মহামারীতে কোরিয়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায় ঘোর আকাল

নভেল করোনাভাইরাস দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়েছে। মহামারীজনিত অর্থনৈতিক স্থবিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেশটির ক্ষুদ্র রিটেইলার, আতিথেয়তা রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা। করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ মোকাবেলায় আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে কোরিয়ার রাজধানী সিউলে আরোপ করা হয় কঠোর লকডাউন। বিধিনিষেধের কারণে রিটেইল শপগুলোয় ক্রেতাদের আনাগোনায় ধস নামে। গ্রাহক-খরায় ভুগতে শুরু করে একসময়ের জমজমাট ক্যাফেগুলো। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দশা এতটাই রুগ্ণ হয়ে পড়েছে যে শেষ পর্যন্ত ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

আসলে কোরিয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রফিট মার্জিন করোনার আগে থেকেই কমতে শুরু করেছিল। দেশটির ক্ষুদ্র আতিথেয়তা খাত আগে থেকেই অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ সেখানে চাহিদার তুলনায় খাতে সেবাদানকারীর সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে পড়েছে। কারণে কয়েক বছর ধরে সরকারের পক্ষ থেকে কোরীয়দের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, যেন তারা নতুন করে আর কোনো ফ্রায়েড চিকেন শপ অথবা ক্যাফে না খোলেন।

সংকট আগে থেকেই ছিল, কিন্তু তাও তো ব্যবসা কোনোমতে চলছিল। করোনা প্রতিরোধে মধ্য আগস্ট থেকে সিউলে খাবারের দোকানগুলোয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করায় সে ব্যবসাও গেছে। সেখানে রাত ৯টার পর রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কফি বেকারি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সেবায়ও বিধিনিষেধের খড়্গ নেমে এসেছে। নতুন স্টার্টআপগুলোর জন্য এতসব বিধিনিষেধ মেনে ব্যবসা করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।

সবার ব্যবসায় যখন মন্দা, তখন সিউলের দক্ষিণের শহর সুউনের ৫৪ বছর বয়সী লিকুইডেশন স্পেশালিস্ট ইউ ইয়ং-সিকের ব্যবসার রীতিমতো রমরমা অবস্থা। অবশ্য এখনকার সফল ব্যবসায়ী ইউকেও একসময় চরম দুর্দিনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সসেজ কারখানা পুরনো ফার্নিচারের দোকানের ব্যবসায় মার খেয়ে তখন তার জেরবার দশা। কিন্তু সেই ব্যর্থতাকে পুঁজি করেই নতুন এক ব্যবসায় নামলেন তিনি। শুরু করলেন লিকুইডেশন ব্যবসা। অর্থাৎ যারা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চান তাদের কাছ থেকে পুরনো মালামাল কিনে নেন তিনি।

ইউ জানান, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন তার ব্যস্ততা অনেক বেশি। ১০ বছর ধরে ব্যবসায় রয়েছেন তিনি। অন্যান্য সময়ের চেয়ে করোনাকালে তার সেবার জন্য কলের সংখ্যা বেড়েছে চার থেকে পাঁচ গুণ। ইউয়ের ভাষ্যমতে, হেয়ার ড্রেসার, বারবিকিউ বুফে অন্যান্য ব্যবসা, যেগুলো মূলত পুরোপুরি হিউম্যান কন্টাক্ট নির্ভর, করোনার কারণে সেগুলোর দশা সবচেয়ে করুণ।

বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র রিটেইল শপগুলো থেকে যে চেয়ার-টেবিল সংগ্রহ করেন ইউ, সেগুলো তিনি বিক্রি করেন রিসাইকেলড কিচেনওয়্যার শপে। সিউলের হোয়াংহাকডংয়ের দাজুব্যাং তাদেরই একটি। কোরিয়ার রিটেইলারদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার চিত্র ফুটে ওঠে দাজুব্যাংয়ের ব্যবস্থাপকের বর্ণনায়—‘২১ হাজার ৩৫০ বর্গফুটের গোডাউন রয়েছে আমাদের। দুই মাস ধরেই পুরোপুরি ভর্তি। ব্যবহূত পণ্যের পাহাড় জমছে। আমরা এগুলো কোনো জায়গায় বিক্রি করতে পারছি না।

এর মাধ্যমে আসলে পুরো কোরিয়ায় পারিবারিক রিটেইল ব্যবসাগুলোর দুর্গতি ফুটে উঠেছে। নীতিনির্ধারকরা যতই দাবি করুন না কেন যে কোরিয়ার খুচরা বিক্রি গত জুন থেকেই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশটিতে ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার হার এত বেড়েছে, যা ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার পর আর দেখা যায়নি। দেশটির পরিসংখ্যান সংস্থা স্ট্যাটিস্টিকস কোরিয়ার উপাত্ত অন্তত সে কথাই বলছে।

এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ায় স্বনির্ভর পেশাজীবীর অনুপাত বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। দেশটির শ্রমবাজারের প্রায় ২৫ শতাংশই ধরনের পেশাজীবী। বেশির ভাগই রিটেইল শপ, আতিথেয়তা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় নিয়োজিত, যেগুলো সাধারণত ক্ষুদ্র পারিবারিক ব্যবসা। করোনা মহামারীর কারণে এসব ব্যবসাই বেশি মার খেয়েছে। অবশ্য এগুলো আগে থেকেই বেশ সংবেদশীল অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংক অব কোরিয়ার ২০১৭ সালের একটি গবেষণা বলছে, তিন বছরে দেশটির মাত্র ৩৮ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসা টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে।

হয়তো কেউ সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তিনি তার অবসর ভাতার অর্থ দিয়ে কোনো ফ্রায়েড চিকেন শপ বা কফি হাউজ খুলেছেন। অনেক বেকার তরুণও চাকরি না পেয়ে নিজের একটি কফি শপ চালু করেছেন। তাদের সবারই লক্ষ্য ছিল আর্থিক স্বনির্ভরতা সচ্ছলতা। কিন্তু তাদের সে লক্ষ্যপূরণে বাদ সেধেছে নভেল করোনাভাইরাস। কারণ ইউয়ের মতো লিকুইডেটরদের কাছে যাদের কল আসছে, তাদের মধ্যে ধরনের ব্যবসায়ীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

করোনা মহামারীর মধ্যে -কমার্সের চাহিদা বেড়েছে। কারণে ক্ষুদ্র রিটেইলাররা গ্রাহক সংকটে ভুগছে। এর সঙ্গে রয়েছে সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া নিম্নতম মজুরি বেড়ে যাওয়ার চাপ, যা প্রেসিডেন্ট মুন জায়-ইন সরকার ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। গত তিন বছরে মুন সরকার নিম্নতম মজুরি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাড়িয়ে ঘণ্টাপ্রতি দশমিক ডলারে উন্নীত করেছে। এছাড়া সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ৫২ ঘণ্টায় সীমিত করা হয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়িয়েছে। একে তো করোনার কারণে বিক্রি প্রায় বন্ধ, তার ওপর খরচ বেড়ে যাওয়াব্যবসা গুটিয়ে নেয়া ছাড়া আর কী- বা করার আছে কোরিয়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের?

রয়টার্স অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন