খুলনার দাকোপে জি-গ্যাস প্ল্যান্ট

প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্প-কারখানা বহু মানুষের কর্মসংস্থান

আবু তাহের খুলনা থেকে ফিরে

খুলনা সদর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে দাকোপ উপজেলার চুনকুড়ি। রূপসা ঝপঝপিয়া নদীর মোহনার সেই জায়গাটিতে এলপিজি প্লান্ট স্থাপন করেছে জি-গ্যাস, যার মধ্য দিয়ে শিল্পের পত্তন ঘটেছে প্রত্যন্ত ওই গ্রামে। এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় বহু মানুষের কর্মসংস্থান যেমন হয়েছে, তেমনি সেখানে সহজলভ্য হয়েছে এলপি গ্যাস।

জি-গ্যাসের প্ল্যান্টের ডিস্ট্রিবিউশন সেকশনে কাজ করেন দাকোপ উপজেলার আনন্দনগর গ্রামের আনিসুর রহমান। শিক্ষিত যুবক চাকরির জন্য একসময় ঢাকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করতে না পারায় গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে ফিরে বেকার অবস্থায় জীবনযাপন করছিলেন। ২০১৭ সালে জি-গ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করলে সেখানে কর্মী হিসেবে যোগ দেন। তার ভাষ্য, জি-গ্যাসের কারখানা হওয়াতে আমার মতো বহু শিক্ষিত যুবকের প্ল্যান্টে কর্মসংস্থান হয়েছে। এখানে বিভিন্ন সেকশনে অন্তত ২৫০ কর্মী কাজ করছেন। শতকরা ৯৫ ভাগ কর্মী দাকোপ বটিয়াঘাটা উপজেলার। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধরনের একটি কারখানায় স্থানীয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে এটা ভাবতেই পারতাম না আমরা।

জি-গ্যাস যখন কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছিল, তখন দাকোপে কোনো শিল্প-কারখানা ছিল না। বটিয়াঘাটা-দাকোপ অঞ্চলের মানুষ আগে নদীতে মাছ ধরত, ক্ষেতে কাজ করত। শিল্প স্থাপন হওয়ায় এখন অনেক মানুষ কারখানায়, পরিবহনে এমনকি কারখানার পণ্য পরিবহনের নৌযানেও কাজের সুযোগ পাচ্ছে।

সরেজমিন কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বর্তমানে ২৫০-এর বেশি মানুষ কাজ করছে। যাদের বেশির ভাগই দাকোপ অঞ্চলের শিক্ষিত বেকার কিংবা অশিক্ষিত যুবক। যথাযথ প্রশিক্ষণ আর নিরাপত্তা বিধান মেনে তারা কারখানায় কাজ করছে। কারখানার নিরাপত্তা, সিলিন্ডার তৈরি, বটলিং স্থাপনা, পরিবহন, ফেরি, এমনকি লঞ্চে কাজ করছেন কর্মীরা।

জি-গ্যাসে প্লান্ট স্থাপনের পর খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ-বটিয়াঘাটার বেশির ভাগ মানুষই এখন এলপি গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে জি-গ্যাস প্লান্ট স্থাপনের পর। ওই অঞ্চলের মানুষেরা এখন কাঠের পরিবর্তে এলপি গ্যাস ব্যবহারকে সুবিধাজনক সাশ্রয়ী মনে করছেন। দাকোপে দেড় লাখ মানুষের দুই-তৃতীয়াংশ এখন এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে।

খুলনার দাকোপ লঞ্চঘাট এলাকার চা দোকানি এনায়েত আলী জানান, এক সময় তিনি চায়ের পানি গরম করতেন শুকনো কাঠ আর লতাপাতা পুড়িয়ে। গত দুই বছর ধরে কাজে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছেন তিনি। এলপিজি ব্যবহারের তার খরচ এবং ভোগান্তি দুটোই কমেছে।

নদীর মোহনায় ২৩ একর জমির ওপর নির্মিত জি-গ্যাসের প্ল্যান্টে ইংল্যান্ড, তুর্কি ফ্রান্সের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্ল্যান্টে সিলিন্ডার উৎপাদন এলপিজি বোতলজাত করা হচ্ছে।

জি-গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার আবু সাঈদ রাজা বলেন, ২০১৭ সালে জি-গ্যাস যখন প্ল্যান্ট নির্মাণ শুরু করেছিল, তখন এখানে কোনো শিল্প স্থাপনা ছিল না। এনার্জিপ্যাক প্রথম সুন্দরবন অঞ্চলের রেড জোনের বাইরে গিয়ে এলপিজির প্ল্যান্ট নির্মাণ করে। জি-গ্যাস স্থাপনার ফলে অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের বড় একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

মোংলার বাইরে নদীর মোহনায় এমন একটি স্থাপনা গড়ে তোলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন জায়গায় এলপিজি স্থাপনা তৈরি করে আমরা শিল্পায়নের একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে চেয়েছি। যাতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হয়, অর্থনীতিতে তারাও যেন অংশগ্রহণ করতে পারে।

জি-গ্যাসের স্থাপনায় মূলত দুই ধরনের প্ল্যান্ট রয়েছে। তার একটি বটলিং প্ল্যান্ট, অন্যটি সিলিন্ডার ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট। বটলিং প্ল্যান্টে মূলত এলপিজি বোতলজাত করা হয়। গ্রাহকের ব্যবহূত খালি সিলিন্ডারের পাশাপাশি নতুন সিলিন্ডারেও এলপিজি বোতলজাত করা হয়। প্রতিদিন প্ল্যান্ট থেকে অন্তত ২৫ হাজার সিলিন্ডারে এলপিজি ভর্তি করা হয়।

অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টে সিলিন্ডার তৈরি করা হয়। সিলিন্ডারের কাঁচামাল থেকে বোতল প্রস্তুত থেকে শুরু করে সিলিন্ডার নিরাপত্তা বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় এখান থেকে। সিলিন্ডার তৈরিতে অন্তত শতাধিক যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে জি-গ্যাসে। বর্তমানে প্রতিদিন অন্তত ১৫ থেকে হাজারের মতো নতুন সিলিন্ডার তৈরি হচ্ছে। জি-গ্যাস প্লান্টের কারখানায় ১২-৩৫-৪৫ কেজি সিলিন্ডার তৈরি হচ্ছে। এরপর এলপিজি বোতলজাত করে তা নিজস্ব ফেরি দিয়ে বটিয়াঘাটা ল্যান্ডিং স্টেশনে নিয়ে আসা হচ্ছে। সেখান থেকে সিলিন্ডার বোঝাই ট্রাক সারা দেশে ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে।

সারা দেশে ২২টি কোম্পানি এলপিজি উৎপাদনে থাকলেও তার মধ্যে চার-পাঁচটি কোম্পানি সিলিন্ডার তৈরি করে। এর মধ্যে জি-গ্যাস একটি। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি মাসে এক লাখ সিলিন্ডার উৎপাদন করবে বলে জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা দেশের বাইরে সিলিন্ডার রফতানি করবে।

জি-গ্যাস সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে জি-গ্যাসের ১০টা বড় ওয়্যারহাউজ রয়েছে, ৫৫টি ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার এবং ৪২৭টি ডিস্ট্রিবিউটর নেটওয়ার্ক রয়েছে। এসব ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে সিলিন্ডার গ্যাস পৌঁছে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে অটোগ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি ১০০টি ফিলিং স্টেশনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ৩৫টি স্টেশনে অটোগ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানির সঙ্গে অটোগ্যাস স্থাপনে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কোম্পানিটি। সারা দেশে পদ্মার ২০০টি ফিলিং স্টেশনে অটোগ্যাস স্থাপনের মাধ্যমে এলপিজি সরবরাহ বাড়াবে তারা।

২০১৮ সালে এলপিজি উৎপাদন শুরু করার পর পরই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে আরো একটি স্থাপনা তৈরির কাজ শুরু করেছে জি-গ্যাস। সেখানে ১২০০ টন ধারণ ক্ষমতার স্পেরিক্যাল ট্যাংক নির্মাণ করা হচ্ছে। রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে অটোগ্যাস সরবরাহের জন্য ট্যাংক স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া গ্রাহকের দোরগোড়ায় এলপিজি পৌঁছে দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম, সিলেট বগুড়ায় বটলিং প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বর্তমানে সাড়ে তিন লাখ গ্রাহককে জ্বালানি সেবা দিচ্ছে জি-গ্যাস। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব মতে, বর্তমানে তাদের মার্কেট শেয়ার রয়েছে শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন