বৈশ্বিক উষ্ণায়নের থাবায় উপকূলে ভুতুড়ে গ্রাম

বণিক বার্তা অনলাইন

আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত হারে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এরই মধ্যে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক জায়গায় বিশেষত নিম্নাঞ্চলগুলোতে এর বড় প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র ফিজির মানুষ ও পরিবেশের জন্য এটি বড় বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট উঁচু জোয়ারে জমি, ফসল এবং এমনকি পুরো গ্রাম সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ধ্বংসাত্মক ঝড় ও প্রবাল ব্লিচিং তো রয়েছেই। 

অতি উষ্ণতায় টিস্যু থেকে শৈবাল মুক্ত হয়ে প্রবালগুলো শ্বেতবর্ণ ধারণ করাকেই বলে প্রবাল ব্লিচিং। এর ফলে এক পর্যায়ে প্রবাল ক্ষয় পেতে থাকে।

প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় ৩০০টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত দেশ ফিজি। দেশটির অনেকগুলো দ্বীপ ছোট ও নিম্নাঞ্চল এবং সেখানকার মানুষরা সমুদ্রের কাছাকাছি বসবাস করে। প্রবাল প্রাচীরের জন্য বিখ্যাত দেশটির লোকজন জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিকাজ, মাছ শিকার ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। ঘন ঘন ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ও প্রবাল ব্লিচসহ উষ্ণতা ও ক্রম প্রসারমান সমুদ্র সেখানে স্থানীয়দের জীবন জীবিকার ওপর বড় প্রভাব ফেলছে।

জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে দেশটিকে প্রভাবিত করছে- তা ব্যাখ্যা করেছেন ফিজির ইউনিভার্সিটি অব দ্য সাউথ প্যাসিফিকের শিক্ষক ড. ট্যামি টেব। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ফিজির মতো প্রশান্ত মহাসাগরীয় ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জের জন্য আরো বেশি মারাত্মক হয়ে উঠছে। কারণ আমরা আয়তনে ছোট। বেশিরভাগ জনবসতি ও সম্প্রদায় উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত। আমাদের অবকাঠামো (রাস্তাঘাট ও ভবনগুলো) দুর্বল হওয়ায় বড় অর্থনীতির উন্নত দেশগুলোর মতো সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান স্তরের সঙ্গে আমরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারছি না। 

পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব ন্যূনতম করতে ফিজি অনেক কাজ করছে। তবে ড. টেব বলছেন, নির্গমন (গ্রিনহাউস গ্যাস) হ্রাস করার জন্য বিশ্বব্যাপী চেষ্টা আরো জোরদার করা দরকার।

প্রত্যাশা চেয়ে দ্রুত বাড়ছে সমুদ্রের স্তর 

বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক আকারে গ্রিনহাউস উন্মুক্ত হওয়ার ফলস্বরূপ উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহ ও বরফে ঢাকা অঞ্চলগুলোর বরফ (আইসক্যাপ) গলে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপ সম্প্রসারণের ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা পানির সম্প্রসারণ ও সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধি করে। 

বিশ্ব নেতারা জালবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করার লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্যারিস চুক্তিতে সাক্ষর করেছেন। তবে এই লক্ষ্য অর্জন করা গেলেও সমুদ্রের স্তরটি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। 

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের একটি দল জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটিতে দেখা গেছে, ১৯৮৩-২০০৫ সালের স্তরগুলোর তুলনায় ২১০০ সালে সমুদ্রের স্তর ২৩ সেন্টিমিটার ও ৭৭ সেন্টিমিটারের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে পারে। 

তবে উচ্চহারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বাণী হলো, স্তরটি এক মিটারেরও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে। 

সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে, আইসক্যাপগুলো ‘সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির পূর্বাভাসের হারে গলে যাচ্ছে। তার মানে হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত বাড়তে পারে। নিম্নাঞ্চলীয় দেশ ও উপকূলীয় সম্প্রদায়ের ওপর এর বড় প্রভাব পড়বে। 

ভুতুড়ে গ্রাম ভুনিডোগলোয়া 

সমুদ্রপৃষ্ঠ যদি প্রত্যাশা অনুযায়ীই বাড়তে থাকে তবে ফিজির বড় অংশ তলিয়ে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফিজির দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ ভানুয়া লেভুর ছোট্ট গ্রাম ভুনিডোগলোয়া এখন ভুতুড়ে গ্রাম। এটি ২০১৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিত্যক্ত প্রথম গ্রাম। ওই সময় গ্রামটির বাসিন্দারা দুই কিলোমিটার দূরে উঁচু জমিতে আশ্রয় নেন। সেখানেই গড়ে তোলেন নতুন বসতি।

গ্রামটির প্রধান সাইলোসি রামাতু বলেন, আমাদের বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছিল। কারণ গ্রামে একটুতেই পানি ঢুকে পড়তো। প্রায় হাঁটু পানি জমে যেত, আর বাড়ির চারপাশে থাকতো সাঁতার পানি।

বাধ্যতামূলক এই বাস্তুচ্যুতির কারণে গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছে। গ্রাম প্রধান বলেন, যদিও এখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে অনেকখানি নিরাপদ আছি, তবুও আমাদের মন পড়ে আছে সেই আগের গ্রামে।

শুধু এই গ্রাম নয়, ফিজির ৮০টিরও অধিক নিম্ন-উপকূলীয় জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। আর এমন সমস্যায় পড়া ফিজি একমাত্র দেশ নয়, কেন্দ্রীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ কিরিবাতির কয়েকটি দ্বীপ বর্তমান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দুই মিটার উঁচুতে রয়েছে। সুতরাং সমুদ্র স্তর বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে বা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। 

এছাড়া বাংলাদেশ, নেদারল্যান্ডস ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে ভবিষ্যতে উপকূল রেখায় আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। দেশগুলোর উপকূলবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর বাইরেও পৃথিবীর অনেকগুলো ছোট-বড় শহর উপকূলে অবস্থিত এবং এগুলো ক্রমবর্ধমান সমুদ্র দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উন্নত ও বড় দেশগুলোর তুলনায় ছোট দেশ ও অঞ্চলগুলোতে বেশি অনুভূত হয়। কারণ হলো উন্নত দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কীভাবে হ্রাস করা যায় তারজন্য অনেক বেশি অর্থ ও বিকল্প রয়েছে তাদের।

বিবিসি অবলম্বনে শিহাবুল ইসলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন