স্মৃতি সতত: সুখের

‘খুকি, কামাল তোদের প্রাণহরা গুলির শব্দও আমি শুনেছি’

শামীম আজাদ ও সেলিম জাহান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে স্মৃতিচারণা (পর্ব-পাঁচ) 

শামীম আজাদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছের পদার্পণ উপলক্ষে আমি আর সেলিম যে স্মৃতিচারণ করেছি সেখানে আজ আমরা কথা বলবো শেখ কামাল এবং সুলতানা আহমেদ খুকিকে নিয়ে। আজ ১৫ আগস্ট (পাঠক, স্মৃতিচারণটা ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল)। এর আগে এ দিন উপলক্ষে আমাদের দুজনের কেউই কখনো এভাবে কথা বলতে আসিনি। আমরা যারা ঊনসত্তুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলাম, আমরা সতীর্থ হিসেবে কামাল এবং খুকিকে পেয়েছিলাম। ১৫ আগস্ট আমাদের জাতির বিশাল ব্যর্থতার দিন। আমরা যে শুধু বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি তা নয়, একইসঙ্গে আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় দুই বন্ধু শেখ কামাল এবং সুলতানা আহমেদ খুকিকে সেই কালরাত্রিতে হারিয়েছি। আজ আমরা আমাদের হারানো বন্ধুদের কথাই বলবো। এ প্রসঙ্গ এবং এর প্রেক্ষাপট এত এত বিশাল যে, সব কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা সব বিষয়ের দিকে না গিয়ে বরং আমাদের বন্ধু কামাল এবং খুকি কেমন ছিল এগুলো বলব। সেলিমের নিজের কিছু স্মৃতি আছে, আমার নিজের কিছু স্মৃতি আছে এবং আমাদের অন্য বন্ধুরাও তাদের কিছু স্মৃতি আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে। আমরা আজ সে সব স্মৃতিগুলো নিয়েই কথা বলবো

সেলিম জাহান: আজ জাতীয় শোক দিবস। আমার মনে হয়ে এই স্মৃতিচারণা এবং শোকের তিনটি প্রেক্ষিত আছে। এক. সমস্ত বাঙালি সবার সঙ্গে শোকের বহিঃপ্রকাশ করছি আমি এবং শামীম। দুই. বঙ্গবন্ধুর যে বৃহত্তর পরিবার তাদের অনেকের সঙ্গেই আমাদের চেনা-জানা পরিচয় ছিল। যেমন আমি আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে পারিবারিকভাবে চিনতাম আমার পিতৃবন্ধু হিসাবে। শামীম তেমন প্রয়াত শেখ জামালের স্ত্রী রোজিকে চিনতো। তিন. সব থেকে কষ্টের এবং দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা ওই কালরাত্রিতে আমাদের দুজন প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছি; শেখ কামাল এবং সুলতানা কামাল খুকি। 

শামীম আজাদ: আজকে আমাদের যে বন্ধুরা আমাদের কথা শুনছে তাদের প্রত্যেকেরই বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে।  কান্নায় দুমড়ে-মুচড়ে উঠছে। কামাল ও খুকি আমাদের বন্ধু ছিল। এরা সাধারণ ছেলে মেয়েদের মত হাসি ঠাট্টা করত। আড্ডা দিত। গল্প করতো। দেশের প্রতি জাতির প্রতি তাদের নিজস্ব কিছু প্রতিজ্ঞা ছিল। ওদের দুজনেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ভালো অবস্থান ছিল। 

সেলিম জাহান: নিশ্চয়ই। আমরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার ওই কালরাত্রি আমাদের জীবন, বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়া, আমাদের সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্য সবকিছেুর উপর এক ধরনের প্রভাব  ফেলেছে এবং  সে  প্রভাব পড়েছে এ কারণে, যে গণতান্ত্রিক ধারা, যে সামাজিক ন্যায্যতা, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির কথা বলে বঙ্গবন্ধু আমাদের সামনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন আমরা  তো তাকে সেই সময়েটুকু দেইনি।

শামীম আজাদ:  বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যখন আমরা চিন্তা করি একটা দেশ এত শোষণের পর এত বড় একটা লড়াইয়ের পর দেশটাকে গোছাতে তো বেশ খানিকটা সময়ে লাগে, দেশ সংস্কারে বঙ্গবন্ধু  সেরকম কোন সময় পাননি। 

সেলিম জাহান: একেবারেই সময় পাননি। রীতিমতো ছাইয়ের কুন্ডলীর মধ্যে বাংলাদেশ। সবদিকে শুধু ধ্বংস। বঙ্গবন্ধু তখন পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠন দিয়ে শুরু করেছিলেন। উন্নয়ন কর্মকান্ড করার সুযোগ তার ঘটেনি। 

শামীম আজাদ: ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবার এবং বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বাংলাদেশ থেকে দুটো জিনিস বোধ হয় আমরা চিরতরে হারিয়ে  ফেলেছি। একটা হচ্ছে সমাজতন্ত্র অন্যটা ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধুর  নেতৃত্বের কারণে সারাবিশ্বে কিন্তু আমাদের একটা ভালো অবস্থান ছিল। বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখলে যে কোন বিদেশী তাঁকে চিনতো যে উনি বাংলাদেশের জাতির জনক। ১৯৯০ সালের দিকে, তখন আমি ইংলান্ডে এসেছি। একটা ঘটনার কথা বলছি। একদিন টিউবে করে আমি বাসায় ফিরছি। আমার হাতে একটা বাংলা পত্রিকা। ১৫ আগস্ট উপলক্ষে পত্রিকাটি বের হয়েছে। আমি খেয়াল করলাম, একজন বিদেশী খুব মনোযোগ দিয়ে আমাকে লক্ষ্য করছে। ঠিক নেমে যাওয়োর আগে  সে আমাকে যে কথা বললো আমি তা শুনে এত ছোট এত খাটো কখনো বোধ করিনি। সে যা আমাকে বলেছিল তা বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, ‘তোমরা এমন একটা জাতি, যে তোমাদের জন্ম দিয়েছিল তাকে তোমরা হত্যা করো’। এ কথাটি বলে লোকটি সোজা নেমে গেল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সারা বিশ্বের চোখে জাতি হিসেবে আমরা ছোট হয়ে গেছি। 

সেলিম জাহান: ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। তিনি আসবেন। চারদিকে উৎসব মুখর পরিবেশ। কেননা, স্বাধীনতার পর এই প্রথম বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। আমি তখন দুটো ঘটনার কথা শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন। তখন যেহেতু  দেশ গঠন হচ্ছে, তারা দুজন সবসময়ে একসঙ্গে কাজ করতেন। আমি শুনেছি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে বঙ্গবন্ধুর তিনটি গাড়ি ছিল। মূলত নিরাপত্তার কারণে বিভিন্ন রঙ এর গাড়ি ব্যবহার করা হতো। ১৫ আগস্ট বিকেল বেলা তারা গণভবন থেকে বেরিয়েছেন। গাড়ি আসলো। বঙ্গবন্ধু ড  মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজকেও কালো গাড়ি’! পরবর্তীকালে ফরাসউদ্দিন ভাই বলেছেন, যে সেদিন বঙ্গবন্ধুর একথা শুনে তার কিছেু মনে হয়েনি কিন্তু পরবর্তীতে এ কথাটা তার বুকে  শেলের মত বিঁধেছে। আরেকটি ঘটনা হচ্ছে, সেদিন বিকেলে কিন্তু খন্দকার মোশতাক হাঁসের মাংস রান্না করে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হাঁসের মাংস খেতে ভালোবাসতেন। ওটাই সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর শেষ ভোজন ছিল।

শামীম আজাদ: অনেকেরই ধারণা আসলে সেদিন খন্দকার মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা কিংবা বঙ্গবন্ধু কোন আভাস পেয়েছেন কিনা, তাকে কেউ সতর্ক করে দিয়েছে কিনা অথবা নিরাপত্তা ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন হলো কিনা, এই বার্তাটা খন্দকার মোশতাক তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ৩২ নম্বর গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর দুর্ভাগ্যের কারণ কিন্তু অনেকটা বাংলাদেশকে বেশি ভালোবাসার জন্য,  বাংলার মানুষকে বেশি ভালোবাসার জন্য, এত বেশি বিশ্বাস করার জন্য। কোন দেশের কোন রাষ্ট্রপতি এভাবে অরক্ষিত অবস্থায় থাকেন না। ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়িকে কেউ কিছুতেই বলবে না যে, এটা প্রেসিডেন্টের বাড়ি। ওই বাড়ির সামনে দিয়ে রিকশা চড়ে আমি তখন কত বার যাতায়াত করেছি। দেখতাম উপরে শুধু কয়েকজন সেন্ট্রি রয়েছে। তখন কিন্তু বাংলাদেশে প্রায়ই বিদ্যুৎ চলে যেতো এবং তখন বঙ্গবন্ধুর ওই বাড়িতেও বিদ্যুৎ থাকতো না। কী অদ্ভুত বিষয় না, বঙ্গবন্ধুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল না, আসলে তিনি কোনো আলাদা ব্যবস্থা নেননি। শুধু দেখতাম লেকের অপজিট থেকে বাড়িটার ওপর আলো ফেলে রাখা। ও বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু যেহেতু থাকলেন, তাহলে বাড়িটার চারপাশে একটা নিরাপত্তা বেষ্টনি রাখা খুব দরকার ছিল। 

সেলিম জাহান: সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেশ নিয়ে কথা হয়েছে, তার কারাগারে থাকা সময়ে কথা হয়েছে। ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি যে আপনার সবচাইতে বড় গুণ কী, তাহলে কী বলবেন? বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। তখন ডেভিড ফ্রস্ট আবারো জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি যদি আপনাকে প্রশ্ন করি আপনার সব থেকে বড় দোষ কি? বঙ্গবন্ধু তখন হেসে বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ একটা কথা আমরা প্রায়ই সব ভুলে যাই, আর তা হচ্ছে, তখন বৈশ্বিক যে পরিস্থিতি তা কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না। তেলের দাম বেড়ে গেছে। আফ্রিকাতে, ইথিওপিয়োতে খাদ্য উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর চাপ দিচ্ছে। একটা দুর্ভিক্ষের মত অবস্থা  দেখা দিচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরেও নানা ধরনের বিভাজন বিশেষ করে চরমপন্থিরা নানান ভাবে এই অবস্থার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেছে। 

শামীম আজাদ: আমাদের পরম ভাগ্য এই মানুষটি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমাদের পরম ভাগ্য কামালের মতো, খুকির মতো আমাদের বন্ধু ছিল। তারা সোনার মানুষ। কামাল-খুকি যদি আজ বেঁচে থাকতো তাহলে কামালের হয়েতো একটু ভুঁড়ি হতো, খুকির হয়তো চুলে পাক ধরতো। আমরা প্রত্যেকেই একটা পর্যায়ে পার হয়ে এই জায়গায় এসেছি আমাদের দুই বন্ধুর সে ভাগ্য হয়নি। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তারা চলে গেছে। জাতীয় ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত ক্ষতিও। 

সেলিম জাহান: আমরা সময়ের প্রত্যেকটা সেতু প্রত্যেকটা স্তম্ভ পার হয়ে এসেছি আমাদের বয়েস বেড়েছে কিন্তু দেখো কামাল এবং খুকি সেই বয়েসেই দাঁড়িয়ে  আছে। ওদের বয়েস আর বাড়েনি। কামাল ছাব্বিশে দাঁড়িয়ে, খুকিও সম্ভবত ছাব্বিশে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কখনো বৃদ্ধ হবে না। জরা কখনোই ওদেরকে জয়ে করতে পারবে না।

শামীম আজাদ: সেলিম, তোমার একটা লেখা আছে। লেখাটা এত আন্তরিক। লেখাটা পড়লে চোখ শুকনো রাখা যায় না। জানেন, আমরা যখন ওদের চেহারার কথা মনে করি তখন সেই বয়েসের কামাল ও খুকিকেই দেখতে পাই। আমরা বলতাম যে, আমরা ২৬ বছর বয়েসে বঙ্গবন্ধু দেখতে কেমন ছিলেন তা হয়তো আমরা দেখিনি কিন্তু কামালকে দেখলে মনে হতো বঙ্গবন্ধু ২৬ বছর বয়েসে কেমন ছিলেন আমরা তা চোখের সামনে দেখতে পারছি। 

সেলিম জাহান: আমাদের বন্ধু হাবিব খন্দকার জানালো যে খুকির বয়স ছিল ২৩ বছর। কামাল আমাদের থেকে বয়সে একটু বড় ছিল কারণ বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্ন সময়ে কারাগারে ছিলেন তখন কামালের পড়াশোনা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। স্কুলে কিন্তু তখন সে একটা-দুটো ক্লাস করতে পারেনি।  সে কারণেই বয়েসে ও আমাদের থেকে সামান্য বড় ছিল। আমরা সবাই সতীর্থ তাই বয়সের ফারাক্ আসলেই অপ্রাসঙ্গিক। কামাল আর হাবিব ভীষণ ভালো বন্ধু ছিল। আমার মনে আছে কামালের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ১২ আগস্ট। ১৬ আগস্ট আমাদের অর্থনীতি চতুর্থ পর্বের পরীক্ষা আর ১২ আগস্ট আন্তঃহল বিতর্ক প্রতিযোগিতার সমাপনী। আমি আমাদের প্রাধ্যক্ষকে জানিয়েছি যে, আমার  যেহেতু পরীক্ষার মাত্র ৪ দিন বাকি আছে, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমাদের হলে পক্ষ থেকে আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে ভালো হয়। উনি মোটামুটি নিমরাজি হলেন। কিন্তু কামাল দুপুরের দিকে আমার রুমে আসলো। আমি বললাম, কী হয়েছে?  সে খুব ক্লান্ত লাগছে বলে শুয়ে থাকলো। আমি তাকে বললাম, আমি কিন্তু কাজ করছি, পড়ছি। সে বলল, ‘না আমি  তোকে কোন রকম ভাবে বিরক্ত করবো না।’ কিন্তু সে শুয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরপর জোরে জোরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আহ্.. উহ্... করতে লাগলো। আমি বললাম, কী হয়েছে?  সে সেদিকে কোন মনোযোগ না দিয়ে নিজে নিজেই বলতে শুরু করল, ‘সলিমুল্লাহ হল এবার আর বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জিততে পারলো না। আমাদের এই শিরোপা অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে। সূর্যসেন হলের আফতাব আহমেদরা কত মজা করবে।’  ইত্যাদি কথা বলছে আর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে। শেষে আমি ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বললাম যে, ঠিক আছে আমি যাব। বলামাত্র সে উঠে বসলো। তার ক্লান্ত লাগা নাই হয়ে গেল। সলিমুল্লাহ হল বিতর্ক প্রতিযোগিতা শিরোপা জিতলো। ভীষণ আনন্দ করা হলো। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে একটি বিখ্যাত ছবি আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য চিত্রগ্রাহক আজমল তুলেছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে আমার হাতের শিরোপা, আমি মঞ্চ থেকে শিরোপাটা কামালের হাতে দিচ্ছি। কামাল ঠিক মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে  আছে এবং সে আমাকে ধরে আছে আমি যাতে নিচে না পড়ে যাই। তখন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম হামিদ। তিনিও কয়েকদিন আগে বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। টিএসসি  থেকে বেরিয়ে কামাল আমাকে বলল, ‘চল আমরা চা খেতে যাই। আমরা ম হামিদ ভাইয়ের ওখানে গিয়ে চা খেলাম। এরপর কামাল চলে গেল। কামালের সঙ্গে ওটাই আমার শেষ দেখা। 

শামীম আজাদ: খুকির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কিভাবে হয়েছে বলি। ওদের বাড়ি ছিল বকশিবাজার। আমার বন্ধু বাবলির সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল। ঝোরাসহ ওদের আরও একজন বন্ধু ছিল। আমরা ওদের দলটাকে ত্রিভুজ বলতাম। কারণ এই তিনজন সবসময়ে একসঙ্গে চলাফেরা করত। ঝোরা ও বাবলি মূলত আমাকে খুকির সঙ্গে পরিচয়ে করিয়ে দেয়।

খুকির সঙ্গে আরেকটি কারণে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে তা হচ্ছে সালমার মাধ্যমে। সালমা বাংলাতে পড়তো। ক্রীড়া সম্পাদক ছিল। বাংলা বিভাগে একজনই ক্রীড়াবিদ ছিল সে হচ্ছে সালমা। তো সালমা এবং খুকির যখন খেলা থাকতো তখন সালমা আমাদের বলত তোরা কিন্তু গ্যালারিতে আসবি। আমরা আসলে ছিলাম খুকি আর সালমার চিয়ার্স গার্ল। আমরা একটা দল-ই ছিলাম। ওদের যেদিন খেলা থাকত ওই দিন সাবসিডিয়োরি ক্লাসে গিয়ে সবাইকে বলতাম আজ কিন্তু সালমা এবং খুকির খেলা আছে। রিলে রেসে খুকি ও সালমা একদলের হয়ে অংশ নিতো। আপনারা এখন ভাবতে পারবেন না, আমরা কিন্তু আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথ বলছি। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেয়ে খেলার মাঠে নামছে শর্টস পরে, টি-শার্ট পরে নামছে। খুকির মুখে এক বিন্দু কোনো প্রসাধন নেই। চুলটা টান করে বাঁধা। আমরা হয়েতো কোন একটা আড্ডাতে বসে গল্প করছি। খুকি আসলো। সে কোন একটা জিনিস নিয়ে আসবে এবং সেখানে বসে বাজাতে শুরু করবে। র্যাগ-ডের রাতের কথা মনে আছে।  সে রাতে খুকি আর শ্রাবণী কোথা থেকে একটা টিনের ড্রাম নিয়ে আসলো। মাথায়ে ফ্যাটা বেঁধে সারাক্ষণ খুকি ওটা বাজাতে থাকলো। কথায় আছে না বান্ডেল অব জয়। চিন্তা করতে পারেন, আমাদের বন্ধু কামাল একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। আমাদের বন্ধু কামাল জেনারেল ওসমানীর এডিসি ছিলো। একজন মুক্তিযোদ্ধা, যে কিনা বঙ্গবন্ধুর সন্তান। যুদ্ধের সময় আমার সঙ্গে একদিন কিন্তু কামালের দেখা হয়েছে। আমি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে যাচ্ছি রিক্সায় করে। হঠাৎ দেখলাম কামাল চটের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে। তখন কিন্তু বাজারের ব্যাগে করেই বিভিন্ন জিনিস, অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের কেোছ পৌঁছে  দেয়া হতো। কামাল হয়েতো কোন অপারেশনে এসেছে কিংবা কোন মুক্তিযোদ্ধার কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিচ্ছে। ৩২ নাম্বারের আগে, রাসেল স্কয়ারে আমি ওকে দেখি। আমার রিক্সাটা পার হলো, কামালকে দেখলাম লুঙ্গি পরা। সাধারন একটা চটের ব্যাগ কাঁধে। আমরা এক ঝলক পরস্পরকে দেখলাম। কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কোন কথা বললাম না। তখন আমাদের যারা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের একজন দুজন করে প্রায়ই আমাদের নজরে পড়তো কারণ তখন তো আমাদের বিজয়ে আসন্ন। 

সেলিম জাহান: এবং তারা অনেকেই তখন ঢাকা শহরে ঢুকে পড়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ করার জন্য। বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করা হচ্ছে। যেমন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এ  আক্রমণ করা হলো। 

শামীম আজাদ: আমার মনে হয় কি জানো। একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিসত্তা বিকশিত হওয়ার আগেই চলে গেল।

সেলিম জাহান: একটা কিংবদন্তির মত আমি বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছি যে তখন নাকি বারবার ভারত সরকার থেকে শেখ কামালের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছিল। কিন্তু কামাল সেটা বারবারই অস্বীকার করেছে  যে, সে এটা চায় না। বিষয়টা যখন একেবারে উচ্চতর জায়েগায় পৌঁছে গেছে, সত্যিকার অর্থে আমি শুনেছি যে বিষয়টা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত গেছে। ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন কামালকে নিরাপত্তা দেওয়া দরকার। উদ্বেগের অন্য কারণ ছিল। কেননা কামাল যদি কখনও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তাহলে পাকিস্তানি সরকার এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কামালকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করবে। আমি যতটা শুনেছি কামালের অজান্তেই তাকে এ জাতীয় একটা নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিল। কারণ ভারত সরকার বিষয়টি নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিল।

শামীম আজাদ: এটা হতেই হবে, অথচ দেখো বঙ্গবন্ধু কোন নিরাপত্তার দিকে তাকালেন না। আমার মামা আলী মেহেদী খান বিভিন্ন পোস্টিংয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তাবিষয়ক দায়িত্বের প্রধান হিসেবে কাজ করছিলেন। মামা তখন সোবহানবাগের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন।  আমরা তো জানি যে যখন যে আসতো বঙ্গবন্ধু তখন তাকে খুব আন্তরিকভাবে তুই করে করে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কিরে কেমন আছিস?’ মামা এসে আমার মাকে বলতেন, ‘জানো আনোয়োরা, আমাকে কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো তুই বলে সম্বোধন করেননি। আমাকে বঙ্গবন্ধু বলতেন খান সাহেব আপনি কেমন আছেন? খান সাহেব, চলেন এখন আমরা গাড়িতে উঠবো।’ মামা খুব পড়ূয়া মানুষ ছিলেন। নিভৃতচারী। সাদা পোশাকে বঙ্গবন্ধুর গাড়ির সামনে বসতেন। ১৫ আগস্ট ঘটনাটা ঘটেছে গভীর রাতে। তখন মামা আর ডিউটিতে ছিলেন না।  

সেলিম জাহান:  আচ্ছা শামীম, তখন তো তুমি ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বার বাড়ির কাছোকাছি ছিলে? 

শামীম আজাদ: হ্যাঁ, ধানমন্ডি ২০ নাম্বারে ছিলাম। এর কাছে তখন উইমেন স্পোর্টস কমপ্লেক্স। নতুন করে দেয়াল হয়েছে সবকিছু সাজগোজ হচ্ছে কারণ বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হচ্ছে সুলতানা কামাল খুকি একজন নামজাদা খেলোয়োড়। বঙ্গবন্ধু খুকিকে নিয়ে এসে ওই কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করবেন। এদিকে আবার পরের দিন বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। আমি পরিকল্পনা করেছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে আমি এক দৌড়ে এখানে চলে আসবো যাতে কমপ্লেক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারি। খুকি যখন বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হয়ে গেল একদিন আমার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হলে বলল, ‘এই তুই আসিস না কেন রে। তুই তো মাত্র ২০ নাম্বার রোডে থাকিস। আমি বললাম, খুকি তুইও জানিস এখন তো আর আগের মত না। খুকি মুখটা ম্লান করে হাসলো। কিন্তু আমি জানি ওই বাড়ি এতো অরক্ষিত ছিল যে, আমি চাইলেই যেতে পারতাম। চাইলেই খুকির সঙ্গে দেখা করতে পারতাম। 

আমাদের শোবার ঘরের পেছেনের লেক পার হলেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। ১৫ আগস্ট ভোররাতে হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ। ওই গোলাগুলির শব্দ শুনে মনে হল না যে এটা তোপখানা রোড থেকে আসছে। এখনো মনে আছে আমরা বিছানা থেকে লাফিয়ে নিচে নামলাম। চিন্তা করতে শুরু করলাম কোন দিক থেকে গুলির শব্দ আসছে। আমার ছোট মেয়ে ঈশিতাকে কোলে করে নিয়ে সবাই সঙ্গে সঙ্গে জানালার নিচে বসে পড়লাম। আমাদের ওই বাড়িতে একটা জানলা ছিল যেখান থেকে  আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে শব্দটা ৩২ নম্বর থেকে আসছে। আমরা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হল যেন আমাদের মাথার উপর দিয়ে গুলি যাচ্ছে। এত বছর পরেও এখনো সব স্পষ্ট মনে আছে। একটা  লেখায় আমি বলেছিলাম, ‘খুকি, কামাল তোদের প্রাণহরা গুলির শব্দও আমি শুনেছি।’ আহারে মাত্র ১২ জুলাই ওদের বিয়ে  হয়েছিল আর ১৫ আগস্ট আমরা ওদের হারালাম। 

সেলিম জাহান: সেদিনের ওই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয় উল্লাসের সময় আমি যাতে পড়ে না যাই সেজন্য কামাল আমার হাত ধরেছিল কিন্তু যখন কামালের প্রয়োজন হয়েছে আমরা তার হাত ধরতে পারি নি। বঙ্গবন্ধু চাইছিলেন কামাল ও খুকির বিয়েটা যেন তাড়াতাড়ি হয়। খুব সম্ভবত সেটা ফেব্রুয়ারি মাস, শীতের সময়, সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে। সেদিন সম্ভবত রোববার। আমি গুলিস্তানে সিনেমা দেখতে যাবো কিন্তু নিজের হলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে একবার না গেলে তো খারাপ দেখায় তাই আমি ভেবে রেখেছি যে, অল্প কিছু সময়ে থেকে চলে যাব। ঢুকে শুনলাম গ্যালারির একেবারে উপর  থেকে আমাকে একজন ডাকছে। কাছে গিয়ে দেখলাম কামাল বসে আছে । জিজ্ঞেস করলাম, কিরে এখানে কেন? কামাল বলল, ‘আমার ৮০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা আছে। বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। কামাল তখন আইসস্ক্রিমওয়ালাকে ডাকল। আইসক্রিম খেতে খেতে বলল, ‘আব্বা চাইছেন আমি বিয়ে করি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাকে? কামাল তখন খুকির কথা বলল। শুনে আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। কামাল আরো বলল, ‘আব্বা চাইছেন আমাদের বিয়েটা তাড়াতাড়ি হোক।’  এ ঘটনাটা আমার খুব পরিষ্কার মনে আছে।  তারপর কামাল আমাকে বলল তুই আমার দৌড়টা দেখে যা। আমি নিচে নামলাম। কামাল প্রতিযোগিতায়ে অংশ নিল। ও সম্ভবত প্রথম অথবা দ্বিতীয় হলো। তারপর আমি চলে গেলাম। হয়তো বঙ্গবন্ধুর মনের মধ্যে একটা কিছু ছিল। কেননা তিনি চাইছিলেন কামাল-খুকির বিয়েটা তাড়াতাড়ি হোক। 


শামীম আজাদ: আমরা এখনো যেন ওদের হাত ধরে আছি। আমাদের মাঝেই আমাদের বন্ধুরা বেঁচে আছে।  আমাদের স্বভাবের সঙ্গে ওদের স্বভাবের খুব মিল ছিল। অবশ্য স্বভাবের সঙ্গে মিল না থাকলে বন্ধু হলাম কীভাবে।

সেলিম জাহান: কিছুদিন আগে আমি আমার একটা লেখাতে লিখেছি, বিভিন্ন সময়ে কামাল সম্পর্কে বিভিন্ন রকম অপপ্রচার হয়েছে যে,  সে অর্থ লুট করেছে ইত্যাদি। আমার এখানে একটা প্রশ্ন আছে। বঙ্গবন্ধুর সন্তান রাষ্ট্রপতি সন্তান টাকার যদি তার প্রয়োজন হতো তাহলে পরে তাকে ব্যাংকের লুট করতে যেতে হতো না এমনিতেই টাকা তার কাছে চলে আসত। মাহমুদ হাসান বর্তমানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। মাহমুদ টাঙ্গাইলের কোন একটি সরকারি রেস্ট হাউসে গেছে সেখানে থাকা রেজিস্টারে সে খুঁজে পেয়েছে যে ১৯৭৪ সালের ১৬  ডিসেম্বর একজন অতিথি সেখানে স্বাক্ষর করেছেন। তার নামের পাশে লেখা যে তিনি এক রাত  সেখানে থাকবেন অর্থ্যাৎ ১৬ তারিখ বিকাল চারটার সময়ে ঢুকেছেন এবং খুব সম্ভবত ১৭ তারিখ বিকাল চারটার দিকে  বেরিয়ে  গেছেন। স্বাক্ষরের ঘরে লেখা শেখ কামাল। সেখানে পরিচয়ে আর কিছু লেখা নেই। শুধু লেখা ডিপার্টমেন্ট অব  সোশিয়োলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কামাল কিন্তু সেখানে নিজেকে রাষ্ট্রপতির সন্তান কিংবা বঙ্গবন্ধুর সন্তান এসব পরিচয়  দেননি। এবার যে কথাটি বলবো  সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং যে কথার মাধ্যমে কামালের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। যা হয়েতো আমরা করতাম না, আমি নিজেও হয়েতো করতাম না। ১৭ তারিখ যখন সে ওই রেস্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে যায়ে তখন সে রেজিস্টার এর নিচে লিখে যায়ে ‘ওয়োন কাপ ব্রোকেন’ যার মানে আমি একটি ভেঙেছি। আমার বিশ্বাস কামাল শুধু কাপ ভাঙ্গার কথাই জানায় নি সে ওই কাপের দামও দিয়ে এসেছে। এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যার,  যে একটা কাপ  ভেঙ্গেও জবাবদিহি করে সে মানুষটির কথা বন্ধু হিসেবে আমার খুব মনে হয়।

শামীম আজাদ: ১৯৭৫ সালে হঠাৎ কামাল এসে একদিন বলল বঙ্গবন্ধু চাইছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত আড়াইশো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে যূথবদ্ধ হয়ে একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রূয়ারি' গানটি গাইবে। শুধু তাই নয় এদের কন্ঠ আগে ধারণ করা হবে বিটিভিতে, রেডিওতে। অর্থাৎ রাত বারোটা এক মিনিটে সমস্ত বাংলাদেশ ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি এবং বাংলাদেশে যে যেখানে আছে তারাও তখন ওই সময়ে  দাঁডিয়ে গানটি গাইবেন। চিন্তা করতে পারো, কি পরিমান দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হলে বঙ্গবন্ধু এ ধরনের কথা চিন্তা করতে পারেন। বঙ্গবন্ধু কতটা আধুনিক ছিলেন! এত বছর পর বিদেশে এসে আমি দেখি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের কিভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়।  সে সময়ে সমস্ত ব্রিটেন স্তব্ধ হয়ে  যায়। সবাই এক মিনিট নীরবতা পালন করে। চলমান গাড়িও থেমে যায়। একুশে ফেব্র“য়ারী এ বিষয়টাকে ঘিরে কামাল নেতৃত্ব দিল। রোকেয়া হল থেকে আমরা একদল যাই রিয়ার্সেল দিতে। লুৎফর রহমান স্যার, লতিফ স্যার তখন আমাদের গান শেখাচ্ছেন। একটা নয় আমরা কয়েকটা গান শিখছি। আমরা তখন এতগুলো মানুষ এতগুলো ছেলেমেয়ে কে কখন খাবে, কখন  কোন গাড়িতে ফিরবেÑ পুরোটাই কিন্তু কামাল এবং তার বন্ধুরা সবাই মিলে জোগাড়যন্ত করেছে কিন্তু কখনোই একবারের জন্যও আমাদের মনে হয়েনি ওতো প্রেসিডেন্টের ছেলে, ওর পেছন পেছন তো লোকলস্কর থাকা উচিত। 

সেলিম জাহান: বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কামালের যোগদান এবং সেখানে নেতৃত্ব প্রদানের পাশাপাশি কামাল নাটকে ভালো অভিনয়ও করতো। ম হামিদ ভাইয়ের সঙ্গে নাটকের একটি দৃশ্যে তার অভিনয়ের ছবি আমার কাছে আছে। এছাড়া আন্তঃনাট্য প্রতিযোগিতায় সলিমুল্লাহ হল যখন দ্বিতীয়ে স্থান অধিকার করে কামাল তখন আল মনসুরের  লেখা ‘রোলার’ ও ‘এলএমজি’ নাটকে অভিনয় করেছ। হয়েতো অনেকেরই মনে নেই তখন প্রহসনমূলক একটা নাটক হয়ে ছিল ‘আমি মন্ত্রী হব’  সেটাতেও কামাল অভিনয় করেছে। রাষ্ট্রপ্রধানের পুত্র হয়ে  সে সময়  সে এরকম একটি ব্যঙ্গাত্মক নাটকে অভিনয় করেছে। 

শামীম আজাদ: কামালকে ঘিরে অপ-প্রচার এবং মিথ্যাচারগুলো দাঁড়িয়ে   গেল কেন? কারণ খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় যারা যোগ দিয়েছেন তারা আততায়ীর হাতটা অনেক শক্ত করে ফেলেছিলেন। আর তখন কিন্তু অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনি।

সেলিম জাহান: শামীম তুমি যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে তাকাও তাহলে দেখবে গোয়েবলসের মিথ্যাচার বলে একটা কথা আছে। তা হচ্ছে একটা মিথ্যে কথা যদি তুমি দিনের পর দিন বলতে থাকো এবং সেটার যদি কোনো প্রতিবাদ না হয় তখন এটা সত্য হিসাবে দাড়িয়ে যায়। কামালের ক্ষেত্রেও আমার মনে হয়েছে  ব্যাংকলুটের কথা যারা বলেছেন তারা দিনের পর দিন এই মিথ্যাচার করেছেন। কিন্তু তখন এর কোনো প্রতিবাদ কারো কাছে থেকে আসেনি

শামীম আজাদ: অনেকে আমাদের কিন্তু বলে তোমরা বন্ধুরা কোথায় ছিল। দেখুন আমাদের কেউ কেউ কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে একেবারে যুক্তই ছিলাম না। তাছাড়া দেখুন, এখন আপনারা আমাদের কথা বিশ্বাস করেন কারণ আমরা একটা অবস্থানে আসতে  পেরেছি। ১৯৭৫ এর সময়ে তখন কিন্তু আমাদের এতো পরিচিতি ছিল না। আমরা  তেমন কিছু হইও নি। 

সেলিম জাহান: কামালের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে আসলে বঙ্গবন্ধুর সুনাম ক্ষুণ্ণ করার, ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছিল।  অপপ্রচারের প্রত্যক্ষ শিকার কামাল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর যে বিশ্বাসযোগ্যতা সেটাকে নষ্ট করে দেওয়ার একটা প্রয়াস চালানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে কিংবা তার আগেও এই অপপ্রচারের কিন্তু কোন প্রতিবাদ হয়েনি।

শামীম আজাদ: আততায়ীদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। এতে করে তাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। খুকি সম্পর্কে বলি, আসলে সে অত্যন্ত নরম মনের মানুষ ছিল। চঞ্চল।  সাজ পোশাকের দিকে তার কোন মনোযোগ ছিল না। পাড়াশোনা করত আর খেলার মাঠে যেত। আমাদের চিন্তা করতে হবে নারীদের অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে খুকি একটি মাইলস্টোন রচনা করে গেছে। তাকে দেখে শত শত মেয়ে খেলার মাঠে এসেছে। খুকি অত্যন্ত সাহসী ছিল। দুপুরবেলার দিকে ও রোকেয়া হলে আসতো। সেখানে পুকুরঘাট ছিল। সে পুকুরে একটা নৌকা ছিল। পুকুরে শাপলা ফুটে থাকতো। খুকি আসলে নৌকায় চড়া শাপলা তোলার কাজগুলো হত। খুকি আসলে আমাদের হলে এই মজাগুলো হত। ও মাঝে মাঝে এসে বলত তোরা কে খাস নি বল? কেননা যে খায়নি তার প্রক্সি হয়ে ওর ওই খাবারটা খেতে পারবে। রোকেয়া হলের খাবার আমাদের কারোরই পছেন্দ ছিল না কিন্তু খুকি খুব পছন্দ করত৤

সেলিম জাহান: আমি যদি এভাবে বলি নারী আন্দোলন বা নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে খুকি যা করেছে এক কথায় সেটা ছিল অপূর্ব।  খুকির সঙ্গে আমার মজার একটা ঘটনা আছে। ও কখনো আমাকে নাম ধরে ডাকতো না। আমাকে ফার্স্ট বয়ে বলতো। দেখা হলে দূর থেকে চিৎকার করে বলতে ফার্স্ট বয়। কোন এক ঈদের দিন আমি বন্ধুর বাসা থেকে ফিরছি হঠাৎ শুনি যে রাস্তার ও পাশে পাঁচিলের অপরপ্রান্ত থেকে কে যেন জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকছে, ”এই যে ফার্স্ট বয়”। আমি তাকিয়ে দেখি খুকি। আমি তখনো ওকে আপনি করে বলতাম। আমি বললাম যে কি ব্যাপার, আপনি এখানে। খুকি বলল-এটাই তো আমাদের বাড়ি। আমার কাছে জানতে চাইলো, কোথায় গিয়েছিলেন? আমি বলেছিলাম বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছি। তারপর আমাকে বাড়িতে আসতে বলল। আমি না করাতে ও আমাকে বলল বন্ধুর বাড়িতে গেছেন বলে কি বান্ধবীর বাড়িতে আসতে হবে না! ওটা ছিল রোজার ঈদ। খুকি আমাকে বলল আমাদের এখানে খেয়ে যান, চালের গুঁড়োর রুটি আছে আর হাঁসের মাংস আছে। হাঁসের মাংস শুনে আমি একটু অবাক হয়েছি কারণ আমি যতটুকু জানি যে ঈদে ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে হাঁসের মাংস খুব একটা করে না। হাঁসের মাংস বলে আমি খুব অবাক হলাম। তখন খুকি লাজুক হেঁসে বলল, এটা কামালের খুব পছন্দ। বঙ্গবন্ধুরও কিন্তু হাঁসের মাংস খুব পছন্দ ছিল। আমি বললাম আমার কি উচিত হবে কামালের ভাগেরটা খেয়ে  যাওয়া। মনে আছে খুব রাগ করে খুকি আমাকে একটা কিল দিল। সময়টা ছিল বিকেলবেলা। খুকির সঙ্গে আমার যে খুব বন্ধুত্ব তা নয় কিন্তু খুব যত্ন করে ওর সামনে বসে হাঁসের মাংস আর রুটি দিয়ে আমি খেয়েছিলাম। সেদিন অনেক গল্প করলাম আমরা। তারপর সন্ধ্যা হয়ে আসলো। তখন আমি বললাম আজ যাই। খুকি বললো এদিকে যদি আসেন তাহলে আবার আসবেন। বাড়িতো চিনে গেলেন। ওদিকে আমার আর কখনোই যাওয়া হয়েনি।  কামালেরও  কিন্তু কোন উন্নাসিকতা ছিলনা ।

আসলে আমার মনে হয়ে এই যে এতগুলো বছর কেটে গেল। ৭৫ এ  বঙ্গবন্ধুর চলে যাওয়া, তার পরিবারের সদস্যদের চলে যাওয়া,  আমাদের দুই বন্ধুকে হারানো – এই শোক এই ক্ষত আমাদের জীবনে সব সময় থেকে যাবে। কিন্তু আমি মনে করি এই শোক থেকে শক্তি অর্জন করতে হবে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে এবং সেটা করতে গেলে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, ভাষণ, তিনি যে কথাগুলো বলে গেছেন সেগুলো আমাদের সামনে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। 

শামীম আজাদ: খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছ তুমি। আসলেই শোককে আমাদের শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। আমরা তো এই জায়গাতে পড়ে থাকতে পারি না। আমরা এই গর্তে পড়ে থাকতে পারিনা। আমরা বঙ্গবন্ধুর বংশধর। সেলিম, কি করে বলতো এই  প্রজন্মকে আমরা পরিচর্যা, শুশ্রূষা করতে পারি।

সেলিম জাহান: বাংলাদেশ নিয়ে সবাই একটা হতাশায় ভোগে। যারা হতাশার রোগে ভোগেন এবং যারা এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের ঘোর থেকে বের হতে পারেননি, তাদের উদ্দেশ্যে দুটো কথা বলতে চাই। একটা কথা হচ্ছে সত্তরের নির্বাচনের আগে একটি পোস্টার বেরিয়েছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ এর ডিজাইন করেছিলেন শিল্পী হাশেম খান। সেখানে দেখানো বৈষম্যের বিষয়টি দেখানো হয়েছিল। পাকিস্তানের স্বাস্থ্য খাতে কত ব্যয় হয়ে, কত রাজস্ব তারা পায়, আমরা কত টাকা পাই। সোনার বাংলা শ্মশানে রূপান্তরিত যারা করেছিল তাদের উদ্দেশ্যে আমি লিখেছি, ‘পাকিস্তান পিছিয়ে কেন?’  যারা আমাদেরকে শোষণ করেছে শ্মশানে পরিণত করেছে আজকে কিন্তু সেই পাকিস্তানকে আমরা ছাড়িয়ে গেছি। ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি কিন্তু আমাদের মাথায় রাখা দরকার। আজ বাংলাদেশের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭২ বছর। পাকিস্তানের ৬৫ বছর । আজকে বাংলাদেশের শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩৪, পাকিস্তানের ৬৭। সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছি। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আপনি কি তৃপ্ত ? আমি বলি, না। আমি কারণ না আমি তৃপ্ত নই। কারণ উন্নয়েন হচ্ছে চলমান ব্যাপার, উন্নয়েন হচ্ছে একটা গতিময়তা, তৃপ্তির ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপারটি হচ্ছে যারা একদিন আমাদেরকে শ্মশানে পরিণত করেছিল ২৫ বছর যাবৎ শোষন করেছিল। আজ তাদেরকে আমরা ছাড়িয়ে যেতে পারছি। এই অর্জনকে আপনারা ছোট করে দেখবেন না। এই অর্জনের পেছেনে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তার প্রজ্ঞা, তার ব্যক্তিত্ব সাহায্য করেছে। শামীম তুমি যে প্রশ্ন করলে সে প্রশ্নে আমি সবসময়ে ৭ মার্চের ভাষণের দিকে যাবো। কারণ আমার মনে হয়ে এ ভাষণে একটা অন্য রকমের দিকনির্দেশনা রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ আমি বলে থাকি তিনি এই যে মুক্তি কথাটি ব্যবহার করেছেন সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি ইত্যাদি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলেই যে  এগুলো হবে তা কিন্তু নয় এবং সে দিকেও  তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের দেশ চারটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। চারটি রাষ্ট্রীয়ে নীতি মধ্যে একটা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ কারণ আমাদের অস্তিত্ব সত্ত্বার জন্য সেটা প্রয়োজন। আমরা যে বাঙালি সে বোধ উপলব্ধি আমাদের থাকতে হবে। আমাদের সত্ত্বায় থাকতে হবে। দ্বিতীয়ে হচ্ছে গণতন্ত্র। আমি মনে করি গণতন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু খুব বিস্তৃতভাবে দেখেছেন। শুধু অংশগ্রহণ নয়  তিনি অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। বলেছেন সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা ও ফলাফলের ক্ষেত্রে সমতার কথা। সুতরাং গণতন্ত্রকে তিনি অনেক বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখেছেন। সমাজতন্ত্র নিয়ে আমাদের বামপন্থী বন্ধুদের সঙ্গে অনেক সময়ে তর্কবিতর্ক হয়। সমাজতন্ত্রকে তিনি খুব যান্ত্রিকভাবে দেখেননি আসলে তিনি সমাজতন্ত্রকে দেেেখিছলেন সামাজিক ন্যায্যতা হিসাবে।

শেষ কথা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা সেটাও সমতার সঙ্গে যুক্ত।আমাদের মনে রাখতে হবে যে ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার এবং একটি রাষ্ট্রে ধর্ম জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেকের সমান অধিকার রয়েছে। আজকে আমরা যে অসাম্যের পরিচয়ে দিচ্ছি আমাদের সংখ্যালঘু নাগরিকদের প্রতি; তাদের উচ্ছেদের জন্য, তাদের দাবিয়ে রাখার জন্য যে রকম চেষ্টা করছি এটা কখনই সামাজিক ন্যায্যতার পক্ষে যেতে চায় না। তরুণ সমাজকে মনে রাখতে হবে এই যে আমরা চারটি জাতীয় নীতির কথা বললাম-  সমতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষতা এখানে তাদেরকে ফেরত যেতে হবে। এটা থেকে কিন্তু কোনো রকমের বিচ্যুত হলে চলবে না। 

শামীম আজাদ: ধর্মের নাম করে ১৯৭১ সালে কি পরিমাণ অধর্ম হয়েছে তার প্রমাণ আমরা অনেকে। ধর্মভিত্তিক বিশ্বাসটা অন্তরের। বাইরে হচ্ছে মানব ধর্ম। আর তা পালন করতে আমাদের পরম সহিষ্ণুতা, পরধর্ম সহিষ্ণুতার জায়গায় ফিরে যেতে হবে। সেলিম তুমি যেমন বলো যে, আমি যা ধারণ করে আছি এবং যা আমাকে ধারণ করে আছে সেটা আমার ধর্ম। এর মানে কি ? এটা মানে নিজস্ব মূল্যবোধ। মানুষকে সুশৃংখল করার জন্য কিছু বিধি নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়েছে যেন মানুষরা অতবেশি না ভেবে এই নিয়মগুলো যদি মানে তাহলে সমাজে অনাচার কম হবে, অধর্ম কম হবে। এটা থেকে সরে গিয়ে ধর্মকে এত বেশি কৃত্রিমতায় পর্যবসিত করা হয়েছে যে ধর্ম আসলে রাজনৈতিক ধর্ম হয়ে গেছে। 

সেলিম জাহান: ধর্ম  রাজনীতির একটা উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটি কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে সেই কত বছর আগে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক ও শোষিত।  আমি শোষিত মানুষের পক্ষে। এই যে কথা বঙ্গবন্ধু বলেছেন তাতেই বোঝা যায় যে, তার অবস্থান ছিল অসাম্যের বিরুদ্ধে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর মজ্জায় ছিল। তিনি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। জীবনের বহুবছর কিন্তু তার কারাগারে কেটেছে। এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প মনে পড়ছে। গল্পটি কামালের কাছে শোনা। বঙ্গবন্ধু তখন খুব সম্ভবত কারাগার থেকে বাড়ি ফিরেছেন তখনও বোধহয় শেখ জামাল ও শেখ রেহানার জন্ম হয়নি।  বঙ্গবন্ধু বাড়ি ফেরার পর আমাদের বর্তমান মাননীয়  প্ধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতাকে এতোদিন পর কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করছেন, ’আব্বা কেমন আছেন?” আরো বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করেছেন, বিভিন্ন বিষয় জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু কামাল খুব ইতস্তত করছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না।  সে তখন বড় বোনকে গিয়ে বলেছিল, ‘হাসু আপা তুমি কি তোমার আব্বাকে আজকের জন্য আমাকে একটু আব্বা বলে ডাকতে দিবে?’

শামীম আজাদ: বঙ্গবন্ধু একজন স্নেহশীল পিতা। কিন্তু দেশের জন্য তিনি সব বাদ দিয়ে কাজ করেছেন। আমার বাবা বলতেন, বঙ্গবন্ধু তার অর্ধেক জীবন জেলে কাটিয়েছেন। সেলিম তোমার একটি কথা আছে,  আমি সবসময় তোমার এ কথাটি ধার করে বলি যে, তরুণরা আমাদের ভবিষ্যৎ এটা শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তরুণদের আসলে বর্তমান করে দিতে হবে। আমরা যারা আছি আমাদের এক পা পেছনে যেতে হবে। তরুণদের জন্য জায়গাটা ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা তোমরা অনেক সময় আমাদের বলো যে, আপনারা শুরু করেন আমরা আছি পেছনে। এটা কিন্তু নয়, আমি তরুণদের বলেছি, তোমরা শুরু করো আমরা আছি তোমাদের পেছনে। তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের আর্জি তোমরা বর্তমান হয়ে ওঠো। বঙ্গবন্ধুর সমস্ত দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। ৭ মার্চের বক্তৃতা বারবার শুনলেই তোমরা দেখবে যে পুরোটাই তিনি বলে গেছেন।

সেলিম জাহান: ধর্ম প্রসঙ্গে আমি বলে থাকি যা আমাকে ধারণ করে আছে এবং আমি যেটা ধারণ করে আছি সেটাই আমার ধর্ম। আমি আমার ঐতিহ্য ধারণ করে আছি। আমি আমার পিতা-মাতার দীক্ষা ধারণ করে আছি। আমাকে ধারণ করে আছে আমার ইতিহাস, আমার সাহিত্য-সংস্কৃতি, আমার বিশ্বাস, বিশেষত ধর্মবিশ্বাস বিধাতার প্রতি বিশ্বাস সেটাও এর একটা অঙ্গ। এটাই তরুণদের উদ্দেশ্যে আমি বলছি তরুণদের উদ্যোগী হতে হবে। তাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা আছে এবং আমরা যারা প্রবীণ তাদের তরুণদেরকে জায়েগা করে দিতে হবে। তরুণদের আর ভবিষ্যৎ করে রাখা যাবে না, আমাদের জাতির বর্তমান করে দিতে হবে। শামীমের একটি কবিতা রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। 

জলন্ত শালুক 
পিতা ও জন্মদাতা বাংলার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

এনে দিয়েছিলে এক
সোনার দোয়েল
খোয়াবের খুশবু-মাখা ঋতুর গৌরব
উদ্গত উষার দীর্ঘ সম্ভাবনা
আর প্রপিতামহের স্বপ্নপ্রদাহ সমেত
রক্তবীজে অঙ্কুরিত জলন্ত শালুক।

তারপর পলির জাহাজ ভিড়েছিল
প্লাবণে ও পৈঠায় শঙ্কাহীন
বেঁচেছিল সবজির সকাল আর
দেহবীণে বানানো ভেলায় উঠেছিল
তুমুল তারুণ্য নিয়ে এক রজবের চাঁদ
তারই সাথে পিছলে পড়া
ওমে অগোচরে
মৃত পাপ ও বিষাক্ত পুঁটিমাছ
বীভৎস লটকেছিল
দু-একটা স্খলিত কীটও সেই অবসরে... রয়ে গেছে।

তাই আমি এখন মৃত পিতা ও পাখি কোলে
বসে আছি বেদনার্ত বেফানা
কীটগুলো কৃমি আর
অশ্বডিম্ব সোনার দোয়েল
ঠোঁটের ঠাহরে আর চলা যায় না..


লেখক পরিচিতি

শামীম আজাদ: একজন কবি, লেখক ও গল্পকথক। তিনি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখেন। সত্তরের দশকে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রায়’ শামীম তরফদার নামে প্রবর্তন করেন বাংলাদেশে ফ্যাশন সাংবাদিকতার। যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষায় তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি।

সেলিম জাহান: একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দুয়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন দুই দশক ধরে। ইংরেজি ও বাংলায় তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এক ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক।

শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন