টিকাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের বৈশ্বিক পরিণাম

হুমায়ুন কবির

যারা বিশ্বাস করে কভিড-১৯ এর একটি টিকা চলমান মহামারী অবসান বা সর্বোত নিয়ন্ত্রণ করবে, কিংবা যারা যারা আশা করে যে এর প্রভাব মোকাবেলায় নতুন ওষুধ উদ্ভাবিত হবে; তাদের জন্য উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। একটি বৈশ্বিক কৌশল সাজানো এবং তার বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করার পরিবর্তে সম্ভাব্য টিকা উন্নয়ন ও বিতরণ কিংবা অন্য ওষুধসংক্রান্ত চিকিৎসা উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বর্ধিষ্ণুসংখ্যক দেশ ‘আপন জাতিই সবার্গ্রে’ অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করছে।  

এই টিকাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ কেবল নৈতিকভাবে নিন্দনীয় নয়, বৈশ্বিকভাবে সংক্রমণ হ্রাসেরও এটি ভুল উপায়। যদি বিপুলভাবে সংক্রমিত দেশগুলো টিকা ও অন্য ওষুধ পাওয়ায় পিছিয়ে পড়ে, তাহলে রোগটি বৈশ্বিক সরবরাহ নিগড়ের ব্যাহতহরণ অব্যাহত রাখবে। ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিগুলো অবিরতভাবে ভুগতে থাকবে।

অবনতিশীল মহামারীর ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই কভিড-১৯ টিকার বরাদ্দ, বন্টন এবং সরবরাহ যাচাই করার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই বৈশ্বিক পরিচালন সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে হবে। বৈশ্বিক কৌশলকে তথ্যসমৃদ্ধ ও টেকসই করতে এক্ষেত্রে রাজনীতি নয়, প্রয়োজন বিজ্ঞানই।

দুঃখজনকভাবে আমরা দেখছি যে কিছুসংখ্যক দেশ মহামারী মোকাবেলায় সামষ্টিক ও সমতাভিত্তিক বৈশ্বিক কৌশল পাশ কাটিয়ে চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে এক্ষেত্রে আমরা কিছু পদক্ষেপও দেখতে পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যথাক্রমে স্যানোফি ও গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন পিএলসির সঙ্গে প্রয়োজনীয় টিকার ডোজ প্রাপ্তিতে চুক্তিবদ্ধ  হয়েছে। জাপানও নিজ দেশের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের সঙ্গে কভিড-১৯ এর টিকা পেতে চুক্তি করেছে। সম্ভাব্য টিকাগুলো কতটা ভালো করবে, সেটি জানার বেশ আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রয়োজনীয় ডোজ পেতে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছে। লন্ডনভিত্তিক অ্যানালাইটিক্স ফার্ম এয়ারফিনিটির তথ্যে উঠে এসেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপান কভিড-১৮ টিকার প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডোজ নিজেদের জন্য নিশ্চিত করেছে। এমনকি সামনে হতে যাওয়া চুক্তিগুলোর মাধ্যমে মোট ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডোজ ধনী দেশগুলোর জন্য কুক্ষিগত হবে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে মিলছে।

আমরা আগেও এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আচরণ ও এর আশঙ্কাজনক প্রভাব দেখেছি। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারীতে বিশ্বব্যাপী ২ লাখ ৮৪ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ওই মহামারী রুখতে সাত মাসের মধ্যে এক একটি টিকা উদ্ভাবিত হয়েছিল বটে, তবে সবচেয়ে উচ্চ আয়ের দেশগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নিজেদের নাগরিকের বাইরে বাকি বিশ্বের জন্য টিকা উৎপাদনের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। উচ্চ আয়ের দেশগুলো সরাসরিভাবে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে টিকার বিপুল অগ্রিম ক্রয়াদেশের চুক্তি করেছিল। ফলে দরিদ্র দেশগুলো টিকাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ উল্লিখিত ধনী দেশগুলোর সাতটি নিম্ম ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় টিকা ডোনেশনে সম্মত হয়েছিল, কিন্তু সেটিও করেছিল প্রথমে তাদের নিজস্ব নাগরিকের টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পর। বলা চলে, এইচ১এন১ (সোয়াইন ফ্লুর টিকা) টিকার বন্টন হয়েছিল সংক্রমণের ঝুঁকি নয়; বরং উচ্চ আয়ের দেশগুলোর ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে।

বর্তমানে কভিড-১৯ এর সম্ভাব্য টিকাকে কেন্দ্র করে আন্তঃদেশগুলোর মধ্যে এবং বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে ন্যাক্কারজনক রাজনীতি চলছে। এ রোগ মোটেই রাজনীতির বিষয় নয়, গভীরতর স্বাস্থ্যগত ইস্যুই বটে। এ কয় মাসে চলমান মহামারী বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যব্যবস্থার নাজুকতা অত্যন্ত ব্যাপকতরভাবে উন্মোচিত হয়েছে। কাজেই পুরো বিশ্বের নাজুক জনগোষ্ঠীর জন্য কভিড-১৯ সৃষ্ট ঝুঁকি এবং এই নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ হ্রাসে বিজ্ঞানভিত্তিক কৌশল সাজানো ও এর বাস্তবায়নের নেতৃত্ব নেয়া উচিত রাজনীতিবিদ নয়; রোগতত্ত্ববিদ্যা, ভাইরাসবিদ্যা এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞদেরই। পুঁজি, তথ্য ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম-ওষুধের সরবরাহ জোগানো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যেকোন অকার্যকর জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপ-সাড়া এড়াতে আমাদের একটি কেন্দ্রীয়, আস্থাশীল বৈশ্বিক পরিচালন ব্যবস্থা প্রয়োজন। সাধুবাদ প্রাপ্য যে, বিশ্ববাসীর সামনে এ ধরনের কিছু নজির রয়েছে। 

একটি অভিনব অর্থায়ন প্রক্রিয়ার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। সেটি হলো, অ্যাডভান্সড মার্কেট কমিটমেন্ট (এএমসি) মডেল। এই মডেলে দাতারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সম্ভাবনাময় টিকার ক্রয়দামে ভর্তুকি প্রদানের অঙ্গীকার করে এবং সেটি তারা করে উন্নয়নশীল বাজারগুলোয় একটি টিকা আনতে যা বিনিয়োগ প্রয়োজন তাতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় আর্থিক প্রণোদনা জোগানোর মাধ্যমে। ২০০৭ সালে পাঁচটি দেশ এবং গেটস ফাউন্ডেশন প্রথম এএমসি প্রবর্তন করতে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল, যা নিম্ম ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় নিউমোকক্কাল টিকা উন্নয়ন ও সরবরাহে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল। টিকা উন্নয়নের জন্য তহবিল সংগ্রহে সফল হওয়া আরেকটি অভিনবমূলক অর্থায়ন প্রক্রিয়া হলো ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স ফ্যাসিলিটি ফর ইমিউনাইজেশন, যেটি নতুন বন্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ নিশ্চিত করে থাকে।

অর্থায়নের বাইরে বিদ্যমান বৈশ্বিক টিকাদানকারী জনশক্তির হিসাব-নিকাশ, গণ টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা, প্রাধিকারভিত্তিতে টিকার সমতামূলক ও ন্যায্য বরাদ্দ-বন্টন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং টিকার সরবরাহ যাচাইয়ের জন্য একটি সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টাও জরুরি। লভ্য টিকা প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন দেশে নিজস্ব সক্ষমতা-উপযোগী কৌশল নেয়া যেতে পারে, যখন বিশ্বে সীমিত পরিমাণে টিকা প্রথমে সহজলভ্য হবে।

এদিকে ভাইরাসের ব্যাপকতা, সব সংক্রমিত লোক শনাক্তের মাত্রা, সংক্রমিত লোকের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এসব কৌশল বিন্যাস করা হলে তার বাস্তবায়ন অনেকটাই ফলপ্রসূ হবে বলে আশা করা যায়। পোলি ও গুটিবসন্তের টিকা প্রচেষ্টার আগের অভিজ্ঞতা থেকে বরাদ্দ ও বন্টনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা জনস্বাস্থ্য নেতারা আত্মস্ত ও একীভূত করতে পারে।

তবে এসব কিছু করতে হলে বৈশ্বিক পরিচালন সংস্থাগুলোকে আমাদের অবশ্যই সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে  বে এবং জাতীয় টিকা কর্মসূচি পরিচালনায় নিজ নিজ স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা নিতে হবে। এই বৈশ্বিক পরিচালন সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে ডব্লিউএইচও, গ্লোবাল ফান্ড, সিইপিআই, গাভি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেশভিত্তিক সহযোগী, আঞ্চলিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি খাত। মহামারী অবসানে কেন প্রমাণভিত্তিক অ্যাপ্রোচ গুরুত্বপূর্ণ, নিজেদের জনগোষ্ঠীর কাছে সেটি ব্যাখ্যা করার সরকারগুলোর যোগাযোগ প্রচেষ্টাগুলো এগিয়ে নিতে এসব সংস্থাকে দরকার হবে। সেদিক থেকে উল্লিখিত সংস্থাগুলোকে পাশ কাটিয়ে নয়, তাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে দেশগুলোকে কাজ করে যেতে হবে। 

একটি কভিড-১৯ টিকা কার্যকরভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে বন্টনের জন্য আমাদের সংগঠন-সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং টুলস সবই রয়েছে। সব দেশেরই স্মরণে রাখতে হবে যে একে অন্যে নয়, ভাইরাসই এখন তাদের প্রধান শত্রু। মহামারীর ক্ষেত্রে একটি জাতীয়তাবাদী অবস্থান গ্রহণ এই বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকট আরো প্রলম্বিত করবে। কী-ই আসলে সংক্রমণ থামাবে এবং সবচেয়ে নাজুক গোষ্ঠীগুলোকে সুরক্ষা দেবে (কোন দেশে তারা বাস করে সেটি বিবেচ্য নয়) সেই সম্পর্কে সর্বোত্তম প্রমাণের ভিত্তিতে টিকা বন্টন হওয়া উচিত। একটি টিকা তখনই মহামারীর অবসান ঘটাতে সহায়ক হবে; কেবল যখন সময়মতো, সমতার ভিত্তিতে এর বৈশ্বিক লভ্যতা সব দেশের জন্য নিশ্চিত হবে। তাই উচ্চ দাম হাঁকা দেশগুলোর কাছে বিক্রি নয়; নিরাপদ প্রমাণিত হওয়া টিকার ন্যায্য বন্টনই যে কভিড-১৯ মহামারী অবসানের সবচেয়ে জুতসই পথ তা ভুললে চলবে না।  

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন