পর্যালোচনা

পদার্থবিদ্যায় শূন্য!

সুস্মিতা দত্ত

দর্শন, সংগীত, চিত্রকলা, গণিতশূন্যের বিচরণ সর্বত্র। বাদ পড়েনি পদার্থবিদ্যাও। পদার্থবিদ্যার সঙ্গে শূন্যের সম্পৃক্ততা প্রথম পাওয়া যায় তাপগতিবিদ্যায়। চার্লসের (Jacques-Alexandre Charles) সূত্রানুসারে, তাপমাত্রা যত বাড়ানো হয়, গ্যাস তত সম্প্রসারিত হয়; তাপমাত্রা যত কমানো হয়, গ্যাস তত সংকুচিত হয়। একটি বেলুনের উদাহরণ দিয়ে বুঝি: চার্লসের সূত্রানুসারে, তাপমাত্রা কমানোর সঙ্গে সঙ্গে বেলুনটি একটি নির্দিষ্ট হারে ছোট হওয়ার কথা। ১৮৫০-এর দশকে উইলিয়াম থমসন (লর্ড ক্যালভিন) লক্ষ করলেন যে চার্লসের সূত্রে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। বেলুন তো চিরকাল ধরে ছোট হতে পারে না। তত্ত্বীয় দিক থেকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু আছে, যখন গ্যাস একেবারেই কোনো স্থান দখল করে না। গ্যাসের আয়তন যদি তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়, তবে সবচেয়ে কম আয়তন থাকলে সবচেয়ে কম তাপমাত্রাও থাকতে পারে। গ্যাস যেহেতু সীমাহীনভাবে ঠাণ্ডা করা যেতে পারে না, বেলুনও অসীমভাবে সংকুচিত হতে পারে না। তাপমাত্রারও তাহলে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু আছে, যেখান থেকে আর কমতে পারে না। সবচেয়ে কম সম্ভব তাপমাত্রাকেই বলা হয় পরম শূন্য তাপমাত্রা। ক্যালভিনের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রে শূন্য ডিগ্রিই পরম শূন্য। বাস্তবে পরম শূন্যে পৌঁছানো যায় না। আর পরম শূন্যে পৌঁছতে বাধা পেয়েই পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন দ্বার, তাপগতিবিদ্যার উন্মোচন হয়।

তাপগতিবিদ্যা তাপ শক্তির আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। তাপগতিবিদ্যার সূত্রানুসারে, এমন কোনো যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব নয়, যা চিরকালের জন্য কোনো উৎস ছাড়া শক্তি উৎপাদন করে যাবে। পরমাণুর দলবদ্ধ গতি দেখে বস্তুর আচরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আলো কণা নাকি তরঙ্গ, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। পরবর্তী সময়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা আলোকে তরঙ্গ বলে উপসংহার টানেন। উইগল তত্ত্ব (তরঙ্গ তত্ত্ব?) আলোর প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে পারে। বস্তুর অণু কীভাবে আন্দোলিত হয়, তা ব্যাখ্যা করে স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিকস। আলোর ক্ষেত্রে তরঙ্গ যত দ্রুত হবে, কম্পাঙ্ক তত বেশি হবে। আর শক্তিও তত বেশি হবে। আবার কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য তত কম হবে। দুই ব্রিটিশ পদার্থবিদ বের করতে চেষ্টা করলেন, একটি শূন্য গহ্বর কতটুকু আলো নির্গত করে। তারা দেখলেন, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যত ছোট হয়, একটি বস্তু থেকে তত বেশি আলো নির্গত হয়। তাহলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য শূন্য হলে, একটি বস্তু অনন্ত পরিমাণ (!) আলো নির্গত করতে পারে। তাদের মতে, যেকোনো বস্তু প্রতিনিয়ত অসীম পরিমাণ শক্তি নির্গত করছে। সুতরাং শূন্য তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আর অসীম শক্তি সমান হয়ে গেল। এখানেই শেষ নয়।

কোয়ান্টাম তত্ত্বে শূন্য মানে শূন্যস্থানসহ সম্পূর্ণ বিশ্ব, যা অসীম শক্তিতে পূর্ণ: শূন্য-বিন্দু শক্তি। ম্যাক্স প্যাংক দেখালেন যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমার সঙ্গে সঙ্গে শক্তি নির্গমন অসীম হয়ে যায় না, বরং এটি আবার ছোট হতে থাকে। অণু স্পন্দিত হয় শুধু কিছু গ্রহণযোগ্য শক্তির সঙ্গে, যা কোয়ান্টা বলে পরিচিত। আলোর কম্পনের ক্ষেত্রে প্যাংকের ধারণা সত্য ছিল, কিন্তু কোয়ান্টার ধারণা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে না। আলবার্ট আইনস্টাইন দেখালেন, প্রকৃতি সাবলীলভাবে পরিবর্তিত হয় না, এতে আকস্মিকতার ভূমিকা আছে। আইনস্টাইনের মতে, আলো শক্তির মোড়ক হিসেবে থাকে, যাকে ফোটন (আলোকের একক) বলে। আলো কণা নয়, তরঙ্গও নয়, বরং দুটোর যুগ্ম ফল। কোয়ান্টাম তত্ত্বমতে, সবকিছুই আলোর মতো যুগ্মভাবে আছে।

অন্যদিকে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি অনুযায়ী, একটি কণার অবস্থান আর বেগ একসঙ্গে জানা যায় না। কণার অবস্থান সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে জানা মানে এর বেগ সম্পর্কে একেবারে কোনো তথ্যই না জানা। অথবা কণার বেগ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে জানা মানে এর অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকা। একটি সম্পর্কে কিছু জানলে অন্যটি সম্পর্কে কিছু অনিশ্চয়তা থাকবেই। নীতি পৃথিবীর কেন্দ্রে যেমন সত্য, তেমনি মহাকাশের শূন্যগর্ভের ক্ষেত্রেও সত্য। শূন্যগর্ভে কিছুই থাকার কথা নয়; কণা, আলো কিছুই নয়। তাহলে শূন্যগর্ভে কোনো শক্তি থাকারও কথা নয়।

শূন্যগর্ভ, যেখানে কিনা কিছুই নেই, এর কীভাবে কোনো শক্তি থাকতে পারে? প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E=mc2 থেকে, যা ভর শক্তিকে সম্পর্কযুক্ত করে (কোনো বস্তুর ভর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির সমান) শূন্যগর্ভে শক্তির ওঠানামা আর ভরের পরিমাণের ওঠানামা একই বিষয়। শূন্যগর্ভ কখনো সত্যিকারভাবে শূন্য নয়, বরং কণার নিয়ত সৃষ্টি আর ধ্বংস (দৃশ্যমান হওয়া এবং অদৃশ্য হয়ে যাওয়া) এটি শূন্য-বিন্দু শক্তি, যা কোয়ান্টাম তত্ত্বে অনন্ত বলে ধরা হয়।

কোনো কোনো বিজ্ঞানী শূন্য-বিন্দু শক্তিকে গুরুত্ব দিতেন না, যদিও তারা জানতেন এটি অসীম। ১৯৪৮ সালে দুজন ডাচ পদার্থবিদ কাসিমির (B.B. Casimir) পল্ডার (Dik Polder) উপলব্ধি করলেন যে শূন্য-বিন্দু শক্তিকে সবসময় অবজ্ঞা করা যায় না। কাসিমির অনুধাবন করলেন যে তিনি শূন্যের শক্তিকে অনুভব করছেন। গিটারের একটি নির্দিষ্ট আকারের তারে সব ধরনের সুর বাজে না; কিছু তরঙ্গ লুপ্ত হয়ে যায়। যেহেতু কণা সৃষ্টি হচ্ছে আর উবে যাচ্ছে, লুপ্ত হওয়া কণাতরঙ্গ (গিটারের ক্ষেত্রে সুর) শূন্যগর্ভের শূন্য-বিন্দু শক্তিকে প্রভাবিত করে। মনে করি, দুটি ধাতব খণ্ড কাছাকাছি রাখা আছে। কিছু কণা খণ্ডদ্বয়ের মাঝে রাখা হলো না। তাহলে খণ্ডের বাইরের দিকে কণার পরিমাণ বেশি হবে। বাইরের কণাগুলো যে চাপ দেয়, ভেতরে তার পরিপূরক নেই, ফলে খণ্ডদ্বয় একসঙ্গে পিষ্ট হয়, এমনকি শূন্যগর্ভেও। এটাই শূন্যের বল, যা কোনো কিছু দ্বারাই উত্পন্ন হয়নি। এটাকে বলে কাসিমির প্রভাব।

শূন্য আরেকটি আধুনিক তত্ত্বআপেক্ষিকতার তত্ত্বতেও আপাতবিরোধ তৈরি করেছে: কৃষ্ণগহ্বরের অসীম শূন্যতা। কোয়ান্টাম মেকানিকসের মতো আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্মও আলোকবিদ্যায়। আইনস্টাইন দেখলেন, আলোর গতি সব দিকে সমান। তা কীভাবে হতে পারে?

তিনি দুটি অনুমানের ওপর নির্ভর করলেন: () যদি মানুষ একই ঘটমান বিষয় দেখে, পদার্থবিদ্যার সূত্র সবার জন্য সমান হবে, () মানুষ যেকোনো গতিতেই ভ্রমণ করুক না কেন, প্রত্যেকে শূন্যে আলোর গতি সম্পর্কে একমত হবে। এই অনুমানগুলো পদার্থবিদদের আগের অনুমানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কাক যদি ফোটনের মতো আচরণ করে তাহলে রেলগাড়ি থেকে দেখা মানুষ আর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুজনেই কাকের গতি কেমন, সম্পর্কে সম্মত হবে। তবে কাক কখন গাছকে স্পর্শ করবে, সেটাতে একমত হবে না। এর কারণ, সময়ের পরিবর্তন পর্যবেক্ষকের গতির ওপর ভিত্তি করে। ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা কারো ১০ সেকেন্ড মনে হলে রেলগাড়িতে থাকলে মনে হবে সেকেন্ড। তবে একটা সম্ভাব্য সমস্যা ছিল: শূন্য।

কোনো মহাকাশযান যদি আলোর গতিতে চলত, তাহলে যানে ঘড়ির প্রতিটি স্পন্দন পৃথিবীতে অসীম সময়ের সমান হতো। একজন নভোচারীর জন্য সময় থমকে যায়। সৌভাগ্যক্রমে, মহাকাশযান যত দ্রুতই চলুক না কেন, আলোর সমান গতিতে চলতে পারে না। কারণ মহাকাশযান যত দ্রুত এগোয়, সময় তত মন্থর হতে থাকে, আর একই সঙ্গে যানের ভরও বাড়তে থাকে। ভর বাড়ার কারণে এটি আলোর গতির সমান গতি পায় না। প্রকৃতি নিজেই নিজেকে অবাধ্য শূন্যের থেকে রক্ষা করেছে।

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সমাধান দেয় চূড়ান্ত শূন্য আর তাদের অসীমতার। আইনস্টাইনের সমীকরণ সময় স্থানকে একই বিষয়ের দুটি দিক বলে ধরে নেয়। এই তত্ত্ব কৃষ্ণগহ্বরের পূর্বাভাসও দিয়েছিল। কৃষ্ণগহ্বর এমন একটি তারা, যার ঘনত্ব এত বেশি যে সেটা থেকে কোনো কিছু বের হতে পারে না, এমনকি আলোও নয়।

কৃষ্ণগহ্বর অন্য তারার মতোই (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে) হাইড্রোজেন গ্যাসের একটি বড় বল, যা তার নিজের অভিকর্ষ বলের ভারে পিষ্ট হয়ে একটি ক্ষুদ্র পিণ্ডে পরিণত হয়। পাউলি বর্জন নীতি (Pauli exclusion principle) কোনো বস্তুর নিজেকে একটি বিন্দুতে নিষ্পেষিত হতে বাধা দেয়। এই নীতি অনুযায়ী, দুটি জিনিস একই সময়ে একই জায়গায় থাকতে পারে না। একটি কোয়ান্টাম অবস্থার দুটি ইলেকট্রন একই জায়গায় রাখতে বল প্রয়োগ করা যায় না। ১৯৩৩ সালে ভারতীয় পদার্থবিদ সুভ্রমন্য চন্দ্রশেখর (Subrahmanyan Chandrasekhar) উপলব্ধি করলেন যে অভিকর্ষের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য পাউলি বর্জন নীতির শুধু সীমিত সক্ষমতা আছে। চাপ যত বাড়তে থাকবে, বর্জননীতি অনুসারে, ভেতরের ইলেকট্রনগুলো একটি আরেকটিকে এড়ানোর জন্য তত দ্রুত ঘুরতে থাকে। কিন্তু ঘোরার গতির সীমাবদ্ধতা আছে। আলোর গতিতে ঘুরতে পারে না। ফলে যথেষ্ট চাপ দিলে বস্তুর বিনষ্ট হওয়া রোখার মতো দ্রুতগতিতে ইলেকট্রন ঘুরতে পারে না। চন্দ্রশেখর দেখান যে এসব তারা, যাদের আমাদের সূর্যের চেয়ে দশমিক গুণ বেশি ভর আছে, পাউলি বর্জননীতিকে গ্রাস করার জন্য তাদের যথেষ্ট অভিকর্ষ বল আছে। এই অভিকর্ষ বল এত বেশি যে তারার ইলেকট্রন সংগ্রাম করা ছেড়ে দেয় এবং প্রোটনে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নিউট্রন তৈরি করে, ফলে সৃষ্টি হয় নিউট্রন তারার। ধ্বংসপ্রায় তারার ভর যখন চন্দ্রশেখরের সীমা থেকে আরেকটু বেশি হয়, নিউট্রন আর ইলেকট্রনের চাপ যখন সমান হয়, তখন তারার ঘনত্ব এত বেড়ে যায় যে এক চা চামচ পরিমাণ শত মিলিয়ন টনের সমান হয়ে যায়। কিছুসংখ্যক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর মতে, আরেকটু নিষ্পেষিত হলে কোয়ার্কের সৃষ্টি হয়। যখন অত্যন্ত বিশাল তারা ধ্বংসপ্রায় হয়, তখন এটি উধাও হয়ে যায়। পদার্থবিদদের এমন কোনো বলের কথা জানা নেই, যা সেই নিষ্পেষণ রুখতে পারে। মৃতপ্রায় তারা ছোট হতে হতে শূন্য হয়ে যায় অর্থাৎ শূন্যস্থান দখল করে। এটিই কৃষ্ণগহ্বর, যা এতই আপাতবিরোধী যে কোনো কোনো বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন একে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে এবং বিপরীত সময়ে ভ্রমণ করতে ব্যবহার করা যাবে।

কৃষ্ণগহ্বরের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি স্পেস টাইমকে (স্থান-সময়) বাঁকিয়ে দেয়। কৃষ্ণগহ্বর একটি বিন্দু, এটি শূন্য জায়গা দখল করে। সুতরাং এর কোনো বহির্কিনারা নেই। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে স্থান সমতল হতে পারে। কৃষ্ণগহ্বরের দিকে যত এগোনো যায়, স্থানের বক্রতা তত বাড়তে বাড়তে অসীম হয়ে যায়। কৃষ্ণগহ্বরের শূন্যতা ব্রহ্মাণ্ডের জন্য একটি উন্মুক্ত ক্ষত। শূন্য হলো কৃষ্ণগহ্বরের এককতা (সিঙ্গুলারিটি) আইনস্টাইন এই এককতা নিয়ে এত বিরক্ত ছিলেন যে তিনি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বকে পরবর্তী সময়ে অস্বীকার করেছিলেন। কৃষ্ণগহ্বর থেকে কিছুই বের হতে পারে না, এমনকি আলোও নয়। কৃষ্ণগহ্বরের এককতা দেখার একমাত্র উপায় নিজেকে কৃষ্ণগহ্বরের কাছে সঁপে দেয়া, যেখান থেকে আর কখনো ফেরা যাবে না। যদিও বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের সন্ধান পেয়েছেন, এখনো তাদের কেন্দ্রের শূন্যতাকে ধরতে পারেননি।

কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের শূন্যতা মহাকাশে ভ্রমণ করার কোনো সহজ পথ যদি না- দেখায়, কোয়ান্টাম মেকানিকসের শূন্য একটি অন্য উপায় দেখায়: শূন্য-বিন্দু শক্তি, যা হতে পারে দূরবর্তী তারায় পৌঁছানোর গুপ্ত মন্ত্র। এখানেই মূলধারার পদার্থবিজ্ঞানের সমাপ্তি ঘটে, আর শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের।

শূন্যতার শক্তি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন নেই, কাসিমির প্রভাব তার সাক্ষী। তবুও এমন কি সম্ভব যে শূন্যের শক্তি সবচেয়ে কম সম্ভব শক্তি? যদি তা না হয় তাহলে শূন্যতার ভিতেও থাকতে পারে ভয়ংকরের লুকোচুরি, যা ব্রহ্মাণ্ডকে নিজেকে ধ্বংস করার দিকে ঠেলে দিতে পারে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, উচ্চ শক্তিশালী সংঘর্ষ শূন্যগর্ভেও স্বতঃস্ফূর্ত পতন ঘটাতে পারে। পুথফ বিশ্বাস করতেন যে শূন্য থেকে শক্তি আহরণের একটি পথ তিনি পেয়েছেন। কোয়ান্টাম মেকানিকস সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বানুসারে, শূন্যের ক্ষমতা অসীম কিন্তু আপাতত মনে হয়, শূন্য থেকে কোনো কিছুই আসে না।

সবকিছুর তত্ত্ব আসলে কোনো কিছুরই তত্ত্ব নয়। কৃষ্ণগহ্বরে স্থান আর সময় অর্থহীন হয়ে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিকসেও শূন্য-বিন্দু শক্তির মতো একই সমস্যা দেখা দেয়। কোয়ান্টাম তত্ত্বানুসারে, শূন্যমাত্রিক ইলেকট্রন অসীম ভর অসীম চার্জযুক্ত। কিন্তু শূন্য-বিন্দু শক্তির মতো তারা অসীম ভর চার্জকে মেনে নেননি। শূন্যকে ইচ্ছামতো একটি দূরত্ব ধরলেন। কৃষ্ণগহ্বর, ইলেকট্রন সত্যিকার বস্তু, এগুলো শূন্যমাত্রিক। পদার্থবিদ্যা এমনিতে শূন্যকে অবজ্ঞা করতে পারে না। তবে তারা এগুলোকে আলাদা মাত্রা দিতে পারে। এর থেকেই সৃষ্টি হলো স্ট্রিং তত্ত্ব (তার তত্ত্ব?) এই তত্ত্বানুসারে, কণাকে একটি বিন্দুর বদলে কম্পমান তার হিসেবে ধরা হয়। ইলেকট্রন আর কৃষ্ণগহ্বর যদি তারের মতো একমাত্রিক হয়, তাহলে সাধারণ আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম মেকানিকসে অসীমের ধারণা রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। ফলে ভর আর চার্জও অসীম হয় না। স্ট্রিং তত্ত্বের ফলে শূন্য ব্রহ্মাণ্ড থেকে উধাও হয়ে যায়। শূন্য সময়, শূন্য দূরত্ব বলতে কিছু থাকে না। তবে স্ট্রিং তত্ত্বের সমস্যা হলো, এটি কাজ করতে দশ মাত্রার প্রয়োজন হয়। চার মাত্রার কথা আমরা জানি। তবে দশ মাত্রা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। বাকি ছয় মাত্রা গাণিতিক নির্মাণ ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা সেগুলো দেখতে পাব না। স্ট্রিং তত্ত্বের মাধ্যমে শূন্যকে সরিয়ে ফেলা একটি দার্শনিক ধারণা মাত্র, কোনো  বৈজ্ঞানিক ধারণা নয়। স্ট্রিং তত্ত্ব সত্য হতে পারে; তবে সেটা দেখার জন্য আমাদের কাছে এখনো কিছু নেই।

শূন্য এখনো উধাও হয়ে যায়নি, ঘুরেফিরে আসে বারবার। শূন্য বলতে কি কিছু আছে, নাকি শুধু কল্পনা? যদি কোনো কিছু কল্পনা করা যায়, তাহলে কি আর সেটা শূন্য থাকে? শূন্যতেই কি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি? বিশ্বের শেষও কি শূন্যতেই? এমন অনেক প্রশ্ন বুদ্বুুদের মতো জন্ম নেবে আবার হারিয়ে যাবে; চলতে থাকবে অনেকের গবেষণা। তবে আমরা আজ ইতি টানছি এখানেই।

[*উপরের তথ্য Charles Seife-এর Zero: The Biography of a Dangerous Idea থেকে নেয়া হয়েছে। এখান থেকে আপনারা জানতে পারবেন, কীভাবে হাজার বছর ধরে প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, গণিত, দর্শন আর পদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়ায় শূন্য তার অস্তিত্বের (!) জানান দিচ্ছে। ]

 

সুস্মিতা দত্ত: ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন