নভেল করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটসহ আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সামনের দিনগুলোয় কী ধরনের দক্ষ লোকবল প্রয়োজন হবে, তার একটি প্রাক-নির্বাচনের মাধ্যমে সে অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম, অবকাঠামো এবং শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি শিল্প খাতের চাহিদা অনুযায়ী তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রস্তুত করতে কারিগরি শিক্ষায় আরো বেশি হারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ই-লার্নিং’ শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকরা এমন মতামত ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
ডিসিসিআই আয়োজিত এ ওয়েবিনারে অন্যদের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-উর রশিদ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কারম্যান জেড লামাংনা, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইশতিয়াক আজিম প্রমুখ আলোচক হিসেবে যোগদান করেন।
ওয়েবিনারে আলোচকরা জানান, কভিড-১৯ মহামারী আমাদের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ই-লার্নিং’ পদ্ধতি প্রবর্তনের বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে শিক্ষা কার্যক্রমে এ ব্যবস্থা আরো কার্যকরভাবে চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুর যুগোপযোগীকরণ, স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদানসহ সর্বোপরি শিক্ষানীতিতে ই-লার্নিংকে আরো প্রাধান্য দেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ওয়েবিনারে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, কভিড মহামারী একটি বৈশ্বিক সংকট। যেটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে এবং এ মহামারী শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বর্তমান সময়ে ‘ই-লার্নিং’ অত্যন্ত কার্যকর এবং সামনের দিনগুলোয় এটি আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হবে।
কভিড মহামারী মোকাবেলায় দেশের মানুষ সাহসিকতার পরিচয় দেবে মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ দেশের মানুষ অত্যন্ত প্রযুক্তিবান্ধব। যার কারণে বিশেষ করে শিক্ষা কার্যক্রমে ই-লার্নিংয়ের ব্যবহার বৃদ্ধিতে আমাদের জন্য খুব বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে না।
মন্ত্রী জানান, বর্তমান শিক্ষানীতি ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে। সেটাকে যুগোপযোগীকরণ এবং সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোয় ক্লাসরুমে সরাসরি শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম চালু রাখতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নে ‘ই-লার্নিং’ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা আরো সম্প্রসারণে মানসিকতা একটি বড় বাধা বলে অভিমত ব্যক্ত করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, মেধাবীদের শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসার জন্য এ পেশাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো দক্ষ করে তুলতে হবে। এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আরো বেশি হারে গবেষণা পরিচালনার ওপর জোরারোপ করেন।
ওয়েবিনারে স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সারা বিশ্বে ১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষার জন্য প্রথাগত শিক্ষাদান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ায় নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে ই-লার্নিং নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে এবং ই-লার্নিংকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘ই-লানিং পলিসি’ অন্তর্ভুক্তকরণ, সারা দেশে নির্ভরযোগ্য হাই স্পিড ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স হ্রাসকরণ, ই-লার্নিংয়ের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত স্টার্টআপগুলোকে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া এবং ব্যাংক অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) দেশগুলোয় কারিগরি শিক্ষায় গড় অংশগ্রহণের হার ৪৫ শতাংশের ওপরে। সেখানে বাংলাদেশে ১৫ শতাংশেরও কম। এ অবস্থায় কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং আগ্রহ বৃদ্ধি করতে একে সহজলভ্য করা প্রয়োজন।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাজ্যের ইউনির্ভাসিটি অব সারের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ওসামা খান। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, ই-লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের জন্য ইন্টারনেটের পাশাপাশি রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ও পোস্টাল সার্ভিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেখানে এক্ষেত্রে পাঠ্যসূচির গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কার্যকর মিথস্ক্রিয়া অতিজরুরি।
অধ্যাপক ড. হারুন-উর রশিদ বলেন, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে ই-লার্নিং পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে এবং কভিড মহামারী আমাদের জন্য একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বর্তমানে দেশব্যাপী ২৬০টি কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থা মোকাবেলায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ হাজার শিক্ষকের মধ্যে নির্বাচিত ১ হাজার ৫০০ জন শিক্ষকের মাধ্যমে অনলাইনে ১৭ হাজার ৫০০টি লেকচার দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া শিল্প খাতের চাহিদা মোতাবেক শিগগিরই নয়টি কলেজে ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ কোর্স পরিচালনা করা হবে বলেও জানান তিনি।
অধ্যাপক ড. কারম্যান জেড লামাংনা বলেন, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ই-লার্নিং প্রদানের জন্য অবকাঠামোর দিক দিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। এজন্য তিনি এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোরারোপ করেন।
ড. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা জানান, শিল্প খাতের চাহিদা মোতাবেক শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে এবং কভিড-পরবর্তী সময়ে কীভাবে ই-লার্নিং কার্যক্রম পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে এখনই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে।
ই-লার্নিং কার্যক্রমের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মিথস্ক্রিয়া খুবই জরুরি বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো বেশি হারে দক্ষতা উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক। এ সময় তিনি ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতে ই-লার্নিং-কে আরো বেশি হারে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেন।
ওয়েবিনারে মুক্ত আলোচনায় ঢাকা চেম্বারের সাবেক সহসভাপতি এম আবু হোরায়রাহ, রিয়াদ হোসেন ও ডিবিআইয়ের প্রশিক্ষক শংকর রায় অংশগ্রহণ করেন এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ডিসিসিআইয়ের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি এনকে মবিন।