সুভাষ চন্দ্র বোসের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জিন্নাহ

বণিক বার্তা ডেস্ক

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বাধীন অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা খুব কমই ছিল। কারণ সেক্ষেত্রে ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতা অতিক্রম করতে হতো তাকে। অবশ্য সে সুযোগ এলেও অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছা জিন্নাহর ছিল না। তার চেয়ে বরং জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ গঠনেই সংকল্পবদ্ধ ছিলেন তিনি। এমনকি ১৯৪০ সালের জুনে কংগ্রেস সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বসু যখন জিন্নাহকে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখনও তা ফিরিয়ে দেন তিনি। 

‘জিন্নাহ’স পাকিস্তান: ফরমেশন অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অব এ স্টেট’ শীর্ষক বইতে বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে ফারুক আহমেদ দার জানান, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ গঠনের দাবি জানিয়ে ‘লাহোর প্রস্তাব’ নিয়ে অগ্রসর হওয়া শুরু করে মুসলিম লিগ। মুসলিম লিগের এ তোড়জোড়ের পর ন্যাশনাল কংগ্রেস জিন্নাহকে স্বাধীন পাকিস্তান গঠনের দাবি থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছে। বইটিতে এমন বেশকিছু ঘটনার উল্লেখও করেছেন ফারুক আহমেদ দার।

এমন ঘটনা প্রথম দেখা যায় ১৯৪০ সালের জুনে। সে সময় কংগ্রেস সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বসু জিন্নাহকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। বিপরীতে শর্ত ছিল ভারত ভাগের দাবি থেকে সরে আসতে হবে তাকে।

এর কয়েক মাস পর ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল ও ন্যাশনাল কংগ্রেস নেতা সি রাজাগোপালাচারী তো আরো এক ধাপ এগিয়ে প্রস্তাব দেন জিন্নাহকে। তিনি মুসলিম লিগকে কেবল প্রধানমন্ত্রীই নয়, এমনকি তাদের পছন্দ অনুযায়ী মন্ত্রিসভা বাছাইয়ের অধিকার দেয়ার প্রস্তাবও করেন।

১৯৪৭ সালের এপ্রিলে মহাত্মা গান্ধী জিন্নাহর কাছে কেন্দ্রের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। দেশ ভাগে রাজি হলে সর্ব-মুসলিম প্রশাসন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবও দেন তিনি।

ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার সময় ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস ছিল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। গত শতকের বিশের দশক থেকেই তৃণমূল পর্যায়ে শক্ত ভিত তৈরি করে ফেলেছিল দলটি। অবিভক্ত ভারতের সর্বত্রই শাখা ছিল তাদের। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে অখণ্ড ভারতবর্ষ গঠনই ছিল দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্যবাহী দলটির মূলমন্ত্র।

কিন্তু সর্বভারতীয় মুসলিম লিগের ধ্যানধারণা ছিল ভিন্ন। মুসলমানদের জন্য উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি ছিল তাদের। এসব অঞ্চলে মুসলিম লিগের জনসমর্থন ছিল প্রচুর। সেখানকার মুসলিম জনসংখ্যাও ছিল ভারতের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। মুসলিম লিগের যুক্তি ছিল, তাদের প্রস্তাবিত দুই অঞ্চলে মুসলমানরা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ই নয়, বরং তারা সেখানকার স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী। তাই তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা হোক।

১৯৪০ সাল পর্যন্ত মুসলিম লিগ ছিল অভিজাত মুসলমানদের সংগঠন। কিন্তু খুব দ্রুতই তারা জনসমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং ১৯৪৫-৪৬ সালে ভারতের ভবিষ্যত্ নির্ধারণী ভোটের সময় তারা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে।

শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান গঠনের ইস্যুতে জিন্নাহরই জয় হয়। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাগ হয় ভারতবর্ষ। দেশভাগের সময় মুসলমান অধ্যুষিত দুটি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবে ব্যাপক দাঙ্গা লেগে যায়। এতে ১০ লাখের বেশি হিন্দু, মুসলমান ও শিখ প্রাণ হারায়। এছাড়া এ সময় দেখা যায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে শরণার্থীর স্রোত। প্রায় দেড় কোটি মানুষ দেশভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে টানা আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা পার হয়েছিল।

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীদের বর্ণনায় জিন্নাহ ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা মানুষ। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করে, জিন্নাহ মুসলমানদের ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্ত করেছেন। পাকিস্তানের পাঠ্যক্রমেও জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়।

দার তার বইতে লিখেছেন, জিন্নাহ এসব লোভ-লালসার কাছে নতজানু হননি। বরং তিনি তার অবস্থানে অনড় থেকেছেন। তার কাছে মনে হয়েছিল পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনই দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। জিন্নাহকে প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে ব্যর্থ হওয়া কংগ্রেস নেতারা শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তান গঠন ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা তাতে ব্যর্থ হন।

তবে জিন্নাহ কেন ১৯৪৬ সালের ১৬ মে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যকার অচলাবস্থা নিরসনে ব্রিটিশ মন্ত্রীদের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন সেটার ব্যাখ্যা অবশ্য দার ও অন্যরা দেননি। 

বিপরীতে জিন্নাহকে চিহ্নিত করা হয় ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির মূল ব্যক্তি হিসেবে। আয়েশা জালাল, ‘দ্য সোল স্পোকসম্যান : জিন্নাহ, দ্য মুসলিম লিগ অ্যান্ড দ্য ডিমান্ড ফর পাকিস্তানে’ লিখেন, জিন্নাহ সর্বস্তরে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র হতে চেয়েছিলেন। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে তার প্রধান উদ্বেগ ছিল ব্রিটিশদের ভারত ছাড় আন্দোলনের আয়োজনে কোন দল শক্তির কেন্দ্রে থাকবে তা নিয়ে। 

অন্য এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, কংগ্রেসই ভারত ভাগের জোর প্রয়োগ করেছিল, আর জিন্নাহ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। 

জালাল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে যুক্তি দিয়ে বলেন, সেখানে ‘দেশ ভাগ’ ‘পাকিস্তান’—এ শব্দগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, বরং বলা হয় ভারতের উত্তর-পশ্চিমে মুসলিমপ্রধান প্রদেশ এবং উত্তর-পূর্ব পরিণত হবে স্বাধীন রাষ্ট্রে। যেখানে সংবিধান হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত। 

‘দেশ ভাগ’ কিংবা ‘পাকিস্তান’ উল্লেখ না করে স্বাধীন রাষ্ট্রের  স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম সংবিধান দ্বারা কি দেশ ভাগ ও পাকিস্তানের দাবিই কি বোঝানো হয়নি? 

উপসংহারে তিনি বলেন, এটা ছিল মুসলিম লিগের সঙ্গে কংগ্রেসের ক্ষমতা ভাগাভাগি করার অনিচ্ছা, যার ফলাফল ছিল সার্বভৌম পাকিস্তানের সৃষ্টি। আর এর ভিত্তি ছিল পাঞ্জাব ও বাংলাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাগ করা। 

সোল স্পোকসম্যানের বিষয়বস্তুর আলোকে এটা বলা দরকার যে এখানে অনেক ঘটনা এবং অধ্যায়ের দেখা মিলেছে পাকিস্তানের একমাত্র মুখপাত্র হওয়ার পথে জিন্নাহর অপ্রতিরোধ্য প্রচেষ্টার। কংগ্রেসের সর্বভারতের প্রতিনিধি হওয়ার দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ব্রিটিশদের সঙ্গে জিন্নাহর হাত মিলিয়ে কাজ করার কৌশলও এখানে উঠে এসেছে ব্যাপকভাবে। 

এটা কি সেটাই যেখানে তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও ব্রিটিশদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তি কার্যকর হয়েছিল? যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে শত শত বক্তব্য ও বার্তা থেকে কি এটা প্রমাণিত হয় না, যেখানে জিন্নাহ বারবার ব্যাখ্যা করেছেন তিনি ভারত ভাগ করে মুসলিম রাষ্ট্র চান? 

১৯৪০ সালের ২৫ মার্চ এআইএমএলের লাহোর সেশন শেষ হয়, একই দিন জিন্নাহ একটি সংবাদ সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, আমরা নিশ্চিতভাবে ভারত বিভক্তির লক্ষ্যে অবিচল থাকব। আমার মতে, এটা ভারতের মুসলমানদের ভবিষ্যত্ ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

জিন্নাহ যে ভারত ভাগকে দর কষাকষির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন, এ কথাটি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি নিজেও। 


দ্য প্রিন্টে প্রকাশিত ‘জিন্নাহ’ বইয়ের লেখক ইশতিয়াক আহমেদের কলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন