মহামারী আমাদের স্বপ্নকে বদলে দিচ্ছে

বণিক বার্তা ডেস্ক

আমাদের অনেকের কাছে কভিড-১৯-এর দুনিয়াকে বিকল্প বাস্তবতা বলে মনে হয়। দিনরাত আমরা একই বৃত্তের মাঝে বন্দি থাকি। আমাদের দরজার কাছে যেসব মুদি দোকানের পণ্য আসে সেগুলো ছুঁতেও আমরা ভয় পাই। যদি আমরা বাসার বাইরে যাই মাস্ক পরে বেরুতে হয়, না পরে থাকা কারো পাশ দিয়ে যেতে আমাদের ভয় লাগে। মাস্ক পরা মানুষের চেহারা চিনতে আমাদের সমস্যা হয়। যেন আমরা কোনো এক স্বপ্নে বসবাস করছি।

কভিড-১৯ আমাদের স্বপ্নের জগেকও উল্টে দিয়েছে: আমরা কতটা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নের কতটা আমরা মনে রাখতে পারি এবং আমাদের স্বপ্নের চরিত্রগুলোকেও। বছরের শুরুতে যখন বিস্তৃতভাবে ঘরে থাকার নির্দেশনা আসে, সে সময় আমাদের সবাইকে সমাজের ভেতর অনেকটা অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, যাকে আমরা বলছি স্বপ্নের স্ফীতি: বৈশ্বিকভাবে মানুষের প্রগাঢ়, উদ্ভট স্বপ্ন দেখার কথা শোনা যায়। যার অনেকগুলোই হচ্ছে করোনাভাইরাস এবং সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কিত। সময় করোনাভাইরাস স্বপ্ন, লকডাউন স্বপ্ন কভিড দুঃস্বপ্ন টার্মগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রে স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে বিস্তৃতভাবে পরিবর্তন আসার কথা শোনা যায় ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেন এবং ১৯৮৯ সালের সানফ্রান্সিসকো ভূমিকম্পের  মতো ভয়ানক ঘটনাগুলোর পর। 

তবে এবারই বৈশ্বিকভাবে স্বপ্ন দেখায় বেশ পরিবর্তন দেখা গেছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগেও যা প্রথমবার। পরিস্থিতি গবেষণার জন্য স্বপ্নকে তাত্ক্ষণিকভাবে আকর্ষণীয় উপাদান করে তোলে। একটি স্বপ্নের ঘটনা হিসেবে মহামারী নজিরবিহীন।

কিন্তু এটা আসলে কেমন ঘটনা? কেন এটা এমন জোরের সঙ্গে ঘটেছিল? এটা খুঁজে বের করার জন্য হার্ভার্ডের সহকারী অধ্যাপক ড্রিমিং জার্নালের প্রধান সম্পাদক ডেইরড্রি বারেট একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ২২ মার্চ কভিড-১৯-এর স্বপ্ন নিয়ে একটি অনলাইন জরিপ শুরু করেন।

সানফ্রান্সিসকোর শিল্পী এরিন গ্রেস গ্রাভেলি শুরু করেন আইডিড্রিমঅবকভিডডটকম প্রোগ্রাম। এটি এমন একটি সাইট যা কিনা মহামারী সম্পর্কিত স্বপ্নের আর্কাইভ করে রাখছে। কভিডড্রিমস নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট কার্যক্রম শুরু করে। কেলি বুলকেলি নামে এক মনোবিজ্ঞানী স্লিপ অ্যান্ড ড্রিম ডাটাবেজের ডিরেক্টর ইউগোভের সমীক্ষায় হাজার ৪৭৭ জনকে অনুসরণ করেছিলেন। পাশাপাশি এলিজাভেটা সোলোমোনোভা রয়েলস ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ রিসার্চের রেবেকা রবিলিয়ার্ড ১২ বছর কিংবা তার বেশি বয়সী ৯৬৮ জনকে নিয়ে জরিপ শুরু করেন। এসব তদন্তের ফলাফল এখনো কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু এগুলো অনলাইনে প্রাথমিকভাবে উপলব্ধ রয়েছে। এখানে নথিভুক্ত আছে তীব্র উত্থান, স্বপ্নের রকমফের এবং সম্পর্কিত মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব।

বুলকেলির তিনদিনের জরিপটি জানায়, মার্চে ২৯ শতাংশ আমেরিকান সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন স্মরণ করতে পারার কথা বলেছে। সোলোমোনোভা এবং রবিলিয়ার্ড দেখেছেন ৩৭ শতাংশ মানুষ মহামারী-সংক্রান্ত স্বপ্ন দেখেছে। অনেকেই ব্যর্থভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করেছে এমন স্বপ্ন দেখার কথা বলে (যেমন গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো) এবং অন্যদের দ্বারা হুমকি পাচ্ছে এমন স্বপ্ন দেখার কথাও বলে।

সাম্প্রতিক সময়ে করা কিছু গবেষণায় স্বপ্নে গুণগত পরিবর্তন আসার কথা উল্লেখ করা হয়। সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় থাকা ব্রাজিলের মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া স্বপ্নের প্রতিবেদন বলছে, সেগুলোতে রাগ, বিষণ্নতা, দূষণ পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে যুক্ত দৃশ্যের আধিক্য ছিল। একইভাবে উদ্বেগে ভরপুর ছিল ৮১০ জন ফিনিশ মানুষের স্বপ্ন, যেখানে ৫৫ শতাংশ সরাসরি যুক্ত ছিল মহামারীর সঙ্গে। ধরনের আবেগের বিস্তৃতি সেসব মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে, যারা দিনের বেলা উদ্বেগের মাঝে থাকে। উহানে কভিড-১৯-এর সময় সেবা দেয়া ১০০ নার্সকে নিয়ে করা জরিপে দেখা গেছে, তাদের ৪৫ শতাংশই দুঃস্বপ্ন দেখছে। উত্থানের পেছনে জৈবিক সামাজিক বিষয়গুলোর প্রভাব বেশ স্পষ্ট বলেই প্রতিভাত হয়। অন্তত তিনটি বিষয় এখানে স্বপ্নের আধিক্যকে লক্ষ্য করে চালিত হতে পারে। ঘুমের এলোমেলো সূচি স্বপ্ন দেখায় প্রভাব রাখছে। সংক্রমণ সামাজিক দূরত্ব স্বপ্ন দেখার সক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে, যা আবেগকে আলোড়িত করে। অন্যদিকে সামাজিক মূলধারার মিডিয়া জনসাধারণের মধ্যে মহামারীজনিত প্রতিক্রিয়াকে তীব্র করছে।

অধিক র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম) ঘুম, অধিক স্বপ্ন স্বপ্নের উত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা হচ্ছে লকডাউনের প্রভাবের সঙ্গে আকস্মিকভাবে ঘুমের প্যাটার্নের পরিবর্তন। শুরুর দিকের প্রকাশিত গবেষণা দেখাচ্ছে, চীনের জনগণের মাঝে অনিদ্রার উচ্চহার ছিল। বিশেষ করে সামনের সারিতে থেকে কাজ করা শ্রমিকদের মাঝে এটা দেখা গেছে। বিপরীতে ঘরে থাকার নির্দেশনা কাজে যাতায়াতের সময় বাঁচিয়ে অনেক মানুষের ঘুমের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। চীনের জরিপে দেখা গেছে, গড়ে বিছানায় সময় বেড়েছে ৪৬ মিনিট করে এবং  আরো ৩৪ মিনিট বেড়েছে ঘুমের পূর্ণ সময়ের ক্ষেত্রে। ফিনল্যান্ডের ৫৪ শতাংশ মানুষ বলেছে, লকডাউনের পর তাদের ঘুমের পরিমাণ বেড়েছে। কেবল দুটি উদাহরণই নয়, আরো একাধিক জরিপে ঘুমের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টি দেখা গেছে।

দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমানো চালিত করে অনেক বেশি স্বপ্নের দিকে। বেশি সময় ধরে ঘুমানের কারণে র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম) বাড়তে থাকে, এটা তখনই হয় যখন প্রগাঢ় সংবেদনশীল স্বপ্ন দেখার ঘটনা ঘটে। এছাড়া আরামদায়ক সূচিতে সাধারণত সকালবেলা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখাতে পারে। যখন আরইএম ঘুম অনেক বেশি বিস্তৃত, তীব্র হয়ে থাকে সে সঙ্গে বেশ উদ্ভটও বটে।

কভিড-১৯-এর সময়কালে স্বপ্ন সরাসরি কিংবা রূপকার্থে সংক্রমণ নিয়ে ভয় সামাজিক দূরত্বের যে চ্যালেঞ্জ তার সঙ্গে যুক্ত। এদিকে গবেষকরা সৃজনশীল কর্মে সহায়তা করে এমন অসংখ্য স্বপ্নের ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক গবেষণা আরো দেখায় যে আরইএম ঘুম সমস্যা সমাধানে সহায়তা করার প্রবণতার দিকে চালিত হয়। একইভাবে কভিড-১৯ মোকাবেলার ক্ষেত্রে এমন অদ্ভুত সব স্বপ্নের বিবরণও সামনে এসেছে। একটি জরিপে একজন বলে, আমি এমন একটি ক্রিম খুঁজে বেড়াচ্ছি যা কিনা কভিড-১৯-এর চিকিৎসা কিংবা সংক্রমণ রোধের কাজ করছে এবং একপর্যায়ে শেষমেশ বোতালটি আমার হাতে।

তবে মহামারী নিয়ে আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, স্বপ্নের স্ফীতি মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় কিনা। এটা অনেকটাই সম্ভব যে প্রথম দিকের কয়েকটি স্বপ্ন অনলাইনে বেশ প্রচারিত হয়েছে। যা মানুষকে তাদের স্বপ্ন মনে করার ব্যাপারে এবং তা ভাগাভাগি করার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছে। পাশাপাশি আখ্যান হয়তো মহামারী সম্পর্কে স্বপ্ন দেখতে মানুষকে আরো বেশি উৎসাহিত করেছে।

সায়েন্টিফিক আমেরিকান থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন