চাকরি না হওয়ার সম্ভাব্য কারণ

মুত্তাকিন হাসান

চাকরির বাজার দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রের সংখ্যা বাড়লেও তার চেয়ে বেশি বাড়ছে চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি যে চাকরি প্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট নয় তা আমরা বেশ আগে থেকেই জানি। সময়ে সময়ে প্রয়োজন হচ্ছে বিভিন্ন দক্ষতা। অনেক দক্ষতা অর্জনের পরেও কেমন জানি অজানাতে ঘোরপাক খাচ্ছি। তরুণদের কথা বাদই দিলাম, অনেক অভিজ্ঞ; যারা প্রফেশন বলয়ে পরিচিত- তারাও চাকরি হারিয়ে বা ছেড়ে কোথাও যোগ দিতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতির জন্য অনেকসময় নিজেরাও দায়ী। কিছু ‘ছোটখাটো’ ভুলের জন্য আমরা অভিজ্ঞ বা দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও কাঙ্খিত চাকরি অর্জনে ব্যর্থ হই। সম্ভাব্য যেসব ভুলের কারণে চাকরি প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়ে-  

১। সঠিকভাবে সিভি প্রদানে ব্যর্থতা:
চাকরি সন্ধানের ক্ষেত্রে অনেক আবেদনকারীই সাক্ষাৎকারের ডাক পান না। এমনও আছেন অনেকবার অনেক প্রতিষ্ঠানে সিভি জমা দিয়েছেন, কিন্তু সাক্ষাৎকারের ডাক পাননি। অনেক কারণেই এমন ঘটতে পারে। নিয়োগকর্তা যে ধরনের প্রার্থী খুঁজছেন, আপনার সিভি হয়তো তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অথবা সিভিতে আপনার তথ্যাদি উপস্থাপনে কোথাও ত্রুটি রয়ে গেছে কিংবা সিভিতে সব ধরনের তথ্যই উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও উপস্থাপন কৌশলে কোথাও হয়তো ভুল হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে, আপনার যোগ্যতা প্রমাণে সবচেয়ে উপযুক্ত তথ্যটিই অন্য সব তথ্যের আড়ালে পড়ে গেছে এবং নিয়োগদাতার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সিভিতে এমন অজস্র কৌশলগত দুর্বলতা থেকে যেতে পারে, যা কাম্য নয়। সিভি হচ্ছে চাকরি প্রার্থীর প্রতিকৃতি। নিয়োগকর্তা একনজরে দেখে উক্ত প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে চাকরির জন্য আহবান করেন। তাই চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সঠিক এবং ইম্প্রেসিভ সিভির গুরুত্ব অনেক।  

২। চাকরি বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত প্রধান দায়িত্বগুলো সম্পর্কে অবগত না হওয়া:
খবরের কাগজের বা অনলাইন পোর্টালের চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখেই আপনি পুরো বিজ্ঞাপনটি ভালোভাবে না পড়ে শুধু পদবির টাইটেল দেখে আবেদন করলেন। তারপর হঠাৎ মোবাইলে এসএমএস বা মোবাইলে ফোনে সাক্ষাৎকার বা লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাক আসলো। কোন পদের জন্য কোথায় আবেদন করেছিলেন- ইতিমধ্যে আপনি অনেকটাই ভুলে গেছেন। তবুও চাকরি পাওয়ার প্রত্যাশায় এক বুক আশা নিয়ে সাক্ষাৎকার বা পরীক্ষা দিতে গেলেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পদের দায়িত্বগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায়-সাক্ষাৎকার বা পরীক্ষা ভালো হলো না। হতাশা-হতাশাই থেকে গেল। তাই, সিভি বা রিজিউমি পেশ করার পূর্বে চাকরি বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত প্রধান দায়িত্বগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া অত্যাবশ্যক।  

৩। উচ্চাকাঙ্ক্ষা:
কেউ কেউ চাকরিতে ঢুকতে না ঢুকতেই মনের ভেতর অনেক প্রত্যাশা বা আকাঙ্ক্ষা পোষেন। আমার এই পজিশন হওয়া দরকার, আমার এত টাকা স্যালারি হওয়া দরকার। আহ! নামের সাথে যদি ম্যানেজার বা এজিএম লাগাতে পারতাম। যাই হোক ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন। সময়টা হয়তো কারো জন্য কম আবার অন্য কারো জন্য বেশী হতে পারে। কিন্তু সময় আপনাকে দিতেই হবে নচেৎ এই সময়ই আপনাকে পিছিয়ে নিয়ে যাবে। আপনি যদি সত্যিই যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে থাকেন তাহলে নিয়োগকর্তা আপনার মূল্যায়ন অবশ্যই করবেন।  

৪। বেশী কথা বলা: অনেকের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত কথা বলার জন্যও চাকরি অর্জনে ব্যর্থ হয়। চাকরির বা অন্য যে কোনো  সাক্ষাৎকার হোক না কেন বাচালতা কেউ প্রশ্রয় দিতে চায় না। আমাদের মনে রাখা উচিত চাকরি নিয়োগকর্তাদের সময় আমাদের চেয়েও মূল্যবান তারা নিরর্থক কথা শুনতে পছন্দ করেন না। কিন্তু আমাদের এমন অনেকে আছি সর্বক্ষেত্রে নিজেদের জাহির করতে চেষ্টা করি। স্বল্প সময়ে অল্প কথায় নিজেকে প্রকাশ উচিত। নিজের যোগ্যতা প্রমাণের অন্যতম প্রধান জায়গা হচ্ছে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করা। সেখানে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতার পরিচয় যেমন দিতে হবে, তেমনি গুরুত্ব দিতে হয় আদব-কায়দা বা ভদ্রতা ও শারীরিক ভাষার প্রতি। কারণ এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে আপনার আত্মবিশ্বাস ও স্মার্টনেসের বিষয়টি। বাতুলতা কখনোই স্মার্টনেস নয়।  

৫। নেটওয়ার্কিং তৈরি না করা: বর্তমান যুগ হচ্ছে নেটওয়ার্কিং যুগ। আপনি কী জানেন- তা নয় বরং আপনি কাকে কতটা জানেন এটাই অনেক ক্ষেত্রে বেশি জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ। বেশীরভাগ কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজারগণ রেফারেন্সের মাধ্যমেই কর্মী নিয়োগ করে থাকেন। সেই ক্ষেত্রে আপানার পরিচিতি এবং তাদের পরিচিতি একমাত্র আপনার চাকরির উৎস। রেফারেন্স এর মাধ্যমে এসব চাকরি আপনি খোঁজে পেতে পারেন। অতঃপর আপনি সেখানে ফোন বা ইমেইল করতে পারেন। মাঝে মাঝে তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন। এছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার পূর্বে লিংকডইন বা অন্য কোন সামাজিক মাধ্যমের সহযোগিতা নিয়ে কানেক্টর খুঁজে বের করুন। অনেক সময় কেউ হয়তো আপনাকে সাড়া নাও দিতে পারে বা কিছুটা বিরক্তও হতে পারে সে জন্য আপনি নিজে ভাব নিয়ে নেটওয়ার্কিং করা বন্ধ করলেন মানে আপনি আপনার চাকরি পাবার অনেকটা পথ বন্ধ করে দিলেন। মাঝে মাঝে অন্তত হাই হ্যালো করতে পারেন বা কোনো অকেশনে উইশ করলেন। চিন্তা করতে হবে দরকারটা কিন্তু আপনার। 

৬। সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনি কেমন সচেতন: বর্তমানের সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু আপনার ইমেজ বহিঃপ্রকাশের জায়গা। আজকালের অনেক নিয়োগকর্তা  আপনার সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলো পর্যবেক্ষণ করে। ২০১৫ সালের ওয়ার্কোপলিস জরিপে, প্রায় অর্ধেক (৪৮%) কোম্পানি বলেছেন যে তারা সামাজিক প্রোফাইলগুলিতে যা দেখছেন তার ভিত্তিতে প্রার্থী প্রত্যাখ্যান করেছেন। ওয়ার্কোপলিসে এমন একজন প্রার্থীর সন্ধান করেছে যার ফেসবুক প্রোফাইল ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে যে তিনি কেবল একটি মোজা (তার পায়ে নয়) পরা অবস্থায় আছেন। আপনার প্রোফাইল ছবিটি ব্যক্তিগত নয়। এটি বিজ্ঞতার সাথে চয়ন করুন।   

৭। সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেকে বেশী ‘শো আপ’ করা: পেশার ধরন অনুযায়ী সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেকে একটিভ রাখা উচিত। কিছু কিছু কোম্পানি আছে যারা এ কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানান। আবার অনেক কোম্পানি আছে যাদের কর্তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতামাতিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যদি আপনি ফেসবুকে বিভিন্ন ছবি বা পোস্ট বা লাইভ করেন তাহলে অনেকে মনে করবেন আপনি সব সময় নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে থাকেন কাজ করবেন বা কাজে মনোযোগ দিবেন কখন। 

৮। পেশাদারভাবে চাকরি থেকে ইস্তফা না দেয়া:
অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বা অন্য কোনো কারনে যখন কোম্পানি থেকে বিদায় নিতে হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির সহকর্মী বা কর্তা ব্যক্তিদের সম্পর্কে খারাপ অনুভূতি বা বিরক্তি মনে আসলে তার বহিঃপ্রকাশ যেন না ঘটে। কারণ আপনার পরবর্তী সম্ভাব্য নিয়োগকর্তা আপনার পূর্বতন কোম্পানিতে আপনার স্বভাব চরিত্র বিষয়ে জানতে পারেন। তাই চাকরি ছাড়লেও পূর্বতন কোম্পানির সকল ব্যক্তিদের সাথে পেশাসুলভ সম্পর্ক রাখা উচিত। রাজনীতির যেমন শেষ বলতে কিছু নেই তেমনি প্রাইভেট কোম্পানি চাকরির শেষ বলে কিছু নেই। এমনও হতে পারে আপনি আবার আপনার কোনো এক পূর্বতন কোম্পানিতে আবার ফিরে আসতে হলো তখন আপনার অতীত আপনার হয়ে সাক্ষ্য দিবে।  

৯। নিজেকে আপডেট রাখা:
আমাদের বেশীরভাগ আগে ফিচার ফোন (বাটনওয়ালা) ব্যবহার করতাম। আর এখন করি স্কিন টাচ তা আবার এন্ড্রয়েড। প্রযুক্তি উৎকর্ষতায় পুরো বিশ্ব  এবং জ্ঞানের ভাণ্ডার এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে এ পৃথিবী। প্রতিনিয়ত যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সবকিছু আপডেট হচ্ছে। তাই আপনাকেও আপডেট হতে হবে। যদি হতে হয় তাহলে সবসময় চেষ্টা করুন নতুন কিছু শিখতে এবং করতে যা চাকরি খোঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বর্তমান চাকরির বাজারে এগিয়ে থাকতে হলে আপনাকে সবদিক চিন্তা করে আগাতে হবে। তা না হলে আপনার চাকরি জীবনের গল্প ভূমিকাতেই শেষ। 

১০। খুঁতখুঁতে স্বভাব:
আমরা যারা চাকরি করি তারা বাধ্য হয়েই জীবনের জন্য চাকরি করতে হয়। তাই সব কিছু নিজের মতো করে ভাবলে চলবে না। চাকরি করতে হলে কিছুটা সেক্রিফাইস করতে হবে। নিজের শতভাগ প্রত্যাশা অনুযায়ী সব কিছু হয় না। চাকরির ক্ষেত্রেও তাই। ধরুন হয়তো আপনাকে কোম্পানি গাড়ি দিচ্ছে ইচ্ছুক, আপনি বলছেন আমার এই কালার বা এই মডেলের গাড়ি চাই...ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে আপনার যেমন ভালো রুচিবোধ প্রকাশ পায় একই সাথে আপনার খুঁতখুঁতে স্বভাবও প্রকাশ পায় যা আপনার জন্য মঙ্গলজনক নাও হতে পারে।

লেখক: ব্যবস্থাপক, মানব সম্পদ ও প্রশাসন
মুন্ডিফার্মা (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড   

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন