ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করছে যা

বণিক বার্তা ডেস্ক

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা পৃথিবী এখন বিপর্যস্ত। মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে ভাইরাসটি। কেবল একটি কার্যকর ভ্যাকসিনই মুহূর্তে আমাদের উদ্ধার করতে পারে চলমান মহামারী থেকে। কিন্তু সেই ভ্যাকসিনের বিকাশ কার্যকারিতা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন সন্দেহ। সপ্তাহজুড়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিকাশমান পর্যায়ে থাকা নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনটি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। প্রথমে সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি  হয় একজন স্বেচ্ছাসেবী অসুস্থ হয়ে পড়লে। সময় ভ্যাকসিনের ট্রায়ালও সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়। যদিও পরে সেটি আবার চালু করা হয়েছে। তবে ইস্যুর কারণে আলোচনায় এসেছে মানুষের ইমিউন সিস্টেমের ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোর বিষয়টি।

আমরা এখনো জানি না ইমিউন-সংক্রান্ত জটিলতা অর্থাৎ ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী এক-দুজনের অসুস্থতা সরাসরি কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিনের সঙ্গে যুক্ত কিনা, কিংবা তাদের প্ল্যাসেবো ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে কিনা।

কিন্তু এটা আমাদের সামনে তুলে ধরে বিভিন্ন মহাদেশজুড়ে হাজারো মানুষের মাঝে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের গুরুত্ব। এর ফলে এমন নয় যে আমরা কেবল ভ্যাকসিন নিরাপদ কিনা তা জানতে পারব, বরং আমরা জানতে পারব এটি কোন বয়সের মানুষের মাঝে এবং বিশেষ স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পন্নদের ক্ষেত্রে কার্যকর।

তাহলে সেই ইমিউন ফ্যাক্টরগুলো কী, যা নির্ধারণ করবে যে বিশ্বব্যাপী ১৮০ কিংবা তারও বেশি কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন উদ্ভাবকদের দ্বারা আবিষ্কারের পথে থাকা ভ্যাকসিন আসলেই কাজ করবে কিনা।

আমাদের ইমিউন প্রতিক্রিয়া একেবারে আলাদা 

একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের সাধারণত যা করা উচিত তা হলো সার্স-কোভ--এর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষিত ইমিউনিটি প্রদান করা, যা কিনা কভিড-১৯-এর কারণ।

এটি হতে পারে অ্যান্টিবডি উৎপাদনের মাধ্যমে, যা কিনা ভাইরাসকে নিউট্রালাইজ করে এবং সম্ভবত ইমিউন সিস্টেমকে মনে রাখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি সংক্রমণের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিক্রিয়াও জানায়।

অন্যান্য ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রুখতে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন থেকে আমরা জানি যে ভ্যাকসিনের প্রতি মানুষের ইমিউন প্রতিক্রিয়া আলাদা হতে পারে। এখানে এটা বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটতে পারে।

ভ্যাকসিনের ধরন

অনেক কভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রার্থী সার্স-কোভ--এর স্পাইক প্রোটিন ধারণ করে। এটি করে সুরক্ষামূলক ইমিউনিটি জাগ্রত করার জন্য। তবে এই প্রোটিনগুলো শরীরে পৌঁছে দেয়ার বেশকিছু ভিন্ন ভিন্ন উপায় রয়েছে। যেখানে কোনো একটি হয়তো ইমিউন সিস্টেমকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে অন্য কোনোটি থেকে অধিক কার্যকর হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন স্পাইক প্রোটিনকে অন্য ভ্যাকসিনের সঙ্গে একীভূত করে। এটি করা হয় সার্স-কোভ--এর ক্রিয়াকে নকল করতে।

অন্যদিকে ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড দ্বারা বিকাশমান ভ্যাকসিন ইমিউন সিস্টেমকে উজ্জীবিত করতে আরেকটি যৌগের (সহায়ক) স্পাইক প্রোটিনকে ধারণ করে।

আবার কোনো কোনো মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দীর্ঘস্থায়ী ইমিউনিটি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরবর্তী সময়ে বুস্টার শটের প্রয়োজন হয়। আবার আমরা অনেক ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে দেখব যে সেগুলো নাকের স্প্রের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। এটি হয়তো কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ওপরের শ্বাসযন্ত্রে (নাক, মুখ গলা এখানে অন্তর্ভুক্ত) আরো অধিক কার্যকর ইমিউন প্রতিক্রিয়া জাগ্রত করতে পারে।

আমাদের পূর্ববর্তী সংক্রমণ

ভ্যাকসিনেশনের আলাদা আলাদা প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে অতীতে সংক্রমণ আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, সার্স-কোভ- ভাইরাস হিউম্যান করোনাভাইরাসের বৃহৎ একটি পরিবার থেকে এসেছে। যার চারটি সাধারণ সর্দিজ্বরের জন্য দায়ী।

সর্দিজ্বর-সংক্রান্ত করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ফলে এবং এর বিরুদ্ধে ইমিউন মেমোরি সেল বিকাশ করার করণে হয়তো কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবে।

কোনো কোনো মানুষের কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ইমিউন প্রতিক্রিয়া দুর্বল থাকে। লোকগুলোর সম্ভবত অ্যাডেনোভাইরাসের প্রতিরোধক্ষমতা বিদ্যমান থাকতে পারে, যা স্পাইক প্রোটিন সরবরাহ করতে কয়েকটি ভ্যাকসিনে ব্যবহূত হয়।

অন্য কথায় বলতে গেলে, তাদের শরীর ভ্যাকসিনের ভুল অংশের ইমিউন প্রতিক্রিয়া জাগায় (সরবরাহ প্রক্রিয়া) এবং ভাইরাসের (স্পাইক প্রোটিন) অংশে অত বেশি নয়।

আমার জেনেটিকস

আমাদের জিন ইমিউন সিস্টেমের কার্যকলাপে বড় একটি ভূমিকা রাখে। গবেষকরা এরই মধ্যে লৈঙ্গিক পার্থক্য লক্ষ করেছেন, যা কিনা ফ্লু ভ্যাকসিনের ইমিউন প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে অংশত জিন দ্বারা চালিত হয়। তারা কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও ইমিউন প্রতিক্রিয়ায় লৈঙ্গিক পার্থক্য লক্ষ করেছেন।

তাই বড় আকারে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পুরুষ নারীদের ক্ষেত্রে কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন ইমিউন প্রতিক্রিয়া কতটা ভিন্ন হতে পারে, তা বুঝতে সাহায্য করতে পারে।

এছাড়া কোনো মানুষের সহজাত ইমিউন ঘাটতি সম্ভবত ভ্যাকসিনেশনের ক্ষেত্রে সুরক্ষিত ইমিউনিটি দেখানোর ক্ষেত্রে অসমর্থ করে তুলতে পারে। 

আমাদের বয়স

আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেমের মিশ্রণটি গোটা জীবত্কাল ধরে পরিবর্তিত হয় এবং ইমিউন প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও এটি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেম এখনো বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে। তাই তাদের ইমিউন প্রতিক্রিয়াও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে ভিন্ন হয়।

কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে কোনো কোনো ভ্যাকসিন দেখা যাবে শিশুদের জন্য অধিক কার্যকর, কিংবা সেগুলো তাদের জন্যই প্রস্তাবিত হবে। যা কিনা আমরা এরই মধ্যে ফ্লু ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে লক্ষ করেছি।

আমাদের বয়স যতই বাড়তে থাকে আমাদের ইমিউন সিস্টেমও পরিবর্তিত হতে থাকে। একপর্যায়ে আমরা ইমিউনিটির ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী কার্যকারিতা দেখাতে পারি না। আমরা সংক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় নতুন অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষেত্রে কম সক্ষম হয়ে পড়ি। 

আমরা এরই মধ্যে জানি যে ফ্লু ভ্যাকসিনের সাহায্যে বয়স্ক মানুষের সুরক্ষামূলক ইমিউন প্রতিক্রিয়া দেখানোর সম্ভাবনা কম।

তাই আমাদের বড় আকারের ট্রায়াল থেকে ডাটা সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেটি মূলত কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন শিশু বয়স্কদের মধ্যে কীভাবে কাজ করে তা যাচাই করার জন্য।

জীবনযাপন পদ্ধতিও ফ্যাক্টর

খাদ্যাভ্যাস, উদ্বেগ, ধূমপানের অভ্যাস ভ্যাকসিনেশনের ক্ষেত্রে আমাদের ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে আবশ্যিকভাবে প্রভাবিত করে। তাই আমরা চাইলে আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে দেখভাল করতে পারি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতির মাধ্যমে।

আবার এখানে এমন হাইপোথিসিসও সামনে এসেছে যে আমাদের গাট মাইক্রোবিয়েস সম্ভবত ভ্যাকসিনেশনের ক্ষেত্রে আমাদের ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। যদিও এখনো বিষয়গুলো নিয়ে আরো অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবেই আমরা পূর্ণাঙ্গ একটা ধারণা পেতে সক্ষম হব।

দ্য কনভারসেশন থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন