শ্রমজীবী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মমত্ববোধ আমাদের প্রেরণার বাতিঘর

মো. আকতারুল ইসলাম

আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি- কথাগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। জাতির পিতা কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষকে আরো বেশি ভালবাসতেন। তিনি আজীবন শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। 

জাতির পিতা যেমন ছিলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তেমনি তিনি ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর’ জন্য ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহান স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু চাকরিজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "আপনি চাকরি করেন আপনার মায়না দেয় ঐ গরীব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়, আমি গাড়ি চলি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন, ওরাই মালিক" শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রতি কতটা টান,কতটা দরদ, কতটা মমত্ববোধ থাকলে একজন রাষ্ট্র নায়ক তাঁর দেশের গরীব শ্রমজীবীদের দেশের মালিক বলে ঘোষণা দিতে পারেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবী মানুষকে নব জাগরণের প্রেরণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “শ্রমিক ভাইয়েরা, আমি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান করেছি। আপনাদের প্রতিনিধি ইনডাস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট, লেবার ডিপার্টমেন্টের শ্রমিক প্রতিনিধি বসে একটা প্লান করতে হবে। সেই প্লান অনুযায়ী কি করে আমরা বাঁচতে পারি তার বন্দোবস্ত করতে হবে”। তিনি বুঝিয়েছেন যে, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ হচ্ছে উৎপাদন, শিল্পোন্নয়ন, তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে নিহিত থাকে দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।  

 ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন- ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন,“বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত, এক দিকে শোষক, আর অন্য দিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে”| শুধু দেশেরই নয়, সারা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে হৃদয়ে শক্তপোক্ত স্থান দিয়েছিলেন বলেই বিশ্ব দরবারেও এমন মর্মভেদী বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি জানতেন শোষিত নিপিড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে সাম্যতা আসবে না।  

মহান স্বাধীনতা লাভের পরেই জাতির পিতা নব প্রণীত সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় সুদৃঢ়করণ করেন। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে: রাষ্টের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশ সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা। ১৫ (খ) অনু্চ্ছেদে কর্ম ও মজুরীর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে: কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিম্চিয়তার অধিকার; যুক্তিসংগত বিশ্রাম বিনোদন ও অবকাশের অধিকার। ৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তি- শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে: সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম; এবং এই বিধান কোনভাবে লংঘিত হইলে আইনত; দন্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। বঙ্গবন্ধু নিখাদ আন্তরিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।   

১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর সদস্যপদ  লাভ করে। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ২২ জুন আইএলসি সম্মেলনে ৬টি কোর-কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে পহেলা মে’কে মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন। এর আগে পাকিস্তানী শাসন-শোষণ থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্য জাতির পিতা ৬ দফা দাবি পেশ করেন, সেখানও তিনি বাংলার শ্রমিক-কর্মচারীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে মুক্তির মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। স্বপ্ন দেখান একটি সোনালি দিনের, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সে প্রত্যাশায় শ্রমজীবী মানুষ উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিকরা আত্মত্যাগের দীক্ষা গ্রহণ করেছে।  

শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে আপন করে নিয়েছেন, সম্মান দিয়েছেন তা ইতিহাসে বিরল। শ্রমজীবীদের তাঁর মমত্ববোধ এ জাতির প্রেরণা, দিক নির্দেশনা তথা প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। এ প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, “জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা আরো উজ্জিবিত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে আমার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

২.

ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে বঙ্গবন্ধুর চেতনা বাস্তবায়নে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পাশে আছি আজ ৪৮ বছর” । দেশের উন্নয়ন, শ্রমজীবী মানুষের  সুযোগ সুবিধা, কল্যাণ, তাদের জীবনমানের কথা বিবেচনা করে এবং অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সকলের সহযোগিতায় বাংলাদেশ শ্রম আইনকে প্রয়োজনের নিরিখে যুগোপযোগী করেছে। সবশেষ ২০১৮ সালে শ্রম আইনের মোট ৮৫ ধারা, উপ-ধারায় সংশোধন করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে  প্রথমবারের মত প্রণিত শ্রমবিধিমালা-২০১৫কে যুগোপযোগি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে।  কারখানায় শ্রমিকরা যাতে অধিকার বঞ্চিত না হয় সেজন্য ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন সহজতর করা হয়েছে। আগে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে যেখানে ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন প্রয়োজন হতো, এখন ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থনে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন দেয়া হয়। প্রতিটি কারখানাকে পরিদর্শনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। পাঁচ হাজারের ওপরে প্রতিষ্ঠান এবং কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার- মাতৃদুগ্ধ কর্ণার নিশ্চিত করা হয়েছে। সব কারখানায় সেইফটি কমিটি গঠন এবং যে কোনো প্রকার বিরোধ নিষ্পত্তিতে সামাজিক সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে। শিল্পসেক্টরে শ্রমিক-মালিক, সরকার ত্রিপক্ষীয় কমিটি কাজ করছে। 

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য সরকার শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল এবং শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল নামে ভিন্ন একটি তহবিল গঠন করেছে। দুটি তহবিল থেকে শ্রমিকের মৃত্যু, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কিংবা তাদের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সহায়তা এ তহবিল থেকে প্রদান করা হচ্ছে। শ্রমিকের পেশাগত রোগের চিকিৎসা, শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য রাজশাহীতে ১৯ বিঘা জমির ওপর ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি ইনস্টিটিউট নির্মাণ করা হচ্ছে। শ্রমিকের  ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণের জন্য ৪২টি খাতের ওয়েজবোর্ড গঠন করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা- এসডিজিকে সামনে রেখে ২০২৫ সালের মধ্যে সকল প্রকার শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।    

চলমান করোনা ভাইরাস সংক্রমনের শুরুতেই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ৩১ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। প্রণোদনা হিসেবে অর্থনৈতিক ও সমাজের বিভিন্ন সেক্টরের মানুষকে সহযোগিতা করতে ১২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে এক বিলিয়ন ডলার বরাদ্দসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করেছেন। করোনা মোকাবিলায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তর শ্রমিকদের জন্য টেলিমেডিসিন সেবা চালু  এবং আইএলও এর সহযোগিতায় কোভিড -১৯ প্রতিরোধে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি গাইডলাইন তৈরি করেছে। 

 জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রুপকল্প-২০৪১ আলোকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গঠনে শিল্পোন্নয়ন এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শ্রমিক-মালিকের সুসম্পর্ক, তাদের অধিকার, পেশাগত নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। দেশের এ সুবিশাল শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের যথাযোগ্য মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার নিশ্চিতকরণ, শোভন কর্মপরিবেশ, শিশুশ্রম নিরসন, ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিক-মালিকের ঐক্যের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী “মুজিববর্ষ-১০০”তে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়াই আমাদের অঙ্গিকার।

লেখক: তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন