করোনার কিছু ভাবনা

ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেন

করোনাকালীন এই অস্থির সময়ে মনের মধ্যে  অনেক বিচ্ছিন্ন ভাবনা এসে ভিড় করছে। তাই নিজের মনের এই ভাবনাগুলোকে একটু লিখে রাখার প্রচেষ্টা করছি।  দেড় যুগেরও বেশী সময় ধরে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রিয়েল এস্টেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সিপিডিএল পরিচালনায় অর্জিত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান প্যান্ডেমিক অবস্থার আলোকে আমাদের জীবন এবং জীবিকার উপর করোনা কতটুকু  প্রভাব বিস্তার করেছে  এবং এসকল প্রভাব থেকে উত্তরণে কি কি করা যেতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। 

আজ হতে ৬ মাস আগে মার্চ মাসের ৮ তারিখ যখন প্রথম করোনার ভয়াল থাবা  আমাদের জীবনে হানা দিল তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমরাও হতাশাগ্রস্থ হয়ে পরেছিলাম। স্বাস্থ্যখাত সহ অর্থনৈতিক খাতে আমাদের অনেক দিন্যদশা স্পষ্ট হয়ে পরেছিল। এক অনিশ্চয়তার  মধ্যে আমরা জীবন যাপন করছিলাম। কিন্তু স্রস্টার অশেষ রহমতে আজকে ছয় মাস পরে  এসে  বলতে পারি যতটুকু ক্ষতির আশঙ্কা আমরা করেছিলাম তার হইতবা ২০% হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের পজিটিভ মানসিকতা দিয়ে আমরা এই বিপদকে অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। 

যখনই কোন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তা বৈশ্বিক হোক বা আঞ্চলিক, দুরভাগ্যজনক ভাবে এর প্রথম ধাক্কাটা হানে রিয়েল এস্টেটের উপর।  ২০০৯ থেকে ২০১১ চাঙ্গাভাব কাটানোর পর  ২০১২ সালের পর থেকে বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট শিল্পের খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল। বাংলাদেশের অস্থির রাজনিতিক প্রেক্ষাপটে এই খাতে বিনিয়োগ এবং আস্থা অনেক কমে গিয়েছিল। এরপর দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টায় এই খাতে ২০১৭ সাল থেকে আবার উন্নতি হচ্ছিল। ২০২০ সালে ২০% প্রবৃদ্ধির হার ধারণা করা হচ্ছিল, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের পজিটিভ ফলাফল এই ধারণাকে বদ্ধমূল করে।

কিন্তু মার্চে এসে এই চিত্র রাতারাতি বদলে যায়। করোনার ভয়াল থাবায় সবকিছুই থমকে যায়,  জুন-জুলাই মাসে এসেও এর ভয়াবহতা সবচে দেখা যায় যখন পিক সংক্রমণ চলছিল। তবে অগাস্ট মাস থেকে এসে এর সংক্রমন অনেকটা কমতে থাকে। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে করোনা তার আগের ভয়াবহতা অনেকটা হারিয়ে ফেলছে এবং জনসাধারন এর সঙ্গে জীবনযাপনে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।

করোনা পরিস্থিতি এমন এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের জন্য যে, অনেক কিছুই আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না কিন্তু পালন করতে হচ্ছে। এটাকেই সবাই ‘নিউ নরমাল’ বলে আখ্যায়িত করছেন। আমরা  এসকল নিউ নরমালে ধীরে ধীরে  অভ্যস্থ হচ্ছি। এই মহামারীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের জীবনকে এক নতুন স্বাভাবিকতায় সাজিয়ে নিচ্ছি।

সিপিডিএল এ আমরা প্রথম দিন থেকেই হোম অফিস শুরু করেছি, একদিনের জন্যও বসে থাকিনি। কাজের ধরন ও বাস্তবতা কে মাথায় রেখে সময় ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছি। ইতোমধ্যে সম্পাদন করেছি নানাবিধ প্রশিক্ষণ কর্মশালা, আমাদের বিশাল কর্মী বাহিনীর কর্মদক্ষতা বাড়াতে এবং সেবা প্রদানে আরও প্রস্তুত করতে আমরা এসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তাছাড়া সকলের পজেটিভনেস ধরে রাখতে মানসিক দৃঢ়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যও আমরা প্রতিনিয়ত অফিস এবং প্রকল্প পর্যায়ে মোটিভেশনাল নানা রকমের কর্মশালা পরিচালনা করেছিলাম। এসকল উদ্যোগ এবং কার্যক্রম ধীরে ধীরে সকলের মনোবল ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই আমরা আজকে আমরা গর্ব করে বলতে পারি এই মহামারী হয়তবা আমাদের থেকে ব্যাবসা করার কিছু সময় কেড়ে নিয়েছে কিন্তু   পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো দক্ষ করেছে। একটা কার্যকরী টীম হিসেবে আমাদেরকে মানসিকভাবে অনেক পরিপূর্ণ করেছে। 

করোনা পরিস্থিতির বহু আগেই আমরা প্রযুক্তি নির্ভর গ্রাহকসেবার প্রচলন করেছি। সিপিডিএল কেয়ার এপ নামক মোবাইল এপ্লিকেশনের মাধ্যমে আমরা আমাদের গ্রাহকদের বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করে আসছি গতবছর হতেই। ফলে বিদ্যমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমাদের গ্রাহক সেবায় কোন ঘাটতি দেখা দেয়নি। আমাদের সকল গ্রাহক আমাদের যাবতীয় কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে সব সময়ই অবহিত থাকেন, ফলে গ্রাহক আস্থার ঘাটতিও আমরা দেখছি না। 

করোনার এই ক্রান্তিকালে অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতের মতো রিয়েল এস্টেট খাতকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, যার কারণে এই খাত অনেক গতিশীল হবে। এর মধ্যে উল্লেখজনক হল এই খাতে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ। এই ক্ষেত্রে কোন প্রশ্ন ছাড়াই ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের সময় অল্প কিছু চার্জ প্রদান করে এই খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে। আমরা আশা করছি, এই টাকাগুলো এখন বিদেশে পাচারের পরিবর্তে দেশে বিনিয়োগ হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখবে। এছাড়াও রিহ্যাব এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের বহুদিনের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্ল্যাট এবং কমার্শিয়াল স্পেসের রেজিস্ট্রেশন কয়েক দফায় প্রায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ কমানো হয়েছে। এর কারনে গ্রাহকদের খরচ অনেকাংশে কমেছে। এছাড়াও সামগ্রিকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হার কমে যাওয়াতে ফ্ল্যাট লোনের ইন্সটলমেন্ট অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যা গ্রাহককে ব্যাংক লোনের মাধ্যমে এই খাতে বিনিয়োগ করতে আরো উৎসাহিত করবে। অনেকদিন পরে হলেও রিয়েল এস্টেট খাতের গতিশীলতা বাড়ানোর জন্য এসব কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকার সাধুবাদ পাবার যোগ্য। তবে আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই রিহ্যাব এবং এর প্রেসিডেন্ট আলমগির সামসুল আলামীন (কাজল) ভাইকে, সরকারকে এই ব্যাপারে বারবার করে বুঝানোর কারণে এই পজিটিভ পদক্ষেপগুলো আমরা পেয়েছি, যা এই খাতকে আরো গতিশীল করবে।

তবে মার্চ হতে জুন পর্যন্ত সামগ্রিক স্থবিরতার কারণে চলমান প্রকল্প সমূহের কাজ এরই মধ্যে অনেক পিছিয়ে গেছে। ফলে এরই মাঝে প্রকল্প সমূহের প্রতিশ্রুত হস্তান্তর শিডিউল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। এই বিলম্ব পুষিয়ে নিতে এবং এর ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনতে প্রয়োজন পড়বে সকলের সম্মিলিত প্রয়াশ। সরকার, রিহ্যাব, গ্রাহক, ভূমি মালিক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, কনসালটেন্ট, সাপ্লাইয়ারসহ রিয়েল এস্টেট এর সকল স্টেক হোল্ডারদের যার যার অবস্থান থেকে এই শিল্প খাত কে উজ্জীবিত করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। 

তবে আমি মনে করি যে এই সময়টা রিয়েল এস্টেট এ বিনিয়োগকারীদের জন্য আদর্শ সময়। এই খাতের বিনিয়োগ ঐতিহাসিকভাবেই স্থিতিশীল এবং দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদে যথার্থ মুনাফা নিশ্চিত করে। বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে সবাইকে পজেটিভ মাইন্ড সেটে কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করে এগিয়ে আসতে হবে। 

কাজের গতি স্বাভাবিক রাখতে পারলেই সকলের মাঝে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে এবং বিনিয়োগ সম্ভাবনা বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। 

এজন্য দীর্ঘমেয়াদে এই খাতকে আরও গতিশীল করতে আরো কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা যেতে পারে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১। সরকার ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করা উচিৎ। কিন্তু ব্যাংক গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে সঠিক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। রিহ্যাবসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই এই বিষয়ে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

২। অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের ব্যাপারে অন্তত আগামী  পাঁচ বছর কোন প্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই বিনিয়োগের এই ধারাটা রাখতে হবে, যেন এক বছর পরেই এই সুযোগটা বন্ধ না হয়ে যায়। কেননা অপ্রদর্শিত আয় বা ট্যাক্স ফাইলে উঠে নাই এমন হাজার হাজার কোটি টাকা প্রত্যেক বৎসর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, উক্ত টাকা দেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিলে প্রকারন্তরে দেশেরই লাভ হবে।

৩। গ্রাহক সাধারণের ইতোমধ্যে গৃহীত ঋণ এর ক্ষেত্রে সহনীয় কিস্তি সুবিধা এবং অন্ততঃ এক বছরের গ্রেইস পিরিয়ড দেয়ার কথা বিবেচনায় নিতে হবে। নতুন গ্রাহকদের জন্য সহজ শর্তে ৫% হারে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জরুরী ভিত্তিতে চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে রিহ্যাবকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ে এই উদ্যোগ নিতে হবে। নাহলে  অনেক ফ্ল্যাট অবিক্রিত থাকবে,  মূল্যের অযৌক্তিক পতন ঘটবে, ফলে ব্যবসায় স্থবিরতা ও পুঁজিতে ধস নামার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে।

৪। নগরায়ন প্রক্রিয়াকে সামগ্রিক ভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, বিকেন্দ্রীকরণ এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর পাশাপাশি অন্যান্য জেলা বা অঞ্চল ভিত্তিক টাউনশীপ পরিকল্পনা করার এখনই আদর্শ সময়, কেননা, করোনা প্যান্ডেমিক আমাদের শিখিয়েছে ঘরে থাকার গুরুত্ব। কিন্তু সীমিত আকারের ফ্ল্যাট বাড়ীতে বদ্ধ থাকা যে কতটা কঠিন তা আমরা মনে হয় ইতোমধ্যে সকলেই অনুধাবন করতে পেরেছি। তাই পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান ও নানারকমের নাগরিক সুবিধাদি সম্বলিত টাউনশীপ গুলো হতে পারে এক্ষেত্রে মোক্ষম সমাধান। উদাহরণ স্বরূপ, ঢাকায় পূর্বাচল এবং চট্টগ্রামে অনন্যা আবাসিক এলাকায় পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা গেলে, এধরনের টাউনশীপ প্রকল্প সমূহের ফ্ল্যাটগুলো মধ্যবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসবে বলে মনে করি।

৫। বাংলাদেশ ব্যাংক বা বিশ্ব ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান যদি এগিয়ে আসে, ২০ বছর বা ততোর্দ্ধ মেয়াদি ঋণ সুবিধা প্রদান করে তাহলে হয়তো ভাড়ার টাকায় গ্রাহকদের জন্য ফ্ল্যাটের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

৬। ফ্ল্যাট বা জমির রেজিস্ট্রেশন ব্যয় আরো কমিয়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এছাড়াও গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের মতো সেকেন্ডারি  ফ্ল্যাট বিক্রয়কে আরো গতিশীল করার জন্য দ্বিতীয়বার ফ্ল্যাট  রেজিস্ট্রেশন খরচ আরো কমিয়ে আনা দরকার, তাহলে এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আরো বৃদ্ধি পাবে।

উপরোক্ত প্রস্তাবনাসমূহ বাস্তবায়ন করা গেলে রিয়েল এস্টেট শিল্পখাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সঙ্গে সঙ্গে অগ্রগতি আসবে লিঙ্কেজে থাকা রড, সিমেন্ট, ইট, টাইলস ইত্যাদি সহ হাজার রকমের ফিনিশিং আইটেমের শতাধিক শিল্পখাতে, কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে লক্ষ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট জনবলের। সকলে মিলে অবদান রাখতে পারবে জাতীয় অর্থনীতিতে। 

সর্বশেষ চলমান করোনা পরিস্থিতি আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় শুধুমাত্র একটি ভাইরাসের আক্রমন যা অসুখ বা বিপর্যয় নয়, এখন এটিই নতুন বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বা মানিয়ে নিয়ে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। যার যার অবস্থান হতে সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। 

এভাবেই আমাদের জয় আসবে, ইনশা আল্লাহ।

ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেন

এমডি ও সিইও, সিপিডিএল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন