বছরের প্রথম ছয় মাস

করোনায় চীনের সঙ্গে বাণিজ্য কমেছে এক-চতুর্থাংশ

বদরুল আলম

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে তথ্য উঠে এসেছে। দুই দেশের বাণিজ্যে ভাটা পড়ার পেছনে মূলত বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-কেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চীনের উহানে করোনা সংক্রমণ শুরু হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। দ্রুত সংক্রমিত হয়ে এক পর্যায়ে তা রূপ নেয় বৈশ্বিক মহামারীতে। বৈশ্বিক বাণিজ্যে মহামারীর কারণে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তাতে কমবেশি সব দেশই প্রভাবিত হয়েছে। মহামারীর উত্পত্তিস্থল চীন বাংলাদেশের বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার হওয়ায় দুই দেশের বাণিজ্যে প্রভাব আরো বেশি দৃশ্যমান বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে চীন বাংলাদেশের মধ্যকার আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭১১ কোটি ২৫ লাখ ডলার। অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে তা নেমে এসেছে ৫২৮ কোটি ৬৬ লাখ ডলারে। সে হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮২ কোটি ৫৯ লাখ ডলার বা ২৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় হাজার ২০০ কোটি ডলার। তবে সময়ে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ একেবারেই যৎসামান্য। মোট দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে চীন থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির অংশ ৯৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে মোট আমদানীকৃত পণ্যের প্রায় ২৫ শতাংশই আসে চীন থেকে।

দুই দেশের বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই দেশের পণ্য আমদানি-রফতানিতে এখন যে নিম্নমুখিতা দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ কভিড-১৯। এছাড়া বছরের শুরুর দিকে চীনে সরকারি ছুটি দীর্ঘায়িত হওয়ারও একটি প্রভাব পড়েছে এখানে। ছুটির কারণে ফেব্রুয়ারির পুরোটাই কার্যত বন্ধ ছিল গোটা চীন। আবার ছুটিকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ভাটা পড়া শুরু হয় ডিসেম্বরে। এর মধ্যে আবার যোগ হয়েছে মহামারী। দুইয়ের প্রভাবেই বছরের প্রথমার্ধে দুই দেশের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মকে নেমেছে।

দুই দেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়ার কারণে চলমান মহামারী পরিস্থিতির শুরুতেই কাঁচামালের সরবরাহ সংকটে পড়ে দেশের তৈরি পোশাক খাত। কারণ দেশের তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্য তৈরির আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় আমদানি হয় চীন থেকে। অন্যদিকে নিটওয়্যার পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আসে আনুমানিক ১৫-২০ শতাংশ। মহামারীর কারণে বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় বছরের শুরুর দিকে চীন থেকে কাঁচামাল আসতে পারছিল না বাংলাদেশে।

অন্যদিকে বছরের শেষার্ধেও চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তাদের ভাষ্যমতে, দুই দেশের বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ ব্যবসা করছেন ক্ষুদ্র মাঝারি খাতে। ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারের প্রণোদনা ছাড় হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। তার মধ্যেও আবার অনুমোদন হয়েছে ২৩ শতাংশের মতো। পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

বিষয়ে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মোহাম্মদ ইসহাকুল হোসেন সুইট বণিক বার্তাকে বলেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। কারণ বড়রা প্রণোদনার অর্থ পেলেও ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীরা পাননি। আমাদের জানামতে প্রতি মাসে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট ঋণপত্র হয় ৪০০-৫০০টি করে। এখন তা ২০০-২৫০-এর বেশি হচ্ছেই না।

বাংলাদেশ চীনে রফতানির চেয়ে দেশটি থেকে পণ্য আমদানিই করে বেশি। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে চীন থেকে আমদানি হয়েছে ৬৮১ কোটি ডলারের পণ্য। যেখানে চলতি বছরের প্রথমার্ধে দেশটি থেকে ৫০৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। হিসেবে আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ৫৮। অন্যদিকে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চীনে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিও কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে হিমায়িত খাদ্য, কৃষিপণ্য, চা, রাসায়নিক, চামড়া, কাঁচা পাট পাটজাত পণ্য এবং নিট ওভেন পণ্য। অন্যদিকে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানীকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে তুলা, সুতা, যানবাহন, সবজি, প্লাস্টিক, লবণ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, দুগ্ধজাত পণ্য, ফল, কাগজ, রাসায়নিক ইত্যাদি।

এদিকে গত জুলাই থেকে বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ বা হাজার ২৫৬টি পণ্য রফতানিতে শুল্ক কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দিচ্ছে চীন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করছে, চীন ১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটি বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে দেশটির জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। চীনের বাজারে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্ক কোটামুক্ত (ডিএফকিউএফ) প্রবেশাধিকার সুবিধা পেলে তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় সব পণ্য চীনে শুল্ক কোটামুক্তভাবে প্রবেশের সুবিধা পাবে।

শুল্ক সুবিধা কাজে লাগিয়ে চীনে রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের। তারা বলছেন, এটি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি করোনার প্রভাব কাটাতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে দ্রুতই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের নেতিবাচক ধারা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে বলেও প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন