উন্নয়নশীল অর্থনীতি

উৎপাদন না সেবা—প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ কোনটি হওয়া উচিত?

সেলেস্তা মঙ্গা

মহামারী-উত্তর যুগের জন্য যেহেতু বিশ্ব প্রস্তুত হচ্ছে, সেহেতু টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সন্ধান আরো বেশি তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটি অধিক প্রযোজ্য। নতুন প্রযুক্তিগুলো অব্যাহতভাবে ঠিক পণ্যের মতো সেবা উৎপাদিত বাণিজ্যযোগ্য হওয়ার সুযোগ প্রদান করায় কিছু অর্থনীতিবিদ এমনকি বলছেন যে নিম্ন আয়ের অর্থনীতিগুলো একযোগে উন্নয়নের উৎপাদন স্তর (ম্যানুফ্যাকচারিং) এড়াতে পারে এবং সরাসরিভাবে ঐতিহ্যিক কৃষি থেকে সেবার নতুন প্রবৃদ্ধি সিঁড়িতে উঠতে পারে। 

সেবা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নতুন অভীষ্টের প্রতিনিধিত্ব করে বিশ্বাস কিছুটা অভিজ্ঞতালব্ধ গবেষণাগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেসব গবেষণায় দেখানো হয়েছে, উল্লিখিত দেশগুলোয় ২০০০ সাল থেকে শিল্পপণ্যের বাণিজ্যের চেয়ে দ্রুতগতিতে সেবাপণ্যের বাণিজ্য বেড়েছে, বিশেষ করে ২০১১ সাল থেকে এটি আরো বেশি বেড়েছে। কভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক মূল্য নিগড়ের ব্যাহতকরণ কেবল এই বিশ্বাস নতুন করে শক্তিশালী করেছে বৈকি।

অধিকন্তু, ৫জি নেটওয়ার্ক ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো নতুন প্রযুক্তিগুলো সেবা প্রক্রিয়া খণ্ড খণ্ড করছে এবং উচ্চ মজুরি ব্যয়বহুল কর্মকাণ্ড আউটসোর্স করতে নতুন নতুন সম্ভাবনার উন্মোচন করছে। এসব প্রবণতা তথাকথিত থার্ড আনবান্ডলিং চালিত করছে, যার দ্বারা আগের কিছু অবাণিজ্যযোগ্য পণ্য বাণিজ্যযোগ্য হচ্ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি দুটি পারস্পরিক শুল্কযুদ্ধে জড়ানো এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য লক্ষণীয়ভাবে কমে যাওয়ায় অনেকেই সেবাকে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থানচালক বিবেচনা করছে, কারণ সেগুলো সহজেই ডিজিটাইজড হতে পারে।

তবে সেবাচালিত প্রবৃদ্ধিতে এই অন্ধবিশ্বাস একটি বিপজ্জনক মোহ ছাড়া কিছু নয় এবং এর সমর্থনে দেয়া যুক্তিগুলো গভীরভাবে ভ্রমাত্মকও বটে।  

গত দশকজুড়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য-জিডিপি অনুপাতে নিম্নমুখী প্রবণতার বিষয়টি অবশ্যই স্টার্টারদের মাথায় রাখতে হবে। জিওভান্নি ফেডেরিকো আন্তোনিও টেনা-জাঙ্গুইতোর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮০০ সাল থেকে যদিও বিশ্ববাণিজ্য প্রায়ই সাময়িক পশ্চাত্মুখিতায় ভুগেছে, তবে মৌলিক সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী। বাণিজ্য বিশ্বায়নের ভারসাম্য বিশ্বকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে এবং দুটি বিষয় বৈশ্বিক সমৃদ্ধি শান্তির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ হিসেবে আরো অনেকদিন থাকবে।  

দ্বিতীয়ত. সেবা নয়, উৎপাদনই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক চালক থেকে যাবে। এটি সত্য যে হাইটেক উদ্ভাবন ভৌত নতুন ডিজিটাল উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যকার ভেদরেখা অস্পষ্ট করে তুলছে এবং কৃষি, শিল্প সেবা খাতের গতানুগতিক সীমানা বদলে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিতে নতুন উন্নয়ন বিশ্বজুড়ে প্রথানুগ কৃষকদের কৃষিজ শিল্প উৎপাদন সেবার বৈশ্বিক সরবরাহ নিগড়ে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে।

তবে এসব বিষয় পরিবর্তন এই বিষয়টি বদলায় না যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ সন্ধানে শিল্পায়ন এখনো সর্বোচ্চ অবস্থানে নেই। নতুন উদ্ভাবনগুলো ত্বরান্বিত করতে এবং শিল্প উৎপাদনের মূল্য সংযোজিত আধার (কনটেন্ট) চাঙ্গা করতে ডিজিটাল বিপ্লব মূলত নতুন সুযোগ উন্মোচন করছে। জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯১ ২০১৮ সময়পর্বের মধ্যে বৈশ্বিক শিল্প খাতের মূল্য সংযোজনে গড়ে বার্ষিক দশমিক শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, দশমিক শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে কিছুটা বেশি। ফলে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে উৎপাদন খাতের অবদান ১৯৯১ সালের ১৫ দশমিক শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে ১৬ দশমিক শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

তৃতীয়ত. সেবায় বিশ্ববাণিজ্যের বিদ্যমান মূল্য শিল্পপণ্যের কেবল এক-তৃতীয়াংশ, যদিও ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর জিডিপিতে সেবা খাতের অংশ ৭৫ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে তা ৮০ শতাংশ।

বাণিজ্যযোগ্য সেবাগুলোয় উন্নত অর্থনীতিগুলোর কর্মসংস্থানের বৃহত্তর অংশ শিল্প হালনাগাদ প্রক্রিয়া এবং কাঠামোগত রূপান্তরে একটি যৌক্তিক ধাপ মাত্র। এটি তাদের টেকনোলজিক্যাল ফ্রন্টিয়ারের কাছাকাছি হওয়ার এবং প্রধানত আপেক্ষিকভাবে উচ্চদক্ষ শ্রমিক আর্থিক পুঁজির ওপর নির্ভরশীল থাকার বিষয়টিরই প্রতিফলন ঘটায়।

বিপরীতক্রমে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর আপেক্ষিক সুবিধা সস্তা শ্রম এবং টিকে থাকার জন্য দক্ষতা ভিত্তি গঠন না করা ছাড়া কোনোভাবেই উন্নত অর্থনীতিতে প্রচলিত সেবাচালিত প্রবৃদ্ধি অনুকরণ করতে চাওয়াটা তাদের জন্য মোটেই উচিত নয়। বলিভিয়া, বুরুন্ডি থেকে শুরু করে ভুটানের নীতিনির্ধারকরা নিছকই সুইজারল্যান্ডের সেবাচালিত প্রবৃদ্ধি হুবহু অনুকরণের চেষ্টা করার ভুল পরামর্শের শিকার হতে পারেন, কারণ সেগুলোও ভূমিবেষ্টিত দেশ।

এদিকে রোবট মানব শ্রম প্রতিস্থাপন করার কারণে অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতে শিল্পায়ন কম চাকরি-কাজের সুযোগ সৃষ্টি করবে দাবিও অনুমানভিত্তিক। যদিও স্বয়ংক্রিয়তা (অটোমেশন) বিপুলসংখ্যক কাজ বিলোপ করবে, সম্ভবত এটি নতুন শিল্প অধিক দক্ষ কর্মকাণ্ডে চাকরির সুযোগও সৃষ্টি করবে। মূল্য নিগড়ের সঙ্গে যদি আমরা অপ্রত্যক্ষ প্রভাব একবার বিবেচনা করি, তাহলে দেখব যে বৈশ্বিক উৎপাদন খাতে ব্যবহূত রোবটের সম্ভার বৃদ্ধি আসলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে, এটি কাজ ধ্বংস করছে না। এছাড়া প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিস্তারের কারণে বেকারত্ব সৃষ্টি অসমতা বাড়ানোর মতো পরিস্থিতিগুলোর নেতিবাচক প্রভাব কঠোর সরকারি নীতিগুলো (যেমন অন্যভাবে কাজ হারানোদের ক্ষতি পোষাতে অবিকৃতিমূলক করায়ন) দিয়ে মোকাবেলা করা যেতে পারে।

চতুর্থত, অনেক উন্নয়নশীল দেশে সেবার অবস্থান প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস হিসেবে আবির্ভাব হওয়াটা ওইসব অর্থনীতির তুলনামূলক সুবিধার সঙ্গে একীভূত হতে না পারা শিল্পায়নের কৌশলের ব্যর্থতা এবং ঐত্যিহিক কৃষি আপেক্ষিকভাবে অনুৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডের অত্যধিক অনানুষ্ঠানিকীকরণেরই প্রতিফলন ঘটায়। নিম্নদক্ষ সেবাগুলো অনেক মানুষকে অতিদারিদ্র্য এড়াতে সাহায্য করতে পারে বটে, কিন্তু সেগুলো প্রবৃদ্ধি টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের নির্ভরযোগ্য চালক নয়।  

সত্যি বলতে কি, বাণিজ্যযোগ্য ব্যবসায়িক সেবা (আইসিটি, আর্থিক, বীমাসংক্রান্ত, পেশাগত, বিজ্ঞানভিত্তিক, কারিগরি চিকিৎসা প্রভৃতি সেবা) সেবাভিত্তিক বৈশ্বিক একীভূতকরণের সুযোগ প্রদান করতে পারে, কেননা দেশগুলোয় বড় ধরনের মজুরি পার্থক্য-ব্যবধান বিরাজমান। তবে আবারো এটি কেবল তখনই ঘটবে, যখন উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের মানবপুঁজি ভিত্তির উন্নয়ন ঘটাবে এবং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।

একইভাবে প্রাগ্রসর ডিজিটাল উৎপাদন প্রযুক্তিগুলোর আবির্ভাব (রোবটিকস, এআই, এডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং এবং ডাটা অ্যানালিটিকসসহ) টেলিমেডিসিন টেলিরোবটিকসের মতো সেবাগুলোয় নতুন সুযোগ উন্মোচন করছে। কিন্তু এসব কাজের জন্য ব্যাপকভাবে দক্ষ কর্মীরও প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যক্রমে অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সেই ধরনের কর্মী গঠনে ব্যর্থ। এসব সীমাবদ্ধতা-প্রতিবন্ধকতার বাস্তবতায় দুর্বল মানব পুঁজির অর্থনীতিগুলোর জন্য শিল্পায়ন পাশ কাটিয়ে সেবা খাতে অধিক মাত্রায় উত্তরণের পরামর্শ আরো বেশি অনানুষ্ঠানিকীকরণ দারিদ্র্যেরই একটি রেসিপি, দাওয়াই।

দরিদ্র দেশগুলোর জন্য শিল্পায়ন এখনো সফল উন্নয়নের প্রধান রাস্তা। এটি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের একটি প্রতিযোগীসক্ষম অবস্থান নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা সক্ষমতা-সামর্থ্য জোরদার করে। নতুন প্রযুক্তিগুলোও শিল্পায়নে দেরিতে আসাদের পরিবেশসম্মতভাবে টেকসই শিল্প-কারখানা নির্মাণের সুযোগ দেয়। সংক্ষেপে বলা যায়, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির চাবি হিসেবে উৎপাদন খাতের বিলয়বিষয়ক প্রতিবেদনগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাতিল করা উচিত। সন্দেহ নেই যে উচ্চধাপের (হাই-এন্ড) সেবাগুলো তাদের প্রবৃদ্ধির একটি অন্যতম চালক হতে পারে, কিন্তু তার জন্য অবশ্যই বেশ দীর্ঘ একটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।


[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

সেলেস্তা মঙ্গা: ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক; বিশ্বব্যাংকের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন