা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কি আদৌ আইনে বর্ণিত কোনো দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে আমাদের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড? শ্রমিকদের চাঁদায় গঠিত বোর্ডের তহবিল থেকে মৃতদেহ দেশে আনা, দাফনের জন্য ৩৫ হাজার টাকা আর পরিবারকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া ব্যতীত আর কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড করছে বলে জানা যায়নি। 

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে অনেক অর্থ জমা থাকলেও, তা ব্যয় হচ্ছে না শ্রমিকদের কল্যাণে। এই সমূহ সংকটে এসব তহবিল থেকে অভাবগ্রস্ত অভিবাসনশ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। অভিবাসীদের প্রদেয় চাঁদা থেকেই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ৯৫ ভাগ মূলধন সংগৃহীত হচ্ছে। কার্যত অভিবাসীরা এ ব্যাংকের সেবা থেকে কতটুকু সুফলপ্রাপ্ত হচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখাও এখন সময়ের দাবী। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের অভিবাসন ঋণ আর ফেরত আসা শ্রমিকদের জন্য পুনর্বাসন ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ব্যাংক পুনর্বাসনে তেমন কোনো ঋণই দেয় না। এখন সেদিকেও মনযোগী হতে হবে। এছাড়াও শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণে, প্রবাসে অস্বাভাবিক মৃত্যু, নির্যাতন বা অন্যকোনোভাবে অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লেবার এটাশে নিয়োগ করা, সদ্য চালু হওয়া বাধ্যতামূলক জীবন বীমার আওতায় সবাইকে আনা এবং বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্টের পরিবর্তে নারীকর্মীদের বিদেশে পাঠানোর দায়িত্ব বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডকে দেয়া যেতে পারে। 

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিকদের অবদান থাকে সবচেয়ে বেশি। তাদের শ্রমে-ঘামেই ঘুরছে অর্থনীতির চাকা। কিন্তু যেকোনো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিও হয় তাঁদেরই। চাকরিচ্যুতি, ছাঁটাই, মজুরি কর্তন, অবৈতনিক কর্মবিরতি ইত্যাদি নানান করুণ পরিণতিই হয় তাদের নিয়তি। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষতি পোষাতে, তাদেরকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিয়েই করোনা পরবর্তী বিশ্বের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে।  

লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ

বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন