স্মৃতিচারণ

চাকরিচ্যুতি না অবসর: ঘটনা পরম্পরা ও ব্যাখ্যা

ড. মসিউর রহমান

বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করার স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছিলাম যে ২০০১ সালে (অক্টোবর) চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি (বণিক বার্তা, ১৫ আগস্ট, ২০২০) আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা চাকরিচ্যুত শব্দটি পছন্দ করেননি; মনে হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমি চাকরি হারাই। অবসরপ্রাপ্তি সম্মানজনক যথোচিত হতো। চাকরিচ্যুত অথবা অবসর বিকল্প শব্দ ব্যবহার নিয়ে আমি ভেবেছি। ঘটনা পরম্পরা বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে চাকরিচ্যুত অথবা অকাল চুক্তি বাতিল প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে, অবসর সম্মানজনক আচ্ছাদন হতে পারে। চুক্তি দুই-আড়াই মাস পরে স্বাভাবিকভাবে শেষ হতো।

. ১৯৯৮ সালের শেষে আমি বিধি অনুসারে অবসরে যাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চুক্তিতে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করেন, মেয়াদ তিন বছর। মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রস্তাব স্বাক্ষর করেন, যা তার অনুমোদন জ্ঞাপন করে। সঙ্গে নিম্নোক্ত মর্মে মন্তব্য যোগ করেন: একবারে তিন বৎসর! মহামান্য রাষ্ট্রপতির তির্যকের অর্থ অস্পষ্ট, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আদেশ জারি হয়। বাকি এক বছর তির্যকের হেঁয়ালিতে বন্দি হয়ে পড়ে!

. মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন তির্যকের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দুরূহ। রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ উপেক্ষা বা পরিবর্তন করার সুযোগ সীমিত। সম্ভবত তিনি অসন্তুষ্টির সঙ্গে অনুমোদন করেন। দুই বছর চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার রাষ্ট্রপতির অনুমোদন দরকার কিনা, ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। বিষয়টি দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথম, মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ পরিবর্তন করেছেন মর্মে ব্যাখ্যা করলে আবার অনুমোদন দরকার। দ্বিতীয়, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ মেনে নিয়েছেনএই মর্মে ব্যাখ্যা করলে আবার অনুমোদন নিষ্প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির কাছে তির্যকের মানে জানতে চাওয়া বিব্রতকর। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেননি; প্রধানমন্ত্রীও তার মন্তব্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে চুক্তির মেয়াদ দুই ভাগে ভাগ করেছেন। দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন স্পষ্ট নয়। প্রথম ব্যাখ্যা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনুমোদনজ্ঞাপক স্বাক্ষরকে মর্যাদা দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তির্যকের হেঁয়ালি থেকে চুক্তির মেয়াদ মুক্ত করেন।

. সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি দুটি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতে পারেন: প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের আচার রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত করেছে। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন; একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে যে দলের সদস্য সংখ্যা বেশি অথবা যেসব দল মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে পারে, তাদের নির্বাচিত নেতা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। প্রয়াত মাহমুদুল ইসলাম (সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল) বাংলাদেশের সংবিধানের ব্যাখ্যায় মত প্রকাশ করেছেন যে রাষ্ট্রপ্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তি ব্যতিক্রম করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়। সরকারের তথ্যভাণ্ডার ব্যাপক (কনস্টিটিউশনাল অব বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, ২০১২)

. বিচারপতি লতিফুর রহমানের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে কিছু বিতর্কিত ঘটনা জড়িত। শপথের পর চা-চক্র শেষ হওয়ার আগেই আমাদের একজন কনিষ্ঠ সহকর্মী . সৈয়দ আব্দুস সামাদকে জানান যে, . সামাদ প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় অন্য কোনো পদে নিযুক্ত হবেন, বার্তাবাহককে প্রধান উপদেষ্টা মুখ্য সচিব পদের জন্য নির্বাচিত করেছেন। . সামাদ তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব; সে আদেশ পরিবর্তন বা নাকচ হয়নি। . সামাদ অপমানিত বোধ করেন।  

. আমাদের মনে হয় প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত অসমীচীন, বিধিসংগত নয়। প্রধান উপদেষ্টা তখন নিজ অফিসে বসা শুরু করেননি, তাকে পাওয়া যাবে না। তাই আমরা সম্পর্কে মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা প্রয়োজন মনে করি। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব অতি অল্প সময়ের মধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব সৈয়দ আব্দুস সামাদ, প্রেস সচিব জাওয়াদুল করিম, সড়ক সচিব রেজাউল হায়াত আমি মাননীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করি। আরো একজন সহকর্মী আমাদের সঙ্গে ছিলেন; রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের আগের মুহূর্তে চাকরিতে অসুবিধা হতে পারে বিবেচনায় তিনি আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করেন।

. মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার ত্বরিত কার্যক্রমে বিস্মিত হন। শপথ নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি রহমান কর্মকর্তা পদে রদবদলের সিদ্ধান্ত নেবেন, তিনি আশা করেননি। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরে জরুরি বিষয় সম্পৃক্ত নথি হয়তো আসবে, তিনি এমন উক্তি করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্মকর্তা পদে রদবদলের আদেশ কয়েক দিন স্থগিত রেখেছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের নিয়োগ সম্পন্ন হলে কার্যকর হয়।

. জাওয়াদুল করিম রাষ্ট্রপতিকে জানান যে তিনি চুক্তি নাকচ করে সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে যাবেন। . সামাদ ছুটিতে যাবেন। সরকার তাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করলে আগাম অবসর নিতে প্রস্তুত আছেন। রেজাউল হায়াত মুখ্য সচিব পদের জন্য আমার নাম সুপারিশ করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে আমি জানাই যে আমি চুক্তিতে নিযুক্ত আছি, কোনো উচ্চপদে নিয়োগ সমীচীন হবে না। রেজাউল হায়াত সর্বোজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা; তাকে উচ্চতর পদে নিয়োগ বিধিসংগত হবে, আপত্তি করার গ্রহণযোগ্য ভিত্তি থাকবে না। জাওয়াদুল করিম তার প্রতিশ্রুতি অনুসারে কাজ করেন; . সামাদ দীর্ঘ ছুটি নেন। আমি আমার পদে নিযুক্ত থাকি। তখন বা পরে প্রয়াত হায়াত একই মর্যাদাসম্পন্ন পদে নিযুক্ত থাকেন।

. আমরা যখন মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করি, সে মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টা তার নির্বাচিত সচিব অন্য দু-একজন কর্মকর্তা নিয়ে বঙ্গভবনে সভা করছিলেন। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের অজানা থাকার কথা নয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি অবগত ছিলেন কিনা স্পষ্ট নয়। আমরা জানলে হয়তো ওই সভাতেই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতাম, তার অনুমতিসাপেক্ষে। . সামাদ এবং আমি জাওয়াদুল করিমের সঙ্গে তার আস্তানায় যাই।   

১০. প্রধান উপদেষ্টার যেসব কর্মকর্তার পদ পরিবর্তন করেছেন, স্বাক্ষরবিহীন সাদা কাগজে সে নির্দেশাবলি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয় এবং প্রচারে বাধ্য করা হয়। সাংবাদিকরা জাওয়াদুল করিম আমাদের কাছে বিষয়ে টেলিফোনে জানতে চান। পরের দিন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়, সূত্র হিসেবে আমাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময় প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে আমার বক্তব্য প্রত্যাহারের জন্য তাগিদ দেয়া হয়, আমি সম্মত হইনি। অবাধ্যতার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারত, কিন্তু নেয়নি। শৃঙ্খলা বিধির আনুষ্ঠানিকতা পালনে অসুবিধা ছিল। শপথ গ্রহণের আগে তিনি কীভাবে কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করলেন এবং বাছাই করলেনএসব বিব্রতকর প্রশ্ন উঠে আসত।

১১. সংবাদমাধ্যমে প্রচারের অনেক পরেপ্রায় মধ্যরাতেনিয়মমাফিক পত্র সংখ্যা, তারিখ ইত্যাদি সংবলিত আদেশ বের হয়। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (ভারপ্রাপ্ত) এসব প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। তার কাছে জানতে পারি যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সংস্থাপনের একজন যুগ্ম সচিবের মাধ্যমে পদের রদবদল প্রক্রিয়া সাধন করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আগেই তাকে অফিসে থাকার আদেশ দিয়েছিলেন, কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন যে কয়েকটি জরুরি আদেশ সে রাতেই জারি করতে হবে। শপথ অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব জনপ্রশাসন সচিবের তুলনায় অনেক বেশি। প্রধান উপদেষ্টা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ব্যতিক্রমী আচরণে বিব্রতচিত্ত অতিরিক্ত সংস্থাপন সচিব (ভারপ্রাপ্ত) আমাদের সঙ্গে পরে যোগ দেন।

১২. বিচারপতি লতিফুর রহমান তার প্রধান উপদেষ্টাকালীন কার্যাবলি বিবৃত করে বই লিখেছেন। তাতে উল্লেখ করেছেন, আমার প্রতিবাদী আচরণের কারণ আমার চুক্তি নিয়োগে অনিয়ম। তার ধারণার ভিত্তি দুর্বল-যুক্তিহীন। চুক্তিতে অনিয়ম থাকলে আমার ভয়ভীতির মাত্রা বেশি হতে পারে। বিকল্পে তিনি মনে করেছেন যে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে সন্দেহ আচ্ছাদিত ঘটনা আরো প্রকাশিত হবে, সংবাদমাধ্যমে জল্পনা-কল্পনা চলবে। তিনি হয়তো মনে করেন যে রাষ্ট্রপতি প্রশাসনিক বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ বা পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত সংবিধানের সঙ্গে তার ব্যাখ্যা সাজুয্যপূর্ণ, ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির সঙ্গে নয়। 

১৩. প্রসঙ্গে একজন উপদেষ্টা আমাকে পরে জানান যে মুখ্য সচিব পদে নিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অতএব, আমার তো কোনো নালিশ থাকতে পারে না। আমি তাকে জানাই যে আমার বা আমাদের বক্তব্যের উদ্দেশ্য কোনো পদ পাওয়া বা হারানো নয়, প্রধান উপদেষ্টার ব্যতিক্রমধর্মী আচরণ। সরকারপ্রধান কর্মকর্তাদের দক্ষতা দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে বিভিন্ন পদে নিয়োগ ক্ষমতার অধিকারী। সরকারের দায়িত্ব নেয়ার আগেই কর্মকর্তা পছন্দ করার জন্য তিনি দু-একজন চেনা লোকের কথা বা কানকথা শুনেছেন। পরামর্শ দেয়া নেয়া প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, দায়বদ্ধতা অনুপস্থিত। দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়ার সুযোগ তার ছিল।       

১৪. আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আগে আলোচনা করে স্থির করেছিলেন যে কমিশনের তথ্যপ্রযুক্তি কামরায় সব দলের দু-একজন প্রতিনিধি থাকবেন; এলাকাভিত্তিক ফল প্রকাশের আগে তারা প্রাপ্ত তথ্য নিরীক্ষণ করবেন। তাদের সন্দেহ ছিল, ফলাফল ঘোষণায় কারচুপি হতে পারে। কমিশন সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। নির্বাচন কমিশনের সচিব অন্যান্য পদেও পরিবর্তন করা হয়েছিল। ফলাফল ঘোষণার সত্যতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। 

১৫. বিচারপতি লতিফুর রহমানের অন্তর্বর্তী শাসনকালে আমি সহকর্মীদের কাছ থেকে অনেক সময় বেদনাদায়ক কথা শুনেছি। আমার কনিষ্ঠ সহকর্মীরাও কার্পণ্য করেননি। উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল একটি বিদেশী সহায়তা প্রস্তাব বিবেচনা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব হিসেবে আমার মত ছিল সহায়তা নেয়ার পক্ষে। সহায়তার সঙ্গে কিছু শর্ত যুক্ত ছিল, অনুরূপ শর্তযুক্ত সহায়তা আগেও নেয়া হয়েছে; এমন কিছু প্রকল্প তখন বাস্তবায়নাধীন। উপস্থিত সচিবরা নীরব অথবা সহায়তা নেয়ার বিরুদ্ধে সরব। তারা উক্তি করেন, তাদের দরকার নেই, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব একাই সব করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার আনুগত্যের ইঙ্গিত।

১৬. আমি জানাই, সরকার আমার মতামত উপেক্ষা করতে পারে; সহায়তা প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নিলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আলোচনা থামিয়ে দেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক নতুন শর্ত না নেয়ার পক্ষে তিনি মত দেন। তবে আগে গৃহীত শর্তের ব্যতিক্রম না হলে প্রয়োজনের নিরিখে সহায়তা গ্রহণ যুক্তিসংগত হবে। আমার সহকর্মীদের অনেকের আচরণে মনে হচ্ছিল, তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের বিজয়ের প্রতীক।

১৭. পরিকল্পনা কমিশনের একজন যুগ্ম প্রধান (নারী) আমার স্ত্রীকে জানান যে আমার সরকারি বাসাটি একজন ক্ষমতাধর কর্মকর্তাকে বরাদ্দ করা হয়েছে। (নারী কর্মকর্তা কলেজে আমার স্ত্রীর ছাত্রী ছিলেন; কয়েক বছর আগে ক্যান্সার রোগে মারা যান) ওই কর্মকর্তা পুলিশের সাহায্যে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চাকরি শেষে কয়েক মাস সরকারি বাসায় থাকা যায়; কর্মকর্তার প্রয়োজন বিবেচনা করে সরকার সময় বাড়াতে পারে। নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য সময়ের আগেই আমি বাসা ছেড়ে দিই। পিডব্লিউডি কর্মকর্তা আমার বসবাসকালে কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে পরীক্ষা করেন; হিসাব করে জানান, বাসায় বৈদ্যুতিক পাখা কয়েকটি কম। আমি বাসা নেয়ার সময় কয়টি পাখা ছিল জানতে চাইলে উত্তর দেন তাদের কাছে সে হিসাব নেই। আমি পাখার দাম দিয়ে দিই।

১৮. প্রতিকূল অবস্থায় একদিন প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে ডাক আসে। প্রমাদ গুণে আমি তার অফিসে হাজির হলাম। আলোচনার বিষয় আমার প্রমাদ দূর করে। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদের জন্য একজন সচিবকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার মনোনয়ন নাকচ করতে চায়। আমার কাছে জানতে চাইল, পন্থা কী হতে পারে? বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের নিয়োগকর্তা নির্বাহী পরিচালক। বাংলাদেশ ভারত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একই কনস্টিউয়েন্সি; ভারত সরকার নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ করে। আমি মতামত জানালাম। নির্বাচিত সরকারের মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান বিভিন্ন প্রশ্নের সৃষ্টি করবে; নির্বাহী পরিচালক তখনো আদেশ জারি করেননি। মনোনীত কর্মকর্তাকে সরকার অব্যাহতি না দিলে মনোনীত ব্যক্তি তার নতুন পদে যোগ দিতে পারবেন না। পর্যায়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া নিষ্প্রয়োজন-অসমীচীন। 

১৯. এরপর আসে আমার বিস্ময় বিব্রতবোধের পালা। আমাকে মনোনয়ন দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে আমার মতামত জানতে চাওয়া হয়। আমি ব্যাখ্যা করি যে ওই পদে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওপর ন্যস্ত, আগের নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আমাকে মনোনয়ন দেয়া অনুচিত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের পদের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ ছিল না। আলোচনার এখানেই সমাপ্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত মনোনয়ন অপরিবর্তিত থাকে। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে তার একান্ত সচিব আলোচনা করেছিলেন।

২০. অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশনের সচিব পদে রদবদল করেছিল। ওই সচিব এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে মনোনয়নের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন; নির্বাচন-উত্তর সরকার তার বাসনা পূরণ করে। স্বাভাবিক অবস্থায় তার যোগ্যতা বা কর্ম অভিজ্ঞতা নিয়ে হয়তো দ্বিমত থাকতে পারে; নির্বাচন কমিশনের সচিব হিসেবে তার আচরণের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু সমকালীন পরিস্থিতিতে ধারণা করা হয় যে বিজয়ী দলের কাছে তিনি পুরস্কার দাবি করেছেন, দল দাবি পূরণ করেছে।

২১. ২০০১ সালের জন্য বাংলাদেশ ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিল। আলজেরিয়ায় বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান লন্ডন পর্যন্ত যান; তারপর ব্যক্তিগত কারণে সভায় যেতে পারেননি। তিনি আমাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব দেন। ব্যাংকের সব বিজনেস সেশনে আমি সভাপতিত্ব করি।

২২. বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অভিজ্ঞতা আমার প্রথম নয়। কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সভা, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এবং বেসরকারি খাত উন্নয়নের জন্য ইসলামিক ফিন্যান্স করপোরেশনে প্রতিনিধিত্ব করেছি (ফিন্যান্স করপোরেশনে কনস্টিটিউয়েন্সি কর্তৃক নির্বাচিত পরিচালক ছিলাম; সরকারের বিরূপ মনোভাব বুঝে ২০০১ সালের পর ওই পদে ইস্তফা দিই) ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) পরিচালকের দায়িত্ব পালনের সময় ওই প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম (তখন অসবির যুগ্ম সচিব পদে নিযুক্ত) সচিব ইফাদের পরিচালক পদ থেকে আমাকে অপসারণ করেন, আমার স্থানে যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়, ইফাদ পর্ষদ তাকে মূল্যায়ন কমিটির প্রধান পদে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন, পর্ষদ তাকে সম্মান দেয় (সুইজারল্যান্ডের পরিচালক)   

২৩. আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আজিজ বুতেফ্লেকা প্রতিনিধিদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেন। আমার পরিচয় জানার পর তার স্বর্তস্ফূত উক্তি: ওহ্, শেখ মুজিব! তোমরা তাকে হত্যা করেছ। আমি তোমাদের দেশে গেছি। লাহোরে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজের (ওআইসি) সভায় বঙ্গবন্ধুকে নেয়ার জন্য মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের প্রতিনিধি হিসেবে বুতেফ্লেকা ঢাকায় এসেছিলেন। আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ দেশের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যোগ দিয়েছিলেন। বুতেফ্লেকা তখন ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বুতেফ্লেকা আমার সঙ্গে প্রায় মিনিট বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আলাপ করেন। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যে সম্মান পেয়েছেন, সাইফুর রহমানকে জানাই।

২৪. আমার চুক্তি বাতিল সম্পর্কে সাইফুর রহমান আগে জানতেন না। তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার সৌজন্যের জন্য ধন্যবাদ জানাই, পুনর্বিবেচনা না করার জন্য অনুরোধ করি। নির্বাচিত রাজনৈতিক নির্বাহী স্থায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে আস্থা না থাকলে সরকার পরিচালনা দুষ্কর হয়। আস্থার ভিত্তি কর্মকর্তার দক্ষতা, নীতিবোধ নিষ্ঠা। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পদোন্নতি প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে। ফ্রান্সিস ফুকুয়্যামার মতে, রাজনৈতিক শৃঙ্খলা নীতিবোধ অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ প্যাট্রিমনিয়ালিজম (পলিটিক্যাল অর্ডার অ্যান্ড পলিটিক্যাল ডিকে, ২০১৪)   

২৫. প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের বিতর্কিত আচরণ অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন সৃষ্টি করে। দায়বদ্ধতাহীন অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনমনে গ্রহণযোগ্যতা বৈধতা হারায়। পরবর্তী নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানে নির্ধারিত সময়সীমা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত সময় ক্ষমতায় থাকে। অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগের জন্য সময় নিয়েছে!

 

. মসিউর রহমান: প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন