দর্শন, নীতি ও রাজনীতি: ওয়াইপিএফের আয়োজনে নীতি নির্ধারণীর প্রথম পাঠ

ফিলোসফি, পলিসি এবং পলিটিক্স- নীতি নির্ধারণের এই তিনটি মূল স্তম্ভকে প্রসঙ্গ করে গত ১২ই সেপ্টেম্বর ইয়ুথ পলিসি ফোরাম শুরু করে অনলাইনে ওয়াইপিএফ পলিসি কোর্সের যাত্রা। কোর্সের প্রথমদিনে উন্মুক্ত বক্তৃতার মূল আলোচক ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিষয়ে এমফিল সম্পন্ন করা মুয়াজ জলিল। দেশে ও বিদেশে বাজার ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শদানে প্রায় ১৩ বছর ধরে কাজ করার পাশাপাশি বর্তমানে তিনি ‘এম এন্ড ই’ গ্রুপের প্রধান হিসেবে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন। বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া সহ কাজ করেছেন বিভিন্ন দেশে। এই কোর্সটির উদ্বোধনে অতিথি হিসেবে আলোচনায় যুক্ত ছিলেন ওয়াইপিএফএর দুই উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. আখতার মাহমুদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের  অর্থনীতির শিক্ষক মুশফিক মোবারাক। আলোচনাটির সঞ্চালনায় ছিলেন ওয়াইপিএফ এর পলিসি কোর্সের প্রধান মৌমিতা বসাক।

প্রায় ১ ঘন্টা ২০ মিনিট দীর্ঘ আলোচনায় মুয়াজ জলিল রাজনীতি, দর্শন এবং রাজনৈতিক দর্শনের মূল তাত্ত্বিক বিষয় এবং এদের নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনার ধাপে ধাপে  তিনি তুলে ধরেন রাষ্ট্র ও জাতি রাষ্ট্রের ধারণা,  কেনো আমরা বসবাস করি রাষ্ট্রে এবং জাতি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র ধারণার পার্থক্য। আলোচনায় উঠে আসে হবস, লক ও রুশোর মতো পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের কথা যাদের লেখালেখি এবং আলোচনা বর্তমান পৃথিবীতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার আদর্শিক প্রবর্তক হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক দর্শনের তিনটি প্রধান তত্ত্ব বাস্তববাদ, উদারতাবাদ এবং গঠনবাদের মূল উপজীব্য নিয়ে কথা বলার  মাধ্যমে কোর্সটির প্রথম দিনের আলোচনা শেষ করেন তিনি। 

কেনো ফিলোসফি পড়বো?- এই প্রশ্নটি দিয়েই পাঠের শুরু করেন মুয়াজ জলিল। তার মতে, দর্শন পড়তে হবে আগ্রহের জায়গা থেকে। তিনি নিজে উন্নয়ন অধ্যয়নের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও দর্শন বিষয়ে আহরণ করেছেন বিস্তৃত জ্ঞান। এক্ষেত্রে তিনি, উপমহাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের উদাহরণ টেনে বলেন, “তিনি অর্থনীতির পাশাপাশি দর্শন নিয়ে বেশ কিছু বই প্রকাশ করেছেন এবং হার্ভার্ডে তিনি অর্থনীতির পাশাপাশি দর্শনেরও শিক্ষক ছিলেন।”  দর্শন থেকে  মুয়াজ জলিল ক্রমান্বয়ে আলোচনাকে রাজনীতি ধারণাটির দিকে টেনে আনেন। তার মতে,  দর্শনের কাজ হলো প্রশ্ন করে দেখা, কিন্তু  রাজনীতি ধারণাটির সংজ্ঞা আরো বিস্তৃত হওয়ায় বিভিন্ন একাডেমিক ডিসিপ্লিনে এটি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ করে। তার মতে, কোর্সটির মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পিছনে যেসকল  শর্ত ও উদ্দেশ্য আরোপিত হয়  তাকে কীভাবে দর্শন দিয়ে সমর্থন ও প্রাসঙ্গিক করা যায় সেটা খুঁজে বের করা। 

রাষ্ট্র ও জাতি রাষ্ট্র এ দুটো ধারণাকে  প্রায় সময়ই আমরা  সমার্থক অর্থে ব্যবহার করে থাকলেও দুটোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। রাষ্ট্র হতে হলে সার্বভৌমত্ব এবং ভূখন্ড এই দুটো জিনিসের প্রয়োজন। কিন্তু জাতি রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকল জনগণই একই জাতিভুক্ত হয়ে থাকে। স্টেট অব নেচার বা রাষ্ট্রের প্রকৃতি এই ধারণাটি রাজনৈতিক দর্শনের মৌলিক আলোচনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই ধারণাটি হচ্ছে মূলত কয়েকটি জিজ্ঞাসা। “যখন রাষ্ট্র ছিলোনা তখন মানুষের অবস্থা  কেমন ছিলো? রাষ্ট্রহীন একটি সামাজিক ব্যবস্থায় মানুষ কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতো এবং সেসব সমস্যা দূর করতেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কিনা সেটা যাচাই করা।” থমাস হবস, জন লক এবং জ্যাঁ জ্যাক রুশো ‘স্টেট অব নেচার’ ধারণাটি নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি করেছেন। তারা পারস্পরিক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানব প্রকৃতির আলোকে রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে  তুলে ধরেন,যোগ করেন তিনি।

থমাস হবসের “মানব চরিত্র হচ্ছে নৈরাজ্যপূর্ণ ও বিশৃঙ্খল” এই উক্তিতি পাশ্চাত্য বাস্তববাদের অন্যতম প্রধান কাঠামো। মানব চরিত্রকে স্বার্থপর আখ্যায়িত করে হবস বলেন যে, মানুষের নৈরাজ্যপূর্ণ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে অবশ্যই একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন। মানব চরিত্র সম্পর্কে লকের ধারণা হবসের ধারণা অপেক্ষা আশাবাদী। তিনি মানুষকে নৈরাজ্যবাদী নয় বরং যৌক্তিক সত্ত্বা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে গঠিত হয় না বরং মানুষ নিজেই সংঘবদ্ধ ভাবে প্রথমে সমাজ এবং পরবর্তীতে নিজেদের সর্বাঙ্গীন কল্যানের জন্য রাষ্ট্র গঠন করে। এক্ষেত্রে ফরাসী বিপ্লবকে নিজের লেখালেখির মাধ্যমে ত্বরান্বিত করা দার্শনিক রুশো লকের মতের সঙ্গে মিল রেখে বলে, “মানব চরিত্র আসলেই ভালো।” তবে সভ্যতার চাপে তার এই বৈশিষ্ট্য খর্বিত হয়। কিন্তু মানুষ যেহেতু সহজাতভাবেই ভালো, তাই তাদেরকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের প্রয়োজন। প্রাচীন গ্রীসের গণতন্ত্র এর উদাহরণ এবং বর্তমানে এমন ধ্যান-ধারণা কিছুটা সুইজারল্যান্ডেও প্রচলিত আছে। 

ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিকদের এসকল মতকে কেন্দ্রে করেই পরবর্তীতে গড়ে উঠে বিভিন্ন মতাধর্মী সংগঠনের যাদেরকে সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায় স্কুল বলা হয়ে থাকে। এসকল পাশ্চাত্য ধারনার মধ্যে অন্যতম প্রচলিত তিনটি ধারণা হচ্ছে রিয়ালিস্ট স্কুল বা বাস্তববাদ, লিবারেল স্কুল বা উদারতাবাদ এবং মার্ক্সিস্ট স্কুল বা মার্ক্সবাদ। বিকল্প তত্ত্ব গুলোর মধ্যে আলোচিত তত্ত্ব হচ্ছে কনস্ট্রাকটিভিস্ট স্কুল বা গঠনবাদ।  

হবসের চিন্তার কাছাকাছি বাস্তববাদী দার্শনিকরা মনে করেন, রাষ্ট্র গুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব নয়। তারা সংঘাতে লিপ্ত হবেই। এ কারণেই একটি রাষ্ট্রের “পাওয়ারফুল স্টেট” হওয়া প্রয়োজন যেন কোনো বহিঃশক্তি রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ করতে না পারে। এজন্য স্টেটের ক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে  নজর দেয়া উচিৎ।লিবারেল দার্শনিকেরা বিশ্বাস করেন, অভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলো সহযোগিতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ন সহাবস্থান বজায় রাখতে পারে। তারা রুশোর “মানব চরিত্র যৌক্তিক” এই ধারণাকে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সম্পূরক মনে করেন। 

কিন্তু কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত মার্ক্সবাদী দার্শনিকেরা বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুঁজিবাদীদের একটি অস্ত্র। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সকল কাঠামো কাজ করে শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টিতে। তাই সমাজের বঞ্চিত প্রলেতারিয়েত শ্রেণীকে একত্রিত হয়ে বিপ্লবের মাধম্যে এই শ্রেণীবৈষম্য দূর করতে হবে। 

তাত্ত্বিক আলোচনার পরবর্তীতে মুয়াজ জলিল কথা বলেন রাজনৈতিক ঘটনা বিশ্লেষন নিয়ে। তার মতে, যেকোনো রাজনৈতিক ঘটনা বা পরিস্থিতিকে  তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা উচিত- সিস্টেমেটিক বা পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি, ডোমেস্টিক বা অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইন্ডিভিজুয়াল বা ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। 

আলোচনার শেষে তিনি থ্রিপি নিয়ে আগ্রহীদের জন্য বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রবলেমস অব ফিলোসফি, অমর্ত্য সেনের আইডিয়াস অব জাস্টিস, ফ্রান্সিস ফুকোয়ামার অ্যান্ড অব হিস্ট্রি, থমাস হবসের লেভিয়াথান এবং রুশোর দ্য সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বইগুলো সুপারিশ করেন। 

‘ওয়াইপিএফ  পাবলিক পলিসি  কোর্স’ টি সাজানো হয়েছে হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডসহ বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে নীতি গুলো সাজানো এবং শেখানো  হয় তার আদলে। এই সিরিজটির  মাধ্যমে প্রশিক্ষকেরা শেখাবেন কিভাবে নীতি রূপান্তরের সময়  এবং বিভিন্ন জটিল বাস্তব সমস্যায় বিভিন্ন দেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একাডেমিক থিওরি বা তত্ত্ব ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক নীতি নির্ধারিত হয়েছে। 

পাবলিক পলিসি কোর্সের প্রথম লেকচারটি দেখা যাবে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে। আগামী অক্টোবরের মধ্যেই মুক্তি পাবে পুরো কোর্স। এই কোর্সটিতে ৫০ভাগ আসন ঢাকার বাইরে অবস্থানকারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

মোহাম্মদ সিফাত

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন