সময়ের ভাবনা

করোনা ভ্যাকসিন দৌড়ে কে আছে কোন অবস্থায়

ডা. খোন্দকার মেহেদী আকরাম

[গতকালের পর]

Ÿ এমআরএনএ ভ্যাকসিন

এমআরএনএ করোনা ভ্যাকসিন আরেকটি আলোচিত ভ্যাকসিন। আমেরিকার মডার্না এবং জার্মানির বায়োন্টেক/ফাইজার তৈরি করছে এই নতুন ধরনের ভ্যাকসিন। মডার্না তাদের ভ্যাকসিনটির প্রি-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালায় বানরের ওপর। ভ্যাকসিন প্রয়োগে বানরের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি টি-সেলের উপস্থিতি নির্ণীত হয় (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন, ২৮ জুলাই) এরপর তারা ভ্যাকসিনটির ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালায় ৪৫ জন ভলান্টিয়ারের ওপর। ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করে পর্যাপ্ত। এছাড়া ভ্যাকসিনটি সফল টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম হয় (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন, ১৪ জুলাই) বায়োনটেকের চালানো ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও আশানুরূপ ফল প্রদর্শন করে, যেখানে ভ্যাকসিনটি শরীরে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি এবং টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম হয়। মডার্না ফাইজার এখন তাদের ভ্যাকসিনের ফেইজ-/ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ হাজার ভলান্টিয়ারের ওপর।

Ÿ কিল্ড বা ইনেক্টিভেটেড ভ্যাকসিন

পদ্ধতিতে নভেল করোনাভাইরাসকে কেমিক্যালের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভ্যাকসিন তৈরির এটি একটি প্রাচীন পদ্ধতি এবং বর্তমানে ব্যবহূত অনেক ভ্যাকসিনই পদ্ধতিতে তৈরি। চীনের সিনোভ্যাকের করোনাভ্যাক সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দুটি পদ্ধতিতে তৈরি।

সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিনের প্রি-ক্লিনিক্যাল স্টাডি চালায় ইঁদুর বানরের ওপর। ভ্যাকসিনটি ইঁদুর বানরের রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তবে তা টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে ব্যর্থ হয় (সায়েন্স, জুলাই)! এরপর ভ্যাকসিনটির ফেইজ- ট্রায়াল চালানো হয় ৬০০ জন ভলান্টিয়ারের ওপর। ভ্যাকসিনটি ৯৫ শতাংশ টিকা গ্রহীতার রক্তে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সমর্থ হয়। তবে সেই অ্যান্টিবডি টাইটার ছিল কনভালেসেন্ট প্লাজমায় প্রাপ্ত নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি টাইটারের চেয়ে যথাক্রমে দশমিক থেকে গুণ কম। ট্রায়ালটিতে টি-সেল রেসপন্স পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।

অন্যদিকে সিনোফার্ম তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-/ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালায় যথাক্রমে ৯৬ এবং ২২৪ জন ভলান্টিয়ারের ওপর। দুই ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১৪ দিন পরেই রক্তে তৈরি হয় পর্যাপ্ত ভাইরাস নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি। ট্রায়ালে দেখা যায়, ১০০ শতাংশ ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হলে প্রয়োজন হয় ২৮ দিন অন্তর তিন ডোজ ভ্যাকসিন। দুই ডোজে শুধু ৮৬ শতাংশ মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় (ঔঅগঅ জার্নাল, ১৩ আগস্ট) সিনোভ্যাক বা সিনোফার্ম কোনো ভ্যাকসিনই টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে পারেনি। তার কারণ হলো, ইনেক্টিভেটেড বা কিল্ড ভ্যাকসিন টি-সেল মেডিয়েটেড ইমিউন রেসপন্স করাতে অক্ষম।

Ÿ প্রোটিন ভ্যাকসিন

সম্প্রতি আলোচিত আরেকটি ভ্যাকসিন হচ্ছে আমেরিকার নোভাভ্যাক্স। এটি একটি রিকম্বিনেন্ট স্পাইক প্রোটিন ভ্যাকসিন, যেখানে প্রোটিনটি তৈরি করা হয়েছে মথের শরীরে। প্রোটিন ম্যাট্রিক্স-এম অ্যাডজুভেন্টের সঙ্গে মিশিয়ে মাংসপেশিতে দেয়া হয় ভ্যাকসিন আকারে। নোভাভ্যাক্সের ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়েছে ১৩১ জন ভলান্টিয়ারের ওপর। ২১ দিন অন্তর দুই ডোজ ভ্যাকসিন যথেষ্ট পরিমাণ নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করে, রক্তে যার টাইটার ছিল কনভালেসেন্ট প্লাজমার নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির চার গুণ বেশি। ভ্যাকসিনটি টি-সেল রেসপন্স ঘটাতেও সক্ষম হয়েছে শতভাগ।

সুতরাং দেখা যায়, উল্লিখিত ভ্যাকসিনগুলোর ভেতরে সিনোভ্যাক সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দুটি ছাড়া বাকি সব ভ্যাকসিনই কাজ করে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল অ্যাকটিভেশনের মাধ্যমে। সেই বিচারে অক্সফোর্ড, মর্ডানা, স্পুটনিক-, বায়োনটেক, ক্যানসিনোবায়ো অথবা নোভাভ্যাক্স ভ্যাকসিনগুলো বেশি কার্যকরী হবে বলে মনে হয়। তবে শুধু ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরেই নিশ্চিত করে বলা যাবে কোন ভ্যাকসিনগুলো প্রকৃতভাবেই কার্যকরী।

গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন এখন কোন অবস্থায়?

বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেক মার্চের শুরুতে তাদের ভ্যাকসিন প্রজেক্ট শুরু করে এবং জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে তাদের ভ্যাকসিনের প্রথম সাফল্য প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে সবাইকে অবগত করে। পাঁচটি খরগোশের ওপর চালানো প্রি-ক্লিনিক্যাল ভ্যাকসিন টেস্টে তারা আশাব্যঞ্জক ফল পেয়েছে। এর পরে তারা শুরু করে ইঁদুরের ওপর তাদের ভ্যাকসিনের কন্ট্রোলড অ্যানিমেল ট্রায়াল। টিভি খবরের কাগজ থেকে জানা যায় যে তারা মাসের মাঝামাঝিতে অ্যানিমেল ট্রায়াল শেষ করবে এবং ট্রায়ালে তারা আশাব্যঞ্জক ফল পেয়েছে। এখন তাদের প্ল্যান অক্টোবরের শুরুতেই তাদের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করার। যদিও এখনো তারা তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ফল কোথাও প্রকাশ করেনি। গ্লোব বায়োটেক দাবি করছে, আগামী তিন মাসে তারা তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করবে এবং ভ্যাকসিনটি বাজারে নিয়ে আসতে পারবে ডিসেম্বরে অথবা জানুয়ারিতে! তবে তিন মাসে কীভাবে তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করা যায়, সেটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ভলান্টিয়ার থাকতে হবে অন্তত ২০-৩০ হাজার এবং সময় লাগবে কমপক্ষে তিন মাস। এছাড়া আরেকটি সমস্যা হতে পারে ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ক্ষেত্রে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ অনেক কমে যেতে পারে। একটা এলাকায় সংক্রমণ খুব কমে গেলে সেখানে ভ্যাকসিনের ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা সম্ভব নয়। এমনটি ঘটেছে চীন যুক্তরাজ্যে। আর কারণেই তারা তাদের ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে অন্যান্য দেশে। এমন ঘটনা ঘটলে গ্লোব অবশ্য ভারতে তাদের ট্রায়াল চালাতে পারে। এটা অবশ্য একটা অনুমান মাত্র।

যে কারণে হঠাৎ করে বন্ধ হয়েছিল অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ট্রায়াল!

হঠাৎ করেই সেপ্টেম্বর অ্যাস্ট্রাজেনিকা তাদের অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির তিনটি দেশে পরিচালিত ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সব কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করে। কারণ যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের মধ্যে একজন হঠাৎ মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কারণ অনুসন্ধান চালানোর জন্য তাদেরকে ট্রায়াল বন্ধ রাখতে হবে।

সেপ্টেম্বরের নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জানা যায়, ওই মারাত্মকভাবে অসুস্থ ভ্যাকসিন গ্রহীতা আসলে ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিসে আক্রান্ত। এটা এক ধরনের মারাত্মক স্পাইনাল কর্ড বা মেরুরজ্জুর প্রদাহজনিত সমস্যা। ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিস বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাস ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে। অসুখটা তীব্র এবং মারাত্মক হলেও স্টেরয়েড চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ১৭ হাজার ভ্যাকসিন গ্রহীতার ভেতরে এই প্রথম দেখা দিল। পরে নিরপেক্ষ সেফটি কমিটির তদন্তে দেখা যায় যে ওই ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিসের সঙ্গে ভ্যাকসিনটির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল আবার শুরু হয়েছে।

যথাযথ ফেইজ- ট্রায়াল ছাড়া নতুন ভ্যাকসিন বিপজ্জনক

তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের একদম শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন থমকে দাঁড়িয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে! কারণেই একটা নিরাপদ ভ্যাকসিন উৎপাদনে বড় পরিসরে ফেইজ- ট্রায়াল খুবই জরুরি। অনিরাপদ ভ্যাকসিন ভালোর চেয়ে ক্ষতিই করে বেশি। ভ্যাকসিনে ব্যবহার করা হয় জীবাণু, জিন অথবা প্রোটিন। এগুলো সবই জৈবিকভাবে সক্রিয়, যা পরীক্ষা করে না ব্যবহার করলে শরীরে গিয়ে নতুন রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

অতীতে দেখা গেছে তড়িঘড়ি করে উৎপাদিত কিছু পোলিও ভ্যাকসিন প্রায় ৭০ হাজার শিশুর শরীরে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল এবং এতে অনেক শিশু মারাও গিয়েছিল। এত কিছুর পরেও দেখা যাচ্ছে বিলিয়ন ডলারের বাজার ধরতে রাশিয়া বা চীন রিসার্চ এথিক্স এবং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই কোনো প্রকার ফেইজ- ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়াই অপরীক্ষিত ভ্যাকসিন প্রয়োগ করছে তাদের সাধারণ মানুষের ওপর। নিজ দেশের নিরীহ মানুষগুলোকে বানাচ্ছে গিনিপিগ! এভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগে কোনো প্রকার দুর্ঘটনা ঘটলে তা মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে গোটা টিকাদান কর্মসূচির ওপর। সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে ভ্যাকসিনের ওপর। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা সবাই একটি নিরাপদ ভ্যাকসিন চাই। তবে সেই ভ্যাকসিনটিকে আসতে হবে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নিয়মতান্ত্রিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্য দিয়েই। [শেষ]

 

ডা. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট

শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন