আমিষের উৎপাদন ২৫০ শতাংশ বাড়লেও কমেছে মাথাপিছু প্রাপ্তি

সাইদ শাহীন

দেশে গত এক দশকে দুধ, ডিম মাংসের উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় এসব আমিষ পণ্যের জনপ্রতি ভোগ বাড়েনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোগ কমেছে। ফলে দারিদ্র্যের হার কমে এলেও এখনো পুষ্টি সমস্যায় ভুগছে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ। করোনা পরিস্থিতিতে আমিষের প্রাপ্যতা আরো কমে গিয়ে পুষ্টি সংকট প্রকট হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবস্থার উন্নতি না হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০২৫ সালের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৭ শতাংশ কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অর্জন কঠিন হবে।

মত্স্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে যেখানে ২৯ লাখ ৫০ হাজার টন দুধ উৎপাদন হয়েছিল, সেখানে  ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন প্রায় ২৩৭ শতাংশ বেড়ে ৯৯ লাখ ২৩ হাজার টনে উন্নীত হয়। একই সময়ের ব্যবধানে মাংসের উৎপাদন প্রায় ২০ লাখ টন থেকে ২৭৭ শতাংশ বেড়ে ৭৫ লাখ টনে দাঁড়ায়। এছাড়া ডিমের উৎপাদন ৬০৮ কোটি পিচ থেকে ১৮২ শতাংশ বেড়ে হাজার ৭১১ কোটিতে উন্নীত হয়।

কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, উৎপাদন বেড়েছে তবে সেই বৃদ্ধি চাহিদার তুলনায় বেশ কম। বিশেষ করে মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিটা বেশি হলে সরকারকে গরু ছাগলের মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিতে হতো না। আবার উৎপাদনের তথ্যগুলো কতটুকু বৈজ্ঞানিকভাবে সন্নিবেশিত করা হচ্ছে সেটি দেখতে হবে। কেননা তথ্যের সঙ্গে বাজারের দামের সম্পর্ক পাওয়া মুশকিল। তবে দুধের ভোগ কমে যাওয়ার পেছনে দামের পাশাপাশি মানের প্রশ্ন রয়েছে। প্যাকেট দুধের বিষয়ে ভোক্তাদের মনে এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করছে। ফলে শহরের মানুষ পণ্যটি গ্রহণে ভীত থাকে। দুধের মানের নিশ্চয়তা দিতে পারলে ভোগ অবশ্যই বাড়বে।

এদিকে উৎপাদন বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি প্রাণিজ আমিষের জনপ্রতি ভোগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, ২০১০ সালে দুধ দুগ্ধজাত পণ্যের দৈনিক জনপ্রতি ভোগ যেখানে ৩৩ দশমিক ৭২ গ্রাম ছিল, সেখানে ২০১৬ সালে তা কমে ২৭ দশমিক ৩১ গ্রামে নেমে এসেছে। তবে গরুর মাংসের জনপ্রতি ভোগ না কমে কিছুটা বাড়লেও তার পরিমাণ খুবই সামান্য, মাত্র শূন্য দশমিক গ্রাম। অন্যদিকে ছাগলের মাংসের দৈনিক জনপ্রতি ভোগ শূন্য দশমিক ৬ গ্রাম থেকে কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশে।

আমিষ জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির বিপরীতে জনপ্রতি ভোগের চিত্র কেন বিপরীতমুখী সে হিসাব মেলানো বেশ কঠিন বলেই মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক . কেএএস মুরশিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এখানে হিসাব পদ্ধতির দুর্বলতা আছে কিনা, তা দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তবে আমার জানামতে, বিবিএসের খানা জরিপটি অত্যধিক বৈজ্ঞানিক মানসম্মতভাবেই পরিচালনা করা হয়। ফলে ভোগের তথ্যের একধরনের ভিত্তি আছে। কিন্তু উৎপাদনের তথ্য কতটুকু বৈজ্ঞানিক প্রতিনিধিত্বমূলক হচ্ছে, সেটি দেখতে হবে। তাছাড়া হোটেল, রেস্তোরাঁ কিংবা অনুষ্ঠানের খানার তথ্য জনপ্রতি ভোগে আসছে কিনা, সেটিও দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

সাধারণত যেকোনো পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ভোগে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভোগে উল্টো চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে। এর পেছনে বিপণন দুর্বলতা ক্রয়ের সক্ষমতাকেই কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক . জাহাঙ্গীর আলম প্রসঙ্গে বলেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে কোনো পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল হলো, সে পণ্যের প্রতি ইউনিটের মূল্য ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। তখন বিক্রয়মূল্য কমে ক্রেতাসাধারণের জন্য সহনীয় পর্যায়ে আসবে। কিন্তু আমাদের দেশে আমিষ জাতীয় বেশকিছু পণ্যের উৎপাদনে বেশ সফলতা এলেও ইউনিটপ্রতি বিক্রয়মূল্য না কমে উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তা সাধারণ ভোক্তাদের বড় একটি অংশের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। কারণে কম আয়ের মানুষ প্রয়োজনমতো আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। আমিষ জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ততক্ষণ অর্থবহ হবে না, যতক্ষণ তা সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না আসে।

প্রাণিজ আমিষের জনপ্রতি ভোগ না বাড়ায় এর প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতিতে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। যদিও দেশে ২০১৯ সালে পাঁচ বছরের নিচে খর্বকায় শিশুর হার ছিল ২৭ শতাংশ। স্বল্প ওজনের শিশু ২৩ শতাংশ এবং ক্ষীণ স্বাস্থ্য প্রায় ১০ শতাংশের।

জাতিসংঘের মা শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, পুষ্টিহীনতার কারণে বাংলাদেশে স্কুলগামী শিশুদের ১৮ শতাংশ রোগা-পাতলা এবং শতাংশ স্থূলকায়। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, স্কুলগামী রোগা-পাতলা শিশুর হারের দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

অপুষ্টি রোধে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের সরবরাহ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি চাহিদা বৃদ্ধিতে আরো বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ সংকট দূর করে সেগুলো দ্রুত ভোক্তাদের কাছে সহনীয় মূল্যে পৌঁছাতে হবে। আমিষ জাতীয় খাদ্যের উৎপাদন ভোগ বাড়াতে গবেষণায় জোর দিতে হবে বলে মনে করেন পুষ্টিবিদরা। কেননা বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, আগামী এক দশকে যে কয়টি আমিষ বা প্রাণিজ পণ্যের জনপ্রতি প্রতিদিনের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাবে, তার মধ্যে এগিয়ে থাকবে ডিম, মাংস দুধ।

আইসিডিডিআর,বির পুষ্টি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক . তাহমিদ আহমেদ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, গত এক দশকে পুষ্টি পরিস্থিতির নানা সূচকে ভালো করছি আমরা। তবে খর্বকায় স্বল্প ওজনের শিশুর হার কমাতে পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণ ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি, শিশুদের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

গত এক দশকে দেশে দুধের উৎপাদন প্রায় আড়াইশ শতাংশ বাড়লেও সেখানে প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অংশগ্রহণ খুব কম। দেশের মোট উৎপাদনের মাত্র - শতাংশ দুধ সংগ্রহ করে কোম্পানিগুলো। ফলে দুধ থেকে বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। আবার দেশে দুধের দাম বেশি থাকায় পাউডার মিল্ক আমদানি করছে। দুধের নানামুখী ব্যবহারের মাধ্যমে ঘাটতি মেটানোর সুযোগ থাকলেও সেটি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ এমরান বলেন, যে জেলায় সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদন হয়, সেখানে মাঝেমধ্যেই দুধ বিক্রি না করে খামারিরা রাস্তায় ঢেলে দিচ্ছেন। আবার ঠিক তার পাশের জেলার মানুষ দুধ পাচ্ছে না। দুগ্ধ খাতে বিপণনের বেদনাদায়ক চরিত্রের মধ্যে উৎপাদন বাড়ছে। দাম সহনীয় করার পাশাপাশি বিপণন দুর্বলতা কাটাতে পারলে জনপ্রতি দুধের ভোগ অবশ্যই বাড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন