ফিনসেনের নথি ফাঁস

ব্যাংকিং চ্যানেলে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের সন্দেহজনক লেনদেন

বণিক বার্তা ডেস্ক

অর্থের উৎস নিয়ে সন্দেহ ছিল। তার পরও গত দুই দশকে বিপুল পরিমাণ সন্দেহজনক অবৈধ অর্থ লেনদেন করেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের (ফিনসেন) গোপন নথিতে তথ্য উঠে এসেছে। খবর রয়টার্স ডয়েচে ভেলে।

এসব নথিতে পাঁচটি বৈশ্বিক ব্যাংকের নাম বেশি উঠে এসেছে। এগুলো হলো এইচএসবিসি হোল্ডিংস, জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোম্পানি, ডয়েচে ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক অব নিউইয়র্ক মেলন করপোরেশন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম বাজফিড নিউজসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক ফিনসেনের কাছে দাখিলকৃত সন্দেহজনক কার্যক্রম প্রতিবেদনের (এসএআর) ওপর ভিত্তি করে। এমন হাজার ১০০টির বেশি এসএআর বাজফিড নিউজের হাতে এসেছে, যেগুলো তারা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) অন্যান্য সংবাদ সংস্থার সঙ্গে শেয়ার করেছে।

আইসিআইজে জানিয়েছে, যেসব নথি ফাঁস হয়েছে, তাতে ট্রিলিয়ন ( লাখ কোটি) ডলারের বেশি অর্থ লেনদেনের তথ্য রয়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পরিমাণ অর্থ লেনদেন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইন্টারনাল কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট এসব অর্থ লেনদেনকে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করে ফিনসেনের কাছে এসএআর জমা দিয়েছে।

আইসিআইজে বলছে, অর্থ যে অবৈধভাবে লেনদেন করা হয়েছে, তা কিন্তু এসএআরগুলো প্রমাণ করে না। তবে এসব অর্থের উৎস নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কমপ্লায়েন্স বিভাগের সন্দেহ ছিল। আর যে এসএআর ফাঁস হয়েছে, তা ফিনসেনের কাছে দাখিল হওয়া মোট প্রতিবেদনের ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র।

মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কম্পট্রোলার অব দ্য কারেন্সি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোনো সন্দেহজনক লেনদেন প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হলে ব্যাংকগুলোকে এর ৬০ দিনের মধ্যে এসএআর জমা দিতে হয়। তবে আইসিআইজের প্রতিবেদন বলছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ধরনের প্রতিবেদন জমা দিতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার অন্যান্য অপরাধ বন্ধের প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এসএআরগুলো। এসব প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যায়।

গতকাল গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনগুলোয় অর্থ পাচার অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে। দুর্বলতার কারণে ব্যাংকিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ তহবিল সরানোর সুযোগ রয়ে গেছে।

বিভিন্ন এসএআরে উল্লেখিত সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের মতো অফশোর করস্বর্গে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর জন্য অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টের প্রকৃত মালিক কে, তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জানা থাকে না। এই বিপুল পরিমাণ লেনদেনের পেছনে কে রয়েছে, তা জানতে শীর্ষ ব্যাংকগুলোর কর্মীরা প্রায়ই গুগল সার্চের সহায়তা নেন বলে আইসিআইজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আইসিআইজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফাঁস হওয়া নথিতে যে লাখ কোটি ডলার অবৈধভাবে লেনদেন করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়েছে, তার সঙ্গে ১৭০টির বেশি দেশের ব্যাংক গ্রাহকরা জড়িত। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের মধ্যে কেবল ডয়েচে ব্যাংকের মাধ্যমেই লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার। এছাড়া জেপি মরগান চেজ লেনদেন করেছে ৫১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। 

প্রতিবেদনে যেসব লেনদেনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ভেনিজুয়েলা, ইউক্রেন মালয়েশিয়ার সম্ভাব্য দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য জেপি মরগানের মাধ্যমে তহবিল লেনদেন, এইচএসবিসির মাধ্যমে পঞ্জি স্কিমের অর্থ স্থানান্তর এবং ডয়েচে ব্যাংকের মাধ্যমে একজন ইউক্রেনীয় ধনকুবেরের অর্থ লেনদেন।

আইসিআইজের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট আটটি লেনদেনের খোঁজ পাওয়া গেছে। লেনদেনগুলো হয়েছিল ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, যার পরিমাণ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৭ ডলার। এর মধ্যে অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় এসেছে লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৩ ডলার। আর বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়েছে লাখ ৯৫ হাজার ২০৪ ডলার।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের কাছে দেয়া এক বিবৃতিতে এইচএসবিসি বলেছে, আইসিআইজে যেসব তথ্য দিয়েছে, সেগুলো সবই পুরনো ঘটনা। আমরা কয়েক বছরের চেষ্টায় ৬০টির বেশি অঞ্চলে আমাদের আর্থিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা জোরদার করেছি। একই ধরনের কথা বলেছে ডয়েচে ব্যাংক। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড তাদের বিবৃতিতে বলেছে, আমরা আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের দায়িত্বকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। কমপ্লায়েন্স কার্যক্রমে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ রয়েছে আমাদের।

ব্যাংক অব নিউইয়র্ক মেলন এসএআর নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও তারা রয়টার্সকে জানিয়েছে, তারা প্রযোজ্য সব আইন বিধি পুরোপুরি মেনে চলে এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষগুলোকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করে। অন্যদিকে জেপি মরগান চেজ তাদের বিবৃতিতে বলেছে, অর্থ পাচারবিরোধী সংস্কারে আমরা নেতৃত্বসুলভ ভূমিকা পালন করেছি। গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আমাদের কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।

এদিকে এসএআর ফাঁস হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না ফিনসেন। সম্প্রতি নিজেদের ওয়েবসাইটে দেয়া এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, আমরা লক্ষ করছি বিভিন্ন মিডিয়া অনৈতিকভাবে ফাঁস হওয়া এসএআরের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশের চেষ্টা করছে। অবৈধভাবে এসএআর প্রকাশ এক ধরনের অপরাধ, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন