আলোকপাত

উত্তরাধিকার সমস্যা ও আমাদের ব্যবসার গতিপথ

ড. আরএম দেবনাথ

প্রাক-স্বাধীনতা আমলের কথা। বঙ্গবন্ধুর তখনকার সোনার বাংলায় শত শত কোটি টাকা কেন, ১০-২০-৩০ কোটি টাকার মালিকও বাঙালি ছিল না। লাখ লাখ টাকার মালিকও ছিল বিরল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালেও একটি ফিন্যান্স কোম্পানি একা করার মতো বাঙালি ছিল না। কত টাকা লাগত? মাত্র -১০ কোটি টাকা। এমনকি ১৯৮২-৮৩ সালেও -১০ কোটি টাকা দিয়ে একা একা একটা ব্যাংক করার মতো বাঙালি ছিল না। কয়েকজন মিলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। আর আজ শত শত কোটি কোনো টাকা নয়। হাজার কোটির নিচে কোনো কথা নেই। আমাদের হিসাব এখন মিলিয়ন বিলিয়নে এই যে পরিবর্তন, উন্নতি, এতে শত শত বিজনেস হাউজ, বিজনেস গ্রুপের জন্ম হয়েছে। তারা ব্যাংক-বীমা, আমদানি-রফতানি ব্যবসা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অর্থনীতির সব খাতে দোর্দণ্ড প্রতাপে কাজ করে যাচ্ছে। মুখে মুখে তাদের নাম। তারা শুধু ব্যবসাই নিয়ন্ত্রণ করছে না, নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতি, সমাজ সংস্কৃতি। সংসদে তারাই, মন্ত্রিসভায়ও তারাই। এসবই বাস্তব সত্য। এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, সব ঠিকঠাক আছে তো? গ্রুপ অব কোম্পানিজের কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ঠিকঠাক চলছে তো? তাদের আয়-ব্যয়, লেনদেন, সম্পদ-দায়, পুঁজি, নগদ টাকার প্রবাহ (ফ্লো), ঋণ, ব্যাংকঋণ, বেচা-কেনা, দায় পরিশোধের অবস্থা ঠিক আছে তো? ব্যাংকের ঋণের টাকা ঠিকমতো পরিশোধিত হচ্ছে তো? তারা অতিরিক্ত ঋণ করে ফেলেনি তো? ঋণের টাকা ডাইভার্ট করেনি তো? হিসাববিজ্ঞানে ব্যবহূত যত অ্যাকাউন্টিং রেশিও আছে, যা দিয়ে একটি কোম্পানির শক্তি বোঝা যায়। যেসব ঠিক আছে তো? সর্বোপরি মালিকদের শরীর-স্বাস্থ্যের অবস্থা কী? উত্তরাধিকারীরা দক্ষ উপযুক্ত কিনা? তারা দেশে আছে তো? এমন ডজন ডজন প্রশ্ন এখন উঠছে। উঠছিল কভিড-১৯-এর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার আগেই। সরকারের ঢালাও সাহায্য নীতি, ঘন ঘন ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণের কাঠামোগত পরিবর্তন, ডিফল্টারের সংজ্ঞা, প্রভিশনিংয়ের সংজ্ঞা পরিবর্তন, ব্যাংক মালিকদের মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা প্রদান ইত্যাদি দেখে প্রশ্ন জাগছিল সবার মনে। তাহলে কী হচ্ছে? তাহলে কি ব্যাংক, শিল্প কোম্পানি, বিজনেস গ্রুপগুলোর আর্থিক অবস্থায় কোনো আধোগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে? প্রশ্নটি গুরুত্ব পায় অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামালের একটি উপদেশে। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর পরই ব্যাংকারদের সাবধান করেন এবং বলেন, যেসব শিল্পপতি-ব্যবসায়ীর ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে, তাদেরকে ঋণ দিতে বারণ করেন (১০..১৯) ঋণ দেয়ার আগে ক্যাশ ফ্লো দেখতে বলেন। সিকিউরিটি ভালো করে বিচার করতে বলেন। পুরনো ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় ফিরিয়ে আনতে বলেন। এরপর এও বলেন যে যারা টাকা বিদেশে খরচ (বিনিয়োগ) করতে চায়, তারা বিদেশে চলে যাক। বলা বাহুল্য, অর্থমন্ত্রীর এসব মন্তব্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। এর মধ্যে নানা সমস্যার কথাও লুক্কায়িত। এরই মধ্যে একটা বড় সমস্যার কথা সামনে এসেছে। ব্যবসার কথা তো ঠিকই আছে? মালিকদের ব্যক্তিগত পারিবারিক অবস্থা কী? অনেক মালিক প্রয়াত হয়েছেন, যারা শ্রম মেধা দিয়ে কোম্পানির পর কোম্পানি গঠন করেন। নানা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। আমদানি ব্যবসা থেকে জাহাজ ভাঙার ব্যবসা, ইস্পাতের ব্যবসা, আবাসন ব্যবসা, তেল শোধনাগারের ব্যবসা, গার্মেন্ট ব্যবসা ইত্যাদিতে হাত লাগান। এক পর্যায়ে সফলতার শীর্ষ পর্যায়ে যখন তখন অনেকেই প্রয়াত হন। রেখে যান ছেলেমেয়েদের। এদের অনেকেই উপযুক্ত দক্ষ। আবার অনেকেই তা নয়। লেখাপড়া, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি কম। বাবার প্রচুর ধন-সম্পত্তি, ব্যাংকের প্রচুর ঋণ রয়েছে। ব্যাংকাররা মূল মালিককে ভালো করে চেনেন বলে এবং মালিকের ছেলে বলেই প্রচুর ঋণ দিতে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজটি ছিল অপরিকল্পিত। আবার রয়েছে ভাইবোনদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব। মায়েরা সমস্যা সামলানোর মতো উপযুক্ত নন। অনেক মালিকের ছেলেমেয়ে দেশে নেই, বিদেশে। বলা বাহুল্য, সমস্যা এখন বেশ ভালোভাবে সামনে চলে এসেছে। দেখা যাচ্ছে ভালো ভালো কোম্পানি ব্যবসায় অতিরিক্ত ঋণ, অতিরিক্ত সম্প্রসারণ, মালিকের স্বাস্থ্য খারাপ, উপযুক্ত উত্তরাধিকারের অভাব, প্রচুর সম্পত্তি এবং তা দেখাশোনা করার ক্ষমতার অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারা সরকারের সাহায্যপ্রার্থী। একটি গ্রুপ তো সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে দরখাস্তই করে। বিষয়, তার কোম্পানি সরকার নিয়ে নিক। তিনি দেনাগ্রস্ত। অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, মালিক অসুস্থ। এর সঙ্গে যোগ করতে হয় আরো একটি কারণ। মালিকের উপযুক্ত উত্তরাধিকার নেই। বলা যায়, গ্রুপটির জন্ম একটি বড় গ্রুপের দ্বিধাবিভক্তির মধ্য দিয়ে। একটি আসবাবের ব্যবসা এখন ঋণখেলাপি। এর সম্পদ ব্যাংক নিলামে তুলেছে অথচ এর প্রয়াত মালিক ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী পরিশ্রমী এবং সফল। কিন্তু তার উত্তরাধিকারীরা ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে গাড্ডায় পড়েন। দেখা যাচ্ছে, অনেক অনেক বড় গ্রুপ পেছনে পড়ে যাচ্ছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর সামনে আসছে নতুন নতুন কোম্পানি, যার এগিয়ে যাওয়ার পেছনে রাষ্ট্রশক্তি কার্যরত। অর্থমন্ত্রী ২০১৯ সালের ২২ জুন সংসদে ব্যাংক ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, কোটি টাকা তার ঊর্ধ্ব পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন এমন ঋণগ্রহীতার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। তাদের কাছে ব্যাংকের পাওনা লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। বিশাল পরিমাণ টাকা। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত খেলাপিদের মধ্যে আছে রহিম আফরোজ, দেশবন্ধু গোলাম মোস্তফা, অটবি, মেজর মান্নান, রূপায়ণ, মন্নু ফ্যাব্রিকস; যারা ব্যবসা ক্ষেত্রে একসময় সফল ছিল। সুনাম ছিল তাদের। দেশে বড় একটি নির্মাণ সংস্থা রয়েছে, যাকে ব্যাংক অনেকদিন পারফরম্যান্স গ্যারান্টি দেয়নি। যতদূর শুনেছি এর মালিক সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন এবং এর উত্তরসূরিরা যথেষ্ট দক্ষ উপযুক্ত নন। অথচ এদের ব্যাংকে দেনা প্রচুর। বেশকিছু বড় গ্রুপ রয়েছে দেশে, যারা শতকোটি ডলার তার বেশি পরিমাণ আয়ের মালিক (১২..২০) দৈনিক বণিক বার্তার খবরে প্রকাশ, এমন কোম্পানির সংখ্যা কমপক্ষে ১৩। কে খান তালিকার শীর্ষে। দুই তিন নম্বরে আছে বসুন্ধরা, মেঘনা। চতুর্থ যমুনা। এর পরের স্থানে রয়েছে যথাক্রমে স্কয়ার, টিকে, আকিজ, বেক্সিমকো, ইউনাইটেড, সিটি, পিএইচপি, প্রাণ পারটেক্স। এরা দেশের রাজস্বের শতাংশের ভাগীদার। এসব গ্রুপের সবার অবস্থান সমান নয়। আমার লেখার বিষয়ও তা নয়। এরা এত বড় যে এদের সম্পর্কে সবাই জানে। এখানে উল্লেখ্য, এদের প্রায় প্রত্যেকের ব্যাংকঋণ হাজার কোটি টাকার ওপরে। একেএস বলে একটি গ্রুপ আছে, তাদের ব্যাংকঋণ হাজার কোটি টাকা। এরা যা চায়, ব্যাংক বিনা দ্বিধায় তাই দিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, এসব বড় ঋণগ্রহীতার জামানতের পরিমাণ খুব বেশি নয়। অনেকের জামানতই কোম্পানি গ্যারান্টি অথবা পার্সোনাল গ্যারান্টি। আমরা বিলের কিছু জানি না। সরকার জানে কিনা জানি না, তাদের নেটওয়ার্থ কত? এদের মাসিক ক্যাশ ফ্লো কত? কতবার তারা ঋণ পুনঃতফসিল করিয়েছেন। তাদের ঋণ পুনর্গঠন কিনা ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা, এদের উত্তরসূরিদের অবস্থা কী? মূল মালিকদের অনুপস্থিতিতে বা প্রয়াণে উত্তরসূরিরা কি তাদের বাবার সাম্রাজ্য ধরে রাখতে পারবে? দেখা যায় অনেকেরই ছেলেমেয়ে বকে গেছে। এত বড় সম্পত্তি রক্ষা করার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। সম্পত্তি রক্ষা করার মতো ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, অ্যাকাউন্টিং দক্ষতা, মার্কেটিং দক্ষতা, ভবিষ্যৎ চিন্তার ক্ষমতা নেই। বলা বাহুল্য, এসবের অভাবে পাকিস্তান আমলের অনেক বড় বড় ব্যবসা শেষ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভাই-বোনের গণ্ডগোলে তাদের পৈতৃক কোম্পানি হয়েছে বিলীন। উদাহরণ আছে, ইচ্ছা করেই দিচ্ছি না। আমি একে উত্থান-পতনের ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছি।

আমরা জানি, চট্টগ্রাম দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। সেখানে কার্যরত শত শত কোম্পানি গ্রুপ অব কোম্পানিজ। অনেক ক্ষেত্রে সেখানেই সফলতা দেখিয়ে উদ্যোক্তারা ঢাকায় এসে বড় বড় ব্যবসার মালিক হয়েছেন। এই চট্টগ্রামে যেমন সফলতা আছে তেমনি উদ্যোক্তাদের বিফলতাও প্রচুর। যেমন ঠিক এই মুহূর্তে সময়ের ভালো ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো হয় বিলীন হয়েছে, না-হয় বিলীনের পথে। উদাহরণস্বরূপ যাদের নাম বলা যায় (বণিক বার্তা ১৪.০৯.২০), তারা হচ্ছে ইলিয়াস-ব্রাদার্স, আম্বিয়া গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপ, মাওলানা গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ ইত্যাদি। প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, এসব সুনামি প্রতিষ্ঠান এখন মরমর। এর প্রধান কারণ উত্তরাধিকারীদের মধ্যকার মালিকানা সমস্যা। এদের কাছে ব্যাংকের শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা পাওনা। এরা বিপুল সম্পদ-সম্পত্তির মালিক। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে ব্যাংকের পাওনা টাকা দিচ্ছে না। ব্যবসাও করতে পারছে না। নারায়ণগঞ্জের বড় চিনি ব্যবসায়ী সম্প্রতি মারা গেছেন, তার স্ত্রীও মারা গেছেন। ছেলেরা কোম্পানির দায় নিতে রাজি নয়। রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। অতএব, সাধু সাবধান। উত্তরাধিকার সমস্যা, টাকা ডাইভারশন, সম্পদ পাচার, অতিরিক্ত সম্প্রসারণ ইত্যাদি এখনকার বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত হয়েছে। এই সমস্যার দিকে নজর দেয়া দরকার এবং তা যাতে আর না বাড়ে, এজন্য এক্ষুনি পদক্ষেপ দরকার।

 

. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন