ঋণের নিশ্চয়তা নয় ভোগান্তিই বাড়াচ্ছে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি

হাছান আদনান

আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত গ্যারান্টিকে সেকেলে প্রথা হিসেবে দেখা হয়। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে ব্যক্তিগত গ্যারান্টির প্রচলন উঠে গেছে বহু আগেই। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পর্যাপ্ত জামানত না থাকলে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে গণহারে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি আদায় করছে ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার পাশাপাশি তার পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধুবান্ধব পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকেও গ্যারান্টি নেয়া হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানও। আর কোনো কারণে গ্রাহক ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যারান্টরদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে মামলা।

ব্যক্তিগত গ্যারান্টিতে ব্যাংকাররা উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের সাধারণ ঋণগ্রহীতারা। সম্প্রতি এক সহকর্মীর ব্যক্তিগত ঋণের গ্যারান্টর হয়ে সামাজিক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী সালাউদ্দিন। তার ভাষ্য হলো, অফিসের এক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হঠাৎ করে এসে একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেন। একই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চান। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। দুই বছর পর একটি ব্যাংক থেকে ফোন করে জানায় সহকর্মীর ঋণের গ্যারান্টর হিসেবে আমাকে মামলার আসামি করা হবে। মামলা থেকে বাঁচতে হলে তার ঋণের অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় জড়িয়ে সামাজিক আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে আমাকে।

সালাউদ্দিনের মতোই মামলার আসামি হওয়ার ভয়, সামাজিক সম্মানহানি আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে সরল বিশ্বাসে ব্যাংকঋণের গ্যারান্টর হওয়া অসংখ্য মানুষ। আবার পর্যাপ্ত গ্যারান্টর না পাওয়ায় অনেক সাধারণ মানুষ ব্যাংকঋণ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিতও হচ্ছে। -১০ লাখ টাকা ঋণের জন্য কোনো কোনো ব্যাংক -১০ জনের কাছ থেকে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নিচ্ছে।

সরল বিশ্বাসে বন্ধুর ব্যক্তিগত গ্যারান্টর হয়ে ভুক্তভোগী হয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি নীতি বিভাগের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভাগটিই দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য নীতি প্রণয়ন করে। কেন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এখনো ব্যক্তিগত গ্যারান্টির বিষয়টি ব্যাপক মাত্রায় চর্চিত হচ্ছে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামানত নেই এমন ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নেয়। দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রথা বহুদিন ধরে চর্চা হচ্ছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ না থাকলে কোনো ব্যক্তিরই অন্য কারো ঋণের গ্যারান্টর হওয়া উচিত নয়। আবার এমন ব্যক্তির গ্যারান্টরও হওয়া উচিত নয়, যার আর্থিক লেনদেন খারাপ। ব্যাংকগুলোরও এমন গ্যারান্টি নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি দিতে হবে, এমন বিধান লেখা নেই দেশের কোনো আইনে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, ব্যাংক জামানত গ্রহণ করে কিংবা জামানতবিহীন যেকোনো ঋণ বিতরণ করতে পারবে। আইনের অস্পষ্টতাকে পুঁজি করেই ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নিয়ে ধূম্রজাল তৈরি করেছে ব্যাংকগুলো। জামানতের সম্পদ দিয়ে ঋণের অর্থ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলে কিংবা জামানতবিহীন ঋণে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি আদায় করার কথা। যদিও ব্যাংকাররা গ্রাহকদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি আদায় করছে গণহারে। যত পারো ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নাও নীতিতেই চলছে দেশের ব্যাংকিং খাত।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪৫ বছর ধরে ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত আছেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ . (রুমী) আলী। বর্তমানে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অভিজ্ঞ ব্যাংকার বণিক বার্তাকে বলেন, উন্নত বিশ্বে গ্রাহককে ঋণ দেয়া হয় ক্যাশ-ফ্লো দেখে। এক্ষেত্রে জামানত কিংবা গ্যারান্টির প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশে জামানত ছাড়া ঋণ দেয়া অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। এজন্য ব্যাংকগুলো অনেক সময় নাবালক সন্তানকেও গ্যারান্টর করে। এটি আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য কখনই উত্তম চর্চা হতে পারে না।

ইউরোপ, আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাংকগুলো নিরীক্ষা করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে রুমী আলীর। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ইউরোপের দেশগুলোতে ঋণ নেয়ার জন্য ব্যক্তিগত গ্যারান্টি বা জামানতের প্রয়োজন হয় না। তবে আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে জামানত ব্যক্তিগত গ্যারান্টির প্রচলন আছে। মূলত সুশাসন স্বচ্ছতার ঘাটতিই এক্ষেত্রে মৌলিক সমস্যা।

ব্যাংকাররা রিটেইল, সিএসএমই ব্যক্তিগত ঋণে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নিতে যতটা তত্পর, ঠিক ততটাই উদাসীন বড়দের ঋণের ক্ষেত্রে। পর্যাপ্ত জামানত না থাকলেও শুধু গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কের কথা বলে বড় করপোরেটদের হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে নেয়া হচ্ছে না করপোরেট কিংবা ব্যক্তিগত গ্যারান্টিও। বড়দের ঋণ দেয়ার জন্য এক ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে অন্য ব্যাংক। এজন্যই দেশের ব্যাংকিং খাতে ঘটছে হলমার্ক, এননটেক্স, ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি টাকারও বেশি। খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণের সঙ্গে পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে দেখা যাবে দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের এক-চতুর্থাংশেরও বেশিই খেলাপি।

ব্যাংকঋণের ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য হলো ঋণকে যথাসম্ভব নিরাপদ রাখা। তবে ঋণ বিতরণের ক্ষমতা জামানত গ্রাহণের নীতিমালার বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনতা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো নিজেদের জন্য প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতেই ঋণের জামানত গ্যারান্টি গ্রহণ করে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে বৈশ্বিকভাবে জামানত গ্রহণ করপোরেট গ্যারান্টির প্রচলন আছে। তবে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বর্তমানে জামানত গ্রহণের নীতিকেও সেকেলে ধারণা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে ব্যাংকঋণ নেয়ার জন্য জমি বা বাড়ি বা স্থাবর সম্পত্তি জামানত রাখার প্রয়োজন হয় না। ব্যাংক থেকে নেয়া অর্থ ফেরত দেয়া হবে, প্রতিশ্রুতিই সেখানে বড় জামানত হিসেবে ব্যবহূত হয়। যদিও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জামানত, করপোরেট গ্যারান্টির পাশাপাশি ব্যক্তিগত গ্যারান্টিও আদায় করছে।

ধারকৃত অর্থ ফেরত না দেয়ার সামাজিক ব্যাধির কারণেই দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যক্তিগত গ্যারান্টির চর্চা এখনো চলছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশে কাউকে টাকা দিয়ে আদায় করার প্রক্রিয়াটি জটিল সময়সাপেক্ষ। এজন্যই গ্রাহকদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নেয়া হয়। এটি দীর্ঘদিনের প্রথা হিসেবে ব্যাংকিং খাতে চর্চা হচ্ছে। পিতা-মাতা, সন্তান, স্ত্রীসহ নিকটাত্মীয়দের ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নেয়া হলে গ্রাহকরা সামাজিক সম্মানের স্বার্থেই টাকা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করেন। ব্যাংকাররা বাধ্য হয়েই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।

ঠিক কখন থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি নেয়া শুরু হয়েছে, তা সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করতে পারেননি। তারা বলছেন, একসময় গ্রাহকদের ব্যাংকের কাছে জামানত দেয়ার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদ ছিল না। এজন্যই ব্যক্তিগত গ্যারান্টি আদায়ের চর্চা শুরু হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক খাতে অনেক কিছু বদলালেও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ব্যক্তিগত গ্যারান্টির চর্চায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। উল্টো দিনদিন ব্যক্তিগত গ্যারান্টির সংখ্যা পরিসর বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো।

যাদের সঙ্গে পারি, তাদের সঙ্গে করি’— মনোভাব নিয়েই বাংলাদেশের ব্যাংকাররা চলেন বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। কারণে দেশে আন্তর্জাতিক মানের আদর্শ ব্যাংকিংয়ের চর্চা করা কঠিন। ঋণখেলাপিদের বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে দেশে ক্রিমিনাল হিসেবে সম্বোধন করা হয় না। পরিস্থিতির পরিবর্তন লাগবে। দীর্ঘদিন থেকেই ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ দেখা যাচ্ছে না। প্রচলিত আইন রীতিনীতি দেশের ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য এখন সময় হলো সবকিছুকে ঢেলে সাজানোর।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন