ইউনাইটেড পাওয়ারকে শক্ত মৌলভিত্তির কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই

সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি ইউপিজিডিসিএল তাদের গ্রুপের চট্টগ্রাম জামালপুরের ৪১৫ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৯৯ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অধিগ্রহণের ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির ব্যবসায়িক আর্থিক প্রভাবসহ কোম্পানির বিভিন্ন দিক নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ইউপিজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনউদ্দিন হাসান রশীদ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

জামালপুর চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ইউপিজিডিসিএল অধিগ্রহণ করতে চাইছে কেন? এতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি কী সুবিধা পাবে?

আমাদের পুঁজিবাজারে আসার উদ্দেশ্যই ছিল একটি স্ট্রং ব্র্যান্ড ভ্যালুর কোম্পানি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। এর ফলে ভবিষ্যতে আমরা যখন বড় কোনো প্রকল্পের কাজ শুরু করব, তখন সুনাম আমাদের জন্য সহায়ক হবে। ২০১৫ সালে আমরা পুঁজিবাজারে আসার এক মাসের মধ্যেই বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়েছি এবং সেটি আগের দুই বছর অর্থাৎ ২০১৩ ২০১৪ সালের লভ্যাংশসহ। এরপর প্রতি বছরই কিন্তু আমরা ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়িয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি বিনিয়োগকারীদের পুরস্কৃত করা হলেও তারাও এর প্রতিদান দেবেন। একইভাবে ঢাকা চট্টগ্রাম ইপিজেডের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি যখন স্যাচুরেটেড পর্যায়ে চলে আসে তখন কিন্তু আমরা ইউনাইটেড এনার্জিকে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির সঙ্গে একীভূত করে নেই। যেহেতু ৯০ শতাংশ শেয়ারই আমাদের কাছে ছিল কারণে আমরা মাত্র লাখ ৯৭ হাজার টাকায় ২৮১ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি একীভূত করেছি। আমাদের পক্ষ থেকে এটি ছিল বিনিয়োগকারীদের জন্য উপহার বলতে পারেন। আইপিওতে আসার সময়ও আমরা বিনিয়োগকারীদের পুরস্কৃত করেছি। আমরা ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সে সময় আমাদের সক্ষমতা ছিল ৮৫ মেগাওয়াট আর এর সঙ্গে আরো ৭৫ মেগাওয়াট যোগ করার জন্য পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের কথা ছিল। কিন্তু তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া দুই বছর পিছিয়ে যাওয়ার কারণে প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি অর্থ আমরা ঋণ নিয়ে সম্পন্ন করে ফেলি। ফলে দেখা যায় যখন আমার পুঁজিবাজারে আসি তখন অর্ধেকেরও বেশি বিনিয়োগ আমরা নিজেরাই করে ফেলেছি। এক্ষেত্রেও আমরা ৯০ মেগাওয়াটের বিনিয়োগকারীদের উপহার হিসেবে দিয়েছি। এবারই যে প্রথম আমরা এমনটি করেছি তা নয়। এর আগে ফেসভ্যালুতে ইউনাইটেড এনার্জিকে অধিগ্রহণ করেছি। তাছাড়া ফেসভ্যালুতে কেপিসিএলকে পায়রা পাওয়ারের ৩৫ শতাংশ মালিকানা প্রদান এবং ২০১১ সালে কেপিসিএলকে খানজাহান আলী পাওয়ারের মালিকানা হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও আমাদের মধ্যে একই দর্শন কাজ করেছে। এবার আসি ইউনাইটেড আনোয়ারা ইউনাইটেড জামালপুরের অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে। চট্টগ্রামের আনোয়ারার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট আর জামালপুরের ১১৫ মেগাওয়াট। দুটি মিলে ইউপিজিডিসিএলের সঙ্গে আরো ৪১৫ মেগাওয়াট যোগ হচ্ছে। সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন বিবেচনায় আনোয়ারার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে বছরে টাকা ১৭ পয়সা এবং জামালপুর থেকে টাকা ৬২ পয়সা তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয়ের (ইপিএস) সঙ্গে যোগ হবে বলে আশা করছি। আর দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মোট টাকা ৭৯ পয়সা ইউপিজিডিসিএলের ইপিএসের সঙ্গে যোগ হতে পারে। করপরবর্তী মুনাফার কথাই যদি বলি, তাহলে দেখা যাচ্ছে ৩০ জুন ২০২০ শেষে ইউনাইটেড আনোয়ারার ৩২৫ কোটি টাকা এবং ইউনাইটেড জামালপুরের ১৩৮ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। দুটির সম্মিলিত মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪৬৩ কোটি টাকায়। অধিগ্রহণের ফলে একদিকে যেমন আমাদের রাজস্ব মুনাফা বাড়বে। অন্যদিকে আমাদের ফুয়েল ডাইভারসিফিকেশনও হবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির আওতায় এখন পর্যন্ত যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোর সবগুলোই গ্যাসভিত্তিক। এবার এর সঙ্গে এইচএফও যোগ হচ্ছে। আরেকটি দিক হচ্ছে আমরা পুঁজিবাজারে এমন দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আসছি, যেগুলোর আরো ১৪ বছর কর অবকাশ সুবিধা বাকি আছে। তাছাড়া আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই কেন্দ্র দুটির নির্মাণকাজ শেষ করেছি।

বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি অধিগ্রহণের সময় এর মোট সম্পদমূল্য ছিল হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। কেন্দ্র দুটির নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) ৫৩৫ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে এই দুই কেন্দ্রের রিটেইন আর্নিংসই রয়েছে ৫১৫ কোটি টাকার। ফলে কেন্দ্র দুটি অধিগ্রহণে ইউপিজিডিসিএলের প্রকৃতপক্ষে মাত্র ২০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। তাছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির মোট সম্পদমূল্য হাজার ৫৩৫ কোটি হিসেবে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য গড়ে প্রায় লাখ ডলার ব্যয় হচ্ছে। যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে ব্যয় থেকে লাখ ডলার। কেন্দ্র দুটির বয়স মাত্র এক বছর। ফলে এক্ষেত্রে অবচয় তুলনামূলক কম আসবে। ক্যাপাসিটি চার্জ একই থাকার কারণে ধরে নেয়া যায় আগামী ১৪ বছর ধরেই কেন্দ্র দুটি থেকে আয় প্রায় একই রকম থাকবে। শুধু প্রতি বছর সুদ বাবদ অর্থ ব্যয় হবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে ইউনাইটেড আনোয়ারা ইউনাইটেড জামালপুরের আর্নিংস মাল্টিপল হিসাব করলে কেন্দ্র দুটির ভ্যালুয়েশন দাঁড়ায় হাজার কোটি টাকা। আর ফেয়ারভ্যালুতে হিসাব করলে ভ্যালুয়েশন হাজার ৮০০ থেকে হাজার ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অধিগ্রহণের ফলে বিদ্যুৎ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইউপিজিডিসিএল অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিতে পরিণত হবে।

ডলারের দাম ওঠানামার ফলে কোম্পানির আয়ের ওপর কী প্রভাব পড়বে?

টাকা শক্তিশালী হলে আমাদের ক্ষতি হবে, অন্যদিকে ডলার শক্তিশালী হলে আমাদের মুনাফা হবে। পাশাপাশি যেহেতু আমাদের আয়ও হয় ডলারে, তাই এক্ষেত্রে আমাদের উপকৃত হওয়ারও সুযোগ থাকছে।

ভ্যালুয়েশন বেশি থাকা সত্ত্বেও এনএভিতে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র অধিগ্রহণ করতে চাইছেন কেন?

আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি স্ট্রং লিস্টেড কোম্পানি হিসেবে ইউপিজিডিসিএলকে প্রতিষ্ঠিত করা। কারণে আমরা সবসময় শুধু নিজেদের মুনাফার পাশাপাশি আমাদের যারা অংশীদার বা বিনিয়োগকারী রয়েছেন, তাদেরও পুরস্কৃত করার চেষ্টা করেছি। একটি স্ট্রং কোম্পানি হতে পারলে সেটিই হবে আমাদের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় মূলধন।

বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির অধিগ্রহণের সুফল বিনিয়োগকারীরা কবে থেকে পাবেন?

যদি কোম্পানির বিশেষ সাধারণ সভায় (ইজিএম) বিনিয়োগকারীরা অধিগ্রহণ প্রস্তাব অনুমোদন করেন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনাপত্তি পাওয়া যায়, তাহলে বছরের জুলাই থেকেই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া কার্যকর হবে। ফলে তখন চলতি ২০২০-২১ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিক থেকেই বিনিয়োগকারীরা এর সুফল পাবেন।

অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার লেনদেন কীভাবে হবে?

আমরা নগদ অর্থে ইউনাইটেড জামালপুর ইউনাইটেড আনোয়ারার ৯৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেব।

সামনের দিনগুলোতে আপনাদের ভিশন পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?

বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সরকারের যে কোনো উদ্যোগের সঙ্গে আমরা থাকতে চাই। দেশের বিদ্যুৎ খাতের এখনো অনেক দূর যাওয়ার আছে। ফলে খাতের রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখতে চাই। ভবিষ্যতে যদি সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি খাতে বড় আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র দেয়া হয়, আমরা সেখানে অংশগ্রহণ করব। আরেকটি বিষয় হচ্ছে ইউপিজিডিসিএল ছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপের অন্য কোনো বিদ্যুৎ কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনা হবে না। এর মানে হচ্ছে, পুঁজিবাজারে যতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রই আনা হবে সবগুলোই ইউপিজিডিসিএলের আওতায় আনা হবে। তাছাড়া আমরা আর্থিকভাবে সক্ষম কোম্পানি হিসেবে ব্যবসা করতে চাই। যেহেতু আমরা কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছি, তাই ঋণমুক্ত থাকাটাই আমাদের লক্ষ্য। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব আমরা ঋণ পরিশোধ করব। আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধিও অর্জন করতে চাই, তবে অবশ্যই সেটা টেকসই প্রবৃদ্ধি হতে হবে।

আপনাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ কতদিন বাকি রয়েছে?

ইউপিজিডিসিএলের ১০ বছর শেষ হলো। প্রথম চুক্তির আরো ২০ বছর বাকি রয়েছে। তাছাড়া একটি আরো ৩০ বছর মেয়াদে নবায়নযোগ্য। ফলে ইউপিজিডি আরো ৫০ বছর থাকবে বলে আশা করছি। আশুগঞ্জের কেন্দ্রটির আরো ১০ বছর মেয়াদ বাকি রয়েছে। আর নতুন যেগুলো রয়েছে, সেগুলোর এখনো ১৪ বছরের মেয়াদ বাকি রয়েছে।

কম দামে কোয়ালিটি পাওয়ার নিশ্চিত করা কীভাবে সম্ভব?

সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর সময় অনেক ক্ষেত্রে চার্জ কমিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া আমাদের ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সমিশনের ক্ষেত্রে ইফিশিয়েন্সির মাধ্যমে ব্যয় কমানো সম্ভব। এর বাইরে ভারত নেপাল থেকে কম দামে জলবিদ্যুৎ আনতে পারলে ব্যয় সাশ্রয়ের মাধ্যমে কোয়ালিটি বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন