সময়ের ভাবনা

প্রজাদের ঐতিহ্যের ইতিহাস

এম আর খায়রুল উমাম

ভারতবর্ষ সম্পদের আকর। সম্পদ লুণ্ঠনে দলে দলে এখানে মানুষ এসেছে। লুণ্ঠন করে অনেকে চলে গিয়েছে আবার অনেকে থেকে গিয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে স্থান-কালভেদে এমনটাই চলে এসেছে। যারা থেকে গিয়েছে, তারা সক্ষমতা অনুযায়ী দেশ শাসনের সুযোগ নিয়েছে। দেশ-বিদেশের ইতিহাসবিদ রাজা-বাদশাদের ইতিহাসকে তারা আমাদের ইতিহাস হিসেবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এই ইতিহাসের মধ্যে সাধারণ মানুষের ইতিহাস খুঁজে পেতে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে। বিপরীতে রাজাদের গুণকীর্তনে ভরা ইতিহাস সহজলভ্য। রাজারা কে কখন এসেছে গিয়েছে, প্রজাকল্যাণে অত্যাচারে কে কী করেছে, কে কতটা ধার্মিক ইত্যাদি। অথচ হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণ মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে বেঁচে আছে তার ইতিহাস অস্পষ্ট। এই অস্পষ্ট ইতিহাস থেকে আমরা আজও বের হতে চাই না। বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন অগ্রগতি, গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো, বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রসার, শিক্ষার অগ্রযাত্রা আমাদের কোনো মানসিক পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়নি। আন্তরিকভাবে না হলেও মৌখিকভাবে আমরা বলে থাকি কিন্তু পালন করতে পারি না, আবার তার দায়ও নিজেদের কাঁধে রাখতে চাই না। তাই ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। এখনকার ইতিহাস বর্তমান রাজাদের ইতিহাস। তাদের গুণকীর্তনের ইতিহাস।

হাজার হাজার বছরের পরাধীনতার পাশে মাত্র ৫০ বছরের স্বাধীনতা। একটা জাতির জীবনে ৫০ বছর খুব বেশি সময় নয়। এই সময়ের মধ্যে আমরা স্বাধীন মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে জাতি হিসেবে যে ঐক্য সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল, নিজের মধ্যে দেশ মানবপ্রেম জাগ্রত করার প্রয়োজন ছিল, তার ধারেকাছেও যেতে ব্যর্থ হলাম। সবার মধ্যে বিশেষ করে শাসকশ্রেণীর মধ্যে বিশ্বাস গড়ে উঠল দেশ চিরকালে, তাই সর্বপ্রথম নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে নাও। স্বাধীন দেশের মানুষ এভাবে স্বাধীন মানসিকতা তৈরি করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে নিবেদিত হয়ে পড়ল। দেশ জনগণের মঙ্গল আস্ফাালনে একটার পর একটা উন্নয়ন অগ্রগতির নামে প্রকল্পের জোয়ারে ভেসে চলল। কিন্তু কোনো প্রকল্পই নির্ধারিত সময় বরাদ্দে শেষ হলো না। স্বাধীনতার ৫০ বছরে যত প্রকল্প আমরা উপহার পেয়েছি, তা নিয়ে দেশের যেকোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান আজ একটা সমীক্ষা পরিচালনা করলেই দেখতে পাওয়া যাবে নিজেদের বা গোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে কীভাবে জনগণকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এমনও প্রকল্প আছে, যা শেষ করতে প্রাথমিক বরাদ্দের প্রায় দশ গুণ অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রয়োজন হয়েছে। দেশবাসীর অহংকার নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতু প্রকল্পও এর বাইরে নেই। বিদেশী বা নিজস্ব অর্থায়ন কোনোটাই ভাগ্যান্বেষীদের দৃষ্টির বাইরে নেই। ফলে এটাই এখন আমাদের ইতিহাস।

আমাদের রাজনীতিবিদরা স্বাধীন দেশ হিসেবে মানুষকে সচেতন করতে, সাহসী করতে, স্বপ্ন দেখাতে, লড়াই করতে যে রাজনৈতিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন, সে বিষয়টি আমলে না নিয়ে অতীতের মতোই রাজা হিসেবে থাকাটাই শ্রেয় বিবেচনা করল। রাজাদের দাপটে প্রজারা অনুগত থাকবে। রাজ আজ্ঞা প্রতিপালন করবে। কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধে যাবে নাবিষয়টা এমনই। স্বাধীনতা আমাদেরকে সবাই রাজা করতে পারল না। স্বাধীনতার উপলব্ধি জাগ্রত হলো না। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় কিছু মানুষ রাজা হলো আর বাকিরা সবাই প্রজাই থেকে গেল। প্রজাতন্ত্রও প্রজাদের মুক্তি দিল না। প্রজারা এখনো ভাবনার মধ্যে আটকে পড়ে থাকল যে রাজা বা জমিদারদের মতোই বর্তমান রাজারা তাদের কল্যাণ করবে, তাদের প্রয়োজন মেটাবে। তাদের কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য নেই। নিজেদের বা দেশ নিয়ে তাদের ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। সব ভাবনার আকর রাজা। প্রজারা রাজাকে শুধু কর দিয়ে যাবে। মধ্যযুগে কৃষকের উত্পন্ন ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ আকবরের আমলে এক-তৃতীয়াংশ এবং পরবর্তীকালে অর্ধেকের বেশি খাজনা হিসেবে দিতে হতো। এখন সর্বত্র লোকসানের অজুহাতে কর বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলমান। লোকসানের কথা বলে প্রতিটা সেবার মূল্য বৃদ্ধি করা হয় কিন্তু কেউ লোকসানের প্রকৃত কারণ খুঁজে দেখে না। সোনালি পাট একসময় দেশের হূদযন্ত্র হলেও আজ লোকসানে হাবুডুবু খাচ্ছে। পাট চাষে লোকসান হচ্ছে। পাটকলেও লোকসান হচ্ছে। সর্বশেষ লোকসানের অজুহাতে ২৫টা সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হলো। ক্ষমতার বলয়ের কারো নজরে পড়ল না যে দেশের বেসরকারি পাটকলগুলো লাভজনক হলে কেন সরকারিগুলোয় লোকসান হয়। রাজাদের বিবেচনায় পাটকল বন্ধ করে বিক্রি করা গেলে নিজেদের জন্য তা লাভজনক। ২৫ জন নতুন শিল্পপতি হবেন। স্বাধীন দেশে এভাবেই ঋণখেলাপি সৃষ্টি হয়েছে, ব্যক্তিমালিকানা গড়ে তোলা হয়েছে।

আমাদের জনকল্যাণে উন্নয়ন অগ্রগতির একটা বড় সেক্টর বিদ্যুৎ। একসময় বিদ্যুতের অভাবে দেশের মানুষ দিনরাত ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে মধ্যে পড়ে থাকত। জনগণের দুর্দশা মুক্তিতে আশু বিদ্যুৎ উৎপাদনে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করল সরকার। উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত ক্ষেত্র সৃষ্টি না করার ফলে আজ উৎপাদনের মাত্র এক-চতুর্থাংশের মতো ব্যবহূত হচ্ছে। তার পরও আশু দুর্দশা মুক্তিতে জরুরি যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তা গোষ্ঠীস্বার্থে চলমান রাখা হয়েছে। লোকসানের অজুহাতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে তা প্রজাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া চলছে। সিষ্টেম লসের নামে প্রজাদের চোর বিবেচনার যত উদ্যোগ এসেছে, তাতে সংশ্লিষ্টরা কোটিপতি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বাড়ির বিদ্যুৎ মিটার ঘরের মধ্য থেকে বারান্দায় এসেছে। সেখান থেকে ঘরের বাইরে এনে অরক্ষিত করা হয়েছে। কোটি কোটি ভালো অ্যানালগ বিদ্যুৎ মিটার বাতিল করে ডিজিটাল মিটার লাগাতে গ্রাহককে বাধ্য করা হয়েছে এবং এখন সেইসব নতুন বিদ্যুৎ মিটারের পরিবর্তে প্রি-পেইড মিটার লাগানো হচ্ছে। জনকল্যাণে চলমান বিদ্যুৎ মিটারগুলোর পরিবর্তন কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে কি?

মিটার পরিবর্তনের ধারাবাহিক প্রতিযোগিতার মধ্যে জনকল্যাণের চেয়ে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। ক্রয় থেকে শুরু করে প্রতিটি পদক্ষেপে ব্যবসা। মানি ইজ নো প্রবলেমের দেশে প্রজাকল্যাণে রাজাদের এমন উদ্যোগই শোভন। প্রজাদের বাদ-প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ নেই। পেশাজীবীদের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্তি পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে রেখেছে। দেশের সর্বত্র এখন এমন উন্নয়ন অগ্রগতির জাঁতাকলে পড়ে আছে।

দেশের মানুষের নিরন্তর চাহিদা। সব চাহিদা যে পূরণ করা সম্ভব, এমনটা নয়। চাহিদাগুলো অনেকটা শহরের কিছু রিকশাচালকদের মতো। আমাদের চলতি পথে কিছু রিকশাচালক বলে থাকেন, এখন খুব সকাল, টাকা বেশি ধরে ভাড়া দেবেন। এখন দুপুর, এখন সন্ধ্যা, এখন রাত, এখন বৃষ্টি, এখন খুব রোদ, এখন খুব শীত, এখন খুব গরম ইত্যাদি চাহিদা। এসব চাহিদা বেশির ভাগ সময় উপেক্ষিত থেকে যায়। রাজা-বাদশাদের মতো উপেক্ষা। জাতীয় জীবনে এই উপেক্ষা চলমান। ন্যূনতম চাহিদা শোনার অবস্থায় শাসকরা নেই। অতীতের মোসাহেবদের মতো এখনো মোসাহেবি চলমান। এরাই জাতির জনকের সোনার বাংলা গড়ার কারিগর। উন্নয়ন অগ্রগতির ক্ষেত্রে শাসকদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর শাসকদের স্বপ্নের ডেম্যু ট্রেন দেশে চলাচলের অনুপযোগী হওয়ার পরও তা কিনে এনে রেল ব্যবস্থায় ৬০০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকসানের দায়ভার বহন করবে উৎপাদন চালু রেখে, চলমান ডিজিটাল বিদ্যুৎ মিটারের পরিবর্তে নতুন করে আমদানীকৃত প্রি-পেইড মিটার বসিয়ে প্রজাদের সামর্থ্য বিবেচনা না করেই বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। শাসকদের দাবি দেশের মানুষের আয় বেড়েছে, মাথাপিছু আয় হাজার মার্কিন ডলারের বেশি। শাসকদের ত্যাগের মূল্য হিসেবে কর দিতে হবে না? তাই প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, পানির দাম বাড়ছে, গ্যাসের দাম বাড়ছে, রেলের টিকিটের দাম বাড়ছে, পৌরকর বাড়ছে, ভূমিকর বাড়ছে, শিক্ষাব্যয় বাড়ছে, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। প্রজাদের এমন ইতিহাস সুখকর বিবেচিত না হওয়া স্বাভাবিক।

অতীতে রাজা-বাদশাদের অত্যাচার প্রজারা সবসময় মুখবন্ধ রেখে মাথা পেতে নিয়েছে এমন নয়। প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ ছিল। সে তুলনায় প্রজাতন্ত্রের প্রজারা এখন অনেক অনেক বেশি আপসকামী। প্রতিবাদ বলতে স্মারকলিপি দেয়া আর বন্ধনহীন কিছু মানুষের মানববন্ধন। ফলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি পালন করতে যাওয়া প্রজাতন্ত্রে প্রজাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হলো না। বিপরীতে জনকল্যাণে পর্দা, বালিশ, নারকেল গাছ, কলাগাছ কেনার পাশাপাশি বিদেশে পুকুর কাটা শিখতে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। আর এসবের জন্যই আজও রাজা-বাদশাদের ইতিহাস প্রাধান্য পেয়ে চলেছে। প্রজারা অন্তরীণ।

 

এম আর খায়রুল উমাম: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন