কেন মেধাবীরা দেশে ফিরতে চান না?

ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের করা এক জরিপ অনুযায়ী , ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী বাংলাদেশীদের মধ্যে শতকরা ৮২ ভাগেরই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই। কেন মেধাবীরা দেশে ফিরতে চান না? দেশের তরুণ মেধাবীদের দৃষ্টিকোণ থেকে মেধাপাচারকে দেখতেই গত ১০ সেপ্টেম্বর ‘ইয়ুথ পলিসি ফোরাম’-এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘ওয়াইপিএফ ইয়ুথ ইনসাইটস’ শীর্ষক ওয়েবিনার সিরিজের ৩য় পর্ব।

 চৌধুরী নওশিন তাবাসসুমের সঞ্চালনায় এই ওয়েবিনারটিতে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত তরুণ মেধাবী বাংলাদেশীরা। প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী সেশনটিতে কেন মেধাবীরা বিদেশে যেতে বাধ্য হন এবং কেন তারা দেশে ফিরতে অনাগ্রহী, এ নিয়ে তারা তাদের মতামত জানান। পাশাপাশি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে অবস্থার উত্তরণ সম্ভব, তাও আলোচনা করা হয়। 

ওয়েবিনারটিতে অংশগ্রহণকারীদের মতে, মেধাবীদের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার প্রধান কারণ দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগের অপ্রতুলতা এবং বিদ্যমান সুযোগসমূহ জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর না হওয়া। পাশাপাশি তারা মনে করেন দেশে সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব এবং জীবনযাত্রার নিম্নমানও মেধাবীদেরকে এদেশে থাকতে নিরূৎসাহিত করে তোলে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার করুণ অবস্থা উল্লেখ করে তারা বলেন, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে না, পাশাপাশি যথাযথ পরিবেশ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরাও নিজেদের বিষয় নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ পাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এর অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সৌরদীপ পালের মতে দেশের অবকাঠামোগত দূর্বলতাও মেধাবীদের উৎপাদনশীলতার একটি অন্তরায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থাকাকালীন আমাকে মোটামুটি প্রতিদিনই ৪ ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে কাটাতে হতো।

কেন মেধাবীরা দেশে ফিরতে চান না- কারণ হিসেবে পুনরাবৃত্তি হয় জীবনযাত্রার মান এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবের কথা। বিদেশের উন্নত জীবনযাত্রা যেমন মেধাবীদের আকৃষ্ট করে, তেমনি আকৃষ্ট করে সেখানকার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশও। যুক্তরাষ্ট্রের একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী  সাজ্জাদুর রহমান রাফির মতে, বিদেশে কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজের জন্য পাওয়া প্রশংসা কর্মক্ষেত্রকে আরো স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে, অথচ প্রশংসা করার চর্চাটি এদেশে অনুপস্থিত। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কর্মীদের তরুণ সহকর্মীর মতামতকে গুরুত্ব না দেয়ার প্রবণতাও খুবই হতাশাব্যঞ্জক।  অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতার কথা উঠে আসে ব্যারিস্টার ফাহমিদা ফাইজা এবং ব্যাংককে অবস্থানরত ব্যারিস্টার আলভী হাকিমের বক্তব্যে, প্রসঙ্গত ব্যারিস্টার ফাহমিদা ফাইজা বলেন, প্রচলিত ব্যবস্থায় এ ধরণের ত্রুটি থাকায় তরুণ সমাজ কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না, ফলে তারা বিদেশমুখী হচ্ছে। পাশাপাশি সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের ছোট করে দেখা ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বল্প বেতনে চাকরির ব্যাপারটিও তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। সাকিব বাশারের মতে, “বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী আত্মোন্নয়নের সুযোগ না থাকায় মানুষ বাইরে চলে যাচ্ছেন।“ কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির পাবলিক হেলথের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সুতৃষ্ণা নন্দী মনে করেন বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে একজন নারী তার চ্যালেঞ্জসমূহ ও নিরাপত্তার অভাবের কারণেও বিদেশে থেকে যাওয়াতেই অধিক আগ্রহী হতে পারেন। আলোচনায় এদেশে স্বজনপ্রিয়তার মাধ্যমে ক্যারিয়ার তৈরির  অনৈতিক সুযোগের কথাও উঠে আসে। 

যথাযথ সুযোগ-সুবিধা পেলে অধিকাংশ মেধাবীরা দেশে থাকতেই আগ্রহী হবেন- এ বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী তরুণরা একমত। তবে সেজন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আনতে হবে পরিবর্তন। সুমিতের মতে সাশ্রয়ী অথচ দক্ষ শ্রমের চাহিদা বিশ্বব্যাপী হলেও আমরা প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারছি না। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করা হলে তা ফলপ্রসূ হবে। কর্মক্ষেত্রে কর্মঘণ্টার চেয়ে মানসম্পন্ন কাজকে প্রাধান্য দেয়ার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পি এইচডি গবেষক তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, কর্মক্ষেত্রের নীতি বা সহ অবস্থানের মতো ব্যাপারগুলো আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো সম্পূর্ণ ভাবে উপস্থিত না। তবে আমাদের বহির্বিশ্বের দিকে তাকিয়ে শিখতে হবে।

তিনি মনে করেন, মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারি অর্থায়নের ব্যবস্থা কাজে লাগানো যায়, এতে করে মেধাবীরা বিদেশে গিয়ে গুণগত মানের শিক্ষার সুযোগ পাবেন এবং তা কাজে লাগানোর জন্য দেশে ফিরতে বাধ্য থাকবেন। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়ও যদি মানসম্মত জীবনযাত্রার সুযোগ থাকে তাহলে মেধাবীরা দেশে থেকে প্রত্যন্ত এলাকাতেও সেবা প্রদানে আগ্রহী হবেন বলে মনে করেন সুতৃষ্ণা নন্দী। এরই সঙ্গে তিনি গুরুত্বারোপ করেন শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি এবং সেসব সুযোগের কথা জনগণের কাছে পৌঁছানোর ওপরও।

সৌরদীপ পালের বক্তব্যে উঠে আসে দেশের নগর পরিকল্পনার উন্নয়নের আবশ্যকতার কথা। পাশাপাশি তিনি মনে করেন সরকারি চাকরিতে প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাসমূহ বেসরকারি চাকরিতেও নিশ্চিত করা গেলে মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সাজ্জাদুর রহমান মনে করেন কর্মক্ষেত্রে সকলের অন্তর্ভুক্তি, পরমত সহিষ্ণুতার চর্চা এবং মেধাবীদের সৃজনশীল কাজ ও গবেষণার স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণও মেধাবীদের দেশে ফিরতে আগ্রহী করে তুলতে পারে। এছাড়াও তার মতে এজন্য চাকরিক্ষেত্রে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বৈষম্য দুরীকরণও জরুরি।  মেধাবীদের জন্য ন্যায্য ও যথাযথ বেতনের ব্যবস্থা করাকে অধিক গুরুত্ব দেন ফাহমিদা ফাইজা। তার মতে তরুণ মেধাবীদের প্রশংসনীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করলে মেধাবীরা দেশে ফিরতে আগ্রহী হবে, তবে সেজন্য জাতীয় যুব অ্যাওয়ার্ডের ক্যাটাগরি বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া তিনি মনে করেন মেধাপাচার রোধে সফল দেশসমূহ যেমন চীনের মডেল পর্যালোচনা করে এদেশে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা যায়। আলভী হাকিম বলেন, আমাদের প্রজন্মের কাজ হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া যাতে  যে সংগ্রাম আমরা  কর্মক্ষেত্রে  করছি,  সেই একই পরিস্থিতিতে  তারা যেন না পড়ে।। 

মেধাপাচার রোধকল্পে সরকার ইতোমধ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা উঠে এসেছে আলোচনায়। ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে আয়োজিত ওয়েবিনারটির কমেন্ট সেকশনে মাননীয় সাংসদ জনাব শামীম হায়দার পাটোয়ারী সরকারের এমন একটি উদ্য়োগ জানিয়ে মন্তব্য করেন, গতকাল জাতীয় সংসদে পাশকৃত 'ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ কাউন্সিল বিল ২০২০'-এ  প্রবাসী প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল তৈরির কথা রয়েছে- দেশের বাইরে অবস্থানরত মেধাবী বাংলাদেশীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে প্রণীত এটি প্রথম আইন। ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারীরা সরকারি উদ্যোগে হাই-পার্ক স্থাপনকে দেখছেন জনগণের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টির একটি মাধ্যম হিসেবে। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি প্রভৃতিতে বিদেশী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে যে বৈশ্বিক সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে, অংশগ্রহণকারীরা তারও প্রশংসা করেন। সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও বিকাশ- এর ব্লকচেইন রেমিটেন্স সার্ভিসকেও ফলপ্রসূ বলে উল্লেখ করা হয়।

ইয়ুথ পলিসি ফোরামএর ধারাবাহিক ইয়ুথ ইনসাইটস আয়োজনটি মূলত তরুণদের চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরার একটি প্লাটফর্ম। নির্দিষ্ট কোনো একটি বিষয়কে তরুণদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে তার সাপেক্ষে তরুণদের আকাঙ্ক্ষাগুলো নীতিনির্ধারনী পরিবর্তনের আওতায় কীভাবে সংযুক্ত করা যায়, তা-ই পাক্ষিকভাবে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের মূল উপজীব্য। ইয়ুথ পলিসি ফোরামের ফেসবুক পেইজে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।

সুবাহ বিনতে আহসান, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন